মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা

ধর্ম
ধর্ম

মাতৃভাষা মানবজাতির জন্য সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এক বিরাট নিয়ামত ও খোদার সেরা দান। আল্লাহর অনেক বিস্ময়কর নিদর্শনের মধ্যে ভাষা একটি অন্যতম বিশেষ নিদর্শন। মাতৃভাষাই মানুষের জীবনে স্বাভাবিক কাজকর্মের প্রকৃষ্টতর বাহন। কেননা, মাতৃভাষা হলো প্রকৃতিগত নিজ ভাষা। পৃথিবীতে বিচিত্র ধরনের অসংখ্য মাতৃভাষা প্রচলিত আছে। এ ভাষা মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সর্বোত্তম মাধ্যম। বস্তুত ভাষার ব্যবহার মুখে কথা বলা অথবা কলমে লেখার মাধ্যমে হয়ে থাকে। স্রষ্টার পক্ষ থেকে সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসার এক অসাধারণ নিয়ামতস্বরূপ মানুষ দুভাবেই ভাষা প্রয়োগের ক্ষমতা পেয়েছে। মানুষকে ভাষা শিক্ষাদানের লক্ষ্য মনের ভাব অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া। কথা বলা ও মনোভাব আদান-প্রদান করা মানুষের সহজাত কাজ। সে কর্মের সহায়ক কেবল মাতৃভাষা। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ভাব প্রকাশ করতে (ভাষা) শিখিয়েছেন।’ (সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ৩-৪)
আল্লাহ প্রদত্ত ভাষাজ্ঞান ও কথা বলার নির্দেশনা অনুযায়ী মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে অন্যের কাছে তুলে ধরা যায়। এ জন্য মানুষ সৃষ্টির সঙ্গে ভাষা শিক্ষাদানের বিষয়টি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কেননা, বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানার্জন করতে হলে মানুষের অবশ্যই প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান থাকতে হবে। প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী-গুণী ও পণ্ডিত হতে হলে ভাষা সম্পর্কে ব্যাপক অনুশীলন করা উচিত। পড়াশোনার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের সঙ্গে ভাষাচর্চাও যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। পবিত্র কোরআনের বাণী থেকে ভাষাচর্চার প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রথম নাজিল হওয়া আয়াতে জ্ঞানার্জন তথা বিদ্যাশিক্ষার জন্য মানুষের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘পড়ো! তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।...যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সূরা আল-আলাক, আয়াত: ১-৫)
ইসলামের শিক্ষা মানুষকে বিভিন্ন ভাষাচর্চায় দারুণভাবে উৎসাহিত করে ও বিশেষ অনুপ্রেরণা জোগায়। বিশ্বের সব জনগোষ্ঠীরই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। ভাষা ও বর্ণের বিচিত্রতা বিশ্বজ্ঞানমণ্ডলের শোভা বৃদ্ধি করেছে এবং মানুষের মধ্যে পারস্পরিক জানার ও জানানোর অদম্য স্পৃহাকে গতিশীল করেছে। মাতৃভাষার মাধ্যমে অন্য ভাষার মানুষের চিন্তা–চেতনা, মেধা-মননশীলতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানকে অতি সহজে রপ্ত করা যায় এবং হৃদয়ের গভীরে তা আত্মস্থ করা যায়। মাতৃভাষা স্বভাবতই একজন মানুষের ব্যক্তিসত্তার অন্তর্গত হয়ে যায়। তাই ভাষাশিক্ষা অত্যন্ত ¦গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করার পর থেকে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত মাতৃভাষা আপনা-আপনি শিখতে থাকে। অন্যদিকে চর্চা, অধ্যয়ন ও গবেষণার মাধ্যমে অন্যান্য ভাষা শেখা যায়। প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কণ্ঠে যথার্থই ধ্বনিত হয়েছে, ‘মানুষের স্বভাবের মধ্যে যদি ভাষার বীজ না থাকত, তাহলে ভাষার অস্তিত্ব সম্ভবত মানুষের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেত না। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির সঙ্গেই তার মধ্যে ভাষার বীজ রেখে দিয়েছেন। এদিক থেকে ভাষাকে মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব দান বলা যেতে পারে।’
