সংবাদপত্র কীভাবে জঙ্গিদের মদদ দিচ্ছে?

‘প্রধানমন্ত্রী বলেন “দেশের ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো জিনিস পত্রিকায় ছাপানো উচিত না। কেন এটা করা হচ্ছে আমার কাছে বোধগম্য নয়। আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এই হিযবুত তাহ্রীরের পোস্টার ছাপিয়ে যারা তাদের মদদ দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”’ (প্রথম আলো, বৃহস্পতিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার, যেটি ধর্মীয়, রাজনৈতিকসহ সব ধরনের উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার, সেই পত্রিকার বিরুদ্ধে একটি নিষিদ্ধঘোষিত সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে ‘মদদ’ দেওয়ার অভিযোগসহ হুমকিসূচক এই কথাগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বুধবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে। ১১ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রটির তৃতীয় পাতায় হিযবুত তাহ্রীরের একটি পোস্টারের ছবি ছাপা হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ, ডেইলি স্টারসহ দেশের সংবাদমাধ্যমের এর জন্য গুরুতর বার্তাবহ। এই ঘটনায় সাংবাদিকতার প্রায়োগিক অনুশীলন ও এ পেশার নৈতিকতা নিয়ে কিছু গোড়ার প্রশ্ন আবার উঠে এল। তবে সেসব প্রশ্নে যাওয়ার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক, ডেইলি স্টার-এর পাতায় পোস্টারটির একটি আলোকচিত্র কীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
দেয়ালে সাঁটা অবস্থায় পোস্টারটির একটি আলোকচিত্র ছাপা হয়েছে তিন কলামজুড়ে। তিন কলাম শিরোনামে বড় বড় ফন্টে ক্যাপিটাল লেটারে লেখা হয়েছে: ‘ফ্যানাটিকস রেইজ দিয়ার আগলি হেডস অ্যাগেইন’ (উগ্রপন্থীরা আবারও তাদের কুৎসিত মাথা তুলছে)। স্মর্তব্য যে, ইংরেজি সংবাদপত্রগুলোতে সংবাদের শিরোনাম সাধারণত ক্যাপিটাল লেটারে লেখা হয় না। এখানে ক্যাপিটাল লেটার ব্যবহার করা হয়েছে বিষয়টির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে। এই দৃষ্টি আকর্ষণ একটি সতর্কবার্তা: দেশবাসী ও সরকারকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হচ্ছে, দেখুন, এই অশুভ শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে (তাদের মাথা ‘কুৎসিত’)। আলোকচিত্রটির নিচে ক্যাপশন লেখা হয়েছে: ‘টেকিং অ্যাডভান্টেজ অব দ্য কারেন্ট পলিটিক্যাল ক্রাইসিস ইন দ্য কান্ট্রি অ্যাকোম্পানিড বাই ওয়ান্টন ভায়োলেন্স, ব্যানড এক্সট্রিমিস্ট ইসলামিস্ট অর্গানাইজেশন হিযবুত তাহ্রীর পাবলিশড অ্যান্ড পেস্টেড পোস্টারস ইন দ্য ক্যাপিটাল ইন অ্যান অ্যাটেম্পট টু ফোমেন্ট আনরেস্ট উইদইন আর্মড ফোর্সেস। দিস পোস্টার ওয়াজ ফাউন্ড পেস্টেড অন এ ওয়াল নিয়ার বাংলামোটর ইন্টারসেকশন ইয়েসটারডে’ (দেশে চলমান ব্যাপক সহিংসতাপূর্ণ রাজনৈতিক সংকটের সুযোগ নিয়ে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি ইসলামি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে অস্থিরতা উসকে দেওয়ার লক্ষ্যে পোস্টার ছাপিয়ে রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে সেঁটেছে। এই পোস্টারটি গতকাল দেখতে পাওয়া যায় বাংলামোটরের চৌরাস্তার কাছের একটি গলির দেয়ালে)।
ক্যাপশনটির বক্তব্য প্রধানত তথ্যমূলক, তবে তথ্যের সঙ্গে সংবাদপত্রটির নিজস্ব অবস্থানও ব্যক্ত হয়েছে, যা কোনোভাবেই হিযবুত তাহ্রীরের প্রতি সহযোগিতামূলক নয়, বরং তার উল্টা। ছবিটির ক্যাপশনও শিরোনামের মতোই একটি বড় হুঁশিয়ারি।
পোস্টারটির ভাষ্য থেকে যে তথ্য পাওয়া গেল তা হলো এই যে, হিযবুত তাহ্রীর আমাদের সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে উসকানি সৃষ্টি করার দুরভিসন্ধি নিয়ে প্রচারণায় লিপ্ত রয়েছে। এই তথ্য দেশবাসীর সামনে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে ডেইলি স্টার সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। এটাকে জঙ্গিদের মদদ দেওয়া হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়। এ জন্য পত্রিকাটির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার হুমকি দুঃখজনক।