মহানবী (সা.) মাতৃভাষা বিশুদ্ধভাবে শিক্ষা ও চর্চার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করতেন। তাই মাতৃভাষা শুদ্ধ করে চর্চা করা, বিশেষ করে তা বিশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা অনুপম সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ মাতৃভাষা আরবিকে ভালোবাসতেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমরা তিনটি কারণে আরব তথা আরবিভাষীকে ভালোবাসবে। কেননা, আমি আরবিভাষী, কোরআনের ভাষা আরবি এবং জান্নাতবাসীর ভাষাও আরবি।’ (বায়হাকি) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী।’ আল্লাহর একত্বের আহ্বান সফলভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে সেই জনপদের জনগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষায় দ্বীনের প্রচারকাজ চালানো দরকার। প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান না থাকলে সফলভাবে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো সহজ নয়। যথার্থ ভাষাজ্ঞান না থাকলে ইমানি দায়িত্ব পালন খুবই কঠিন।
প্রতিটি জাতির কাছে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা অপরিসীম। প্রত্যেক মানুষের কাছে মাতৃভাষা সর্বাধিক প্রিয়। মায়ের প্রতি যেমন আন্তরিক শ্রদ্ধা, মাতৃভাষার প্রতিও মানুষের গভীর অনুরাগ-শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম-খাঁটি ভালোবাসা হয়ে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে সব ভাষাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সমানভাবে মর্যাদাসম্পন্ন। প্রকৃতপক্ষে ভাষা আল্লাহর এক অপূর্ব সৃষ্টি। তাঁর সীমাহীন কুদরতের মধ্যে এটি একটি শ্রেষ্ঠ অবদান। সব ভাষা মহান আল্লাহর দান। তাঁর কাছে সব ভাষাই গ্রহণযোগ্য। তাই তিনি নবী-রাসুলদের তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছেন। প্রত্যেক নবী-রাসুল নিজেদের মাতৃভাষায় মানুষের কাছে তাওহিদ বা আল্লাহর একত্বের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন এবং বিপথগামী মানুষকে চিরসত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে আহ্বান করেছেন। তাই নিজস্ব মাতৃভাষা শেখা ও সহজাত গতি বা উৎসারিত ও স্পন্দিত সে মাতৃভাষাতেই পবিত্র কোরআন ও হাদিসের মর্মবাণী জানার এবং সৎ কর্ম করার জন্য ইসলাম মানুষকে তাগিদ দিয়েছে।
আল্ল­াহ তাআলা অন্তর্যামী, তিনি সব ভাষা বোঝেন। তাঁর কাছে জাগতিক সব ভাষার গুরুত্ব সমান মর্যাদার, সব ভাষাই আল্ল­াহর সৃষ্টি। যেকোনো মাতৃভাষায় তাঁকে ডাকা যায়। জন্মের পর থেকে আমরা মাতৃভাষা বাংলায় মনের ভাব, আবেগ-উচ্ছ্বাস, প্রেম-ভক্তি, যাবতীয় অনুভব, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ও আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করি। বাংলা আমাদের কাছে মায়ের মতো শ্রদ্ধাস্পদ। এ জন্য মাতৃভাষা বাংলাকে যথোচিত মর্যাদা দেওয়া অবশ্যকর্তব্য। যেমনভাবে সৃষ্টিকর্তার কাছে আমরা মাতৃভাষা বাংলায় নীরবে-নিভৃতে কায়মনোবাক্যে মোনাজাত ও অন্তরের নিবেদন প্রকাশ করে থাকি। মনের আকুতি প্রকাশ করে বিনয় ও মিনতিপূর্বক প্রার্থনায় দেহ, মন ও আত্মার মাঝে এক স্বর্গীয় অনুভূতি তৈরি হয়। বান্দার আর্তি আল্লাহর কাছে কবুল হওয়া না-হওয়ার দোলায় দুলেও মাতৃভাষায় আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পেরে জাগতিক স্বস্তি ও পারলৌকিক শান্তির ছোঁয়া পাওয়ার আশা করা যায়। তাই অমৃত সুধায় ভরা মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে কবির ভাষায় বলা যায়, ‘মধুর চেয়েও আছে মধুর, সে যে আমার মাতৃভাষা/ মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।’
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]