হিযবুত তাহ্রীর একটি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন—এটা এখন আর খবর নয়। বাংলাদেশে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের ঘৃণ্য ও জনবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতে পারছে না—এমন কথাবার্তাও সরকারের পক্ষ থেকে গর্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়, সংবাদমাধ্যমগুলো প্রকৃত পরিস্থিতি গভীরভাবে তলিয়ে না দেখেই সরকারের সেসব কথাবার্তা প্রচার করে। কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রবল জঙ্গিবিরোধী এই পরিবেশের মধ্যেই হিযবুত তাহ্রীর কীভাবে তাদের গোপন তৎপরতা চালিয়ে যেতে পারছে, কোথায় কোন প্রেসে তারা বিপুল পরিমাণে উসকানিপূর্ণ পোস্টার ছাপাতে পারল, কী করেই বা তারা খোদ রাজধানীর অনেক এলাকার দেয়ালে দেয়ালে সেসব পোস্টার সেঁটে দিতে পারল—সরকার কি এসব খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছে? যে প্রেসে পোস্টারগুলো ছাপা হয়েছে, তার অস্তিত্ব আবিষ্কারের চেষ্টা কি করেছে এবং তা আবিষ্কার করতে পেরেছে? কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে প্রেসটির বিরুদ্ধে? এসব পোস্টার ছাপানো ও দেয়ালে সাঁটার সময় বা তার পরে এ অপরাধের দায়ে পুলিশ কি কাউকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে?
রাজধানীর দেয়ালে সাঁটা হিযবুত তাহ্রীরের একটি পোস্টারের ছবি প্রকাশ করার জন্য একটি সংবাদপত্রকে সংগঠনটির মদদদাতা আখ্যা দিয়ে শাস্তির হুমকি দেওয়ার পরিবর্তে নিষিদ্ধঘোষিত হওয়ার পরেও হিযবুত তাহ্রীর নামের জঙ্গি সংগঠনটি কীভাবে খোদ রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগাতে পারছে, এর জবাবদিহি নিশ্চিত করা বেশি জরুরি।
সংবাদমাধ্যমের কাজ জনগণকে সংবাদ দেওয়া—এই অতি প্রাচীন কথাটি আবার স্মরণ করা যাক। বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানের কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা দরকার। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ওই ইসলামি জঙ্গিদের সহিংস উপদ্রবে বাংলাদেশ পাকিস্তান-আফগানিস্তানের চেহারা পেতে যাচ্ছিল। স্মরণ করা যাক, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারসহ দেশের প্রধান জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রগুলো তাদের জঙ্গি তৎপরতার খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করছিল বলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, অন্যান্য মন্ত্রী ও বিশেষত শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বলতেন, ‘বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি’, ‘দেশে জঙ্গিবাদ নাই, জঙ্গিবাদ মিডিয়ার সৃষ্টি।’ কিন্তু তার পরেও সংবাদমাধ্যম চুপ করে থাকেনি, অবিরাম জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা ও তাদের অশুভ কর্মকাণ্ডের খবর প্রচার করেছে। সংবাদমাধ্যম জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবিরাম সংবাদ, মতামত, সাক্ষাৎকার, চিঠিপত্র ইত্যাদি প্রকাশ করেছে দিনের পর দিন। তার ফলে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে প্রচণ্ড জনমত সৃষ্টি হয়েছিল। দেশি ও আন্তর্জাতিক সেই চাপেই তৎকালীন সরকার জঙ্গিবাদের রাশ টেনে ধরতে বাধ্য হয়েছিল। যে জঙ্গিদের তারা মাঠে ছেড়ে দিয়েছিল, তাদের ধরে ফাঁসিতে লটকাতে বাধ্য হয়েছিল।
জঙ্গিবাদ দমনে সংবাদমাধ্যমের সক্রিয় সহযোগিতার এমন দৃষ্টান্ত নিকট অতীতেই যখন আছে, তখন ডেইলি স্টার-এর পাতায় হিযবুত তাহ্রীরের একটি পোস্টারের ছবি ছাপার ঘটনাকে উেল্টাভাবে পাঠ করা যৌক্তিক নয়।
কেউ হয়তো একটা আইনি প্রশ্ন তুলে বলতে পারেন: যে সংগঠন আইন দ্বারা নিষিদ্ধ, তার পোস্টার বা যেকোনো প্রচারপত্র পুনঃপ্রচার করাও বেআইনি হবে। কিন্তু এই যুক্তিকে সিদ্ধান্ত আকারে হাজির করার আগে পুনঃপ্রচারের মোটিভ বা উদ্দেশ্য বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। উদ্দেশ্যটা যে ওই বেআইনি সংগঠনকে সহযোগিতা করা নয়, বরং তাদের সম্পর্কে দেশবাসী ও সরকারকে সতর্ক করা, তা তো ছবিটির শিরোনাম ও ক্যাপশনের বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।