নূরুল কাদের

মোহাম্মদ নূরুল কাদের
মোহাম্মদ নূরুল কাদের

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত নাইন মান্থস টু ফ্রিডম চলচ্চিত্রটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয় মনে পড়বে, ছবির শুরুতেই ভেসে ওঠে সামরিক পোশাকসজ্জিত শ্মশ্রুমণ্ডিত এক তরুণের বুদ্ধিদীপ্ত মুখ এবং সেই মুখ থেকে চ্চারিত প্রথম বাক্য: আই অ্যাম নূরুল কাদের। এই আত্মপরিচয়দানের মধ্যে যে সুরটি বেজেছিল, তা গভীর ত্মপ্রত্যয়ের—যেন সে বলতে চাইছে, আই অ্যাম দ্য নূরুল কাদের—নূরুল কাদের নামে আছে অনেকে, কিন্তু আমি আমিই। আত্মপ্রত্যয় ছিল নূরুল কাদেরের আজীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য, তা অনেককে কাছে টানত—কাউকে কাউকে দূরেও ঠেলে দিত। আমাকে সে কাছে টেনেছিল। প্রথম দর্শনে নূরুল কাদেরের প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম তার অনিন্দ্যসুন্দর কান্তিতে, রুচিশীল পোশাকে, অনুপম বাকভঙ্গিতে এবং সর্বোপরি তার আত্মপ্রত্যয়ের অভিব্যক্তিতে।
যত দূর জানি, নূরুল কাদের খান ঝিলু আরমানিটোলা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেছিল ১৯৫০ সালে। তারপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে সে যোগ দিয়েছিল পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। বছর খানেকের মধ্যেই স্বাস্থ্যগত বা অন্য কোনো কারণে অযোগ্য ঘোষিত বা ছাঁটাই হয়ে সে ফিরে এসেছিল। তখন ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকম ক্লাসে। সে ছিল ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র। আমি সদ্য শিক্ষকতায় ঢুকেছি—ঝিলু একদিন জানাল যে সে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবে। তার পরীক্ষায় একটা বিষয় বাংলা, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়ার মতো সময় তার নেই। আমাকে ও বিষয়ে সারকথাগুলো বলতে হবে, সে শুনে নেবে। তথাস্তু। ঝিলু আমার বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে থাকত—কখনো কখনো চোখ বন্ধ করে। বিছানার ধারে চেয়ার টেনে বসে আমি নিজের মতো বলে যেতাম। সে কোনো লেখালেখির মধ্যে যেত না। চার অধিবেশনে বোধ হয় আমাদের কাজ শেষ হয়েছিল। শ্রুতিধরের মতো মূল কথাগুলো সে মনের মধ্যে ধরে নিয়েছিল। পরে আমাকে বলেছিল, বাংলায় সে অনেক নম্বর পেয়েছে। এই কৃতিত্বে আমার একটা ভাগ ছিল হয়তো, কিন্তু অধিকাংশ ঘটেছিল তার গুণে। ঝিলু পরীক্ষা দিয়েছিল বোধ হয় ১৯৬০ সালে সিভিল সার্ভিসে। চূড়ান্তভাবে প্রবেশ করতে করতে ১৯৬১ সালে হয়ে যায়। এরপর তার সঙ্গে যোগাযোগ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে মহকুমা প্রশাসক বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে তার উৎকেন্দ্রিকতার কিছু গল্প শুনতাম। সাক্ষাৎ হলে ঝিলু তার সদ্য পড়া কোনো বই বা সদ্য দেখা কোনো চলচ্চিত্রের গল্প করত। তারপর আমি চলে গেলাম চট্টগ্রামে। তার সঙ্গে একেবারেই আর দেখা হতো না, তবে ড. মল্লিক যেহেতু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, তাই তাঁর বা ভাবির কাছ থেকে ঝিলুর খবর পাওয়া সহজ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, কিছুদিন আগরতলায় কাটিয়ে, কলকাতায় এসে পৌঁছাই মে মাসের মধ্যভাগে। ঝিলু তখন রীতিমতো বীর। শুনলাম, পাবনার জেলা প্রশাসক হিসেবে সেখানে সে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে। জেলখানা খুলে দিয়ে সে কয়েদিদের মুক্ত দিয়ে তাদের আহ্বান জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে; সরকারি অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র বের করে দিয়েছে জনে জনে; ট্রেজারির টাকা সরিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের জন্য। প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার সময় সকল যোদ্ধাকে ট্রেনে তুলে নিয়ে সেই ট্রেনে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে, সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছে ভারতে। বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পরে সে হয়েছে প্রথম সংস্থাপনসচিব। এত দিন পরে দেখা হওয়ার উল্লাস: উচ্ছ্বাস কাটার পরে জানলাম, ঘাতক পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণাবশত সে নিজের নামের শেষাংশ খান ছেঁটে দিয়েছে, আর প্রতিজ্ঞা করেছে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত গোঁফদাড়ি কামাবে না। ঝিলু আজন্ম আশাবাদী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাই তার সঙ্গে কথা বলে আরও একধরনের আরাম পাওয়া যেত। আমার কথায় আমার বন্ধুর অগ্রজকে আগরতলা থেকে মুজিবনগরে সে বদলি করে এনেছিল। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি তার মনে গড়ে উঠেছিল অশেষ শ্রদ্ধা। জনকণ্ঠে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তার ‘আমার একাত্তর’ নামক রচনায় তার পরিচয় আছে, আর সে সময়ে তার অভিজ্ঞতার বিশ্বস্ত বর্ণনা আছে। ওই লেখা প্রকাশ পেতে শুরু করলে তাকে যখন বললাম, ওই একই নামে আমিও লিখেছি, সে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, তাই নাকি? তা বেশ তো। তোমার আমার একই নামের বই থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঝিলু হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তাই। তবে স্বাধীন দেশে সে নানা বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিল। কেউ অভিযোগ করলেন, ‘মুজিবনগরী’ নূরুল কাদের দেশে রয়ে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন; আবার দেখা গেল, মুক্তিসংগ্রামী আরেক সচিবের সঙ্গেও প্রকাশ্যে তার ঝগড়া হয়ে গেল। সে বিয়ে করল ১৯৭৩ সালে, সংসারী হলো, কিন্তু সরকারি কাজে নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারল না। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ঝিলু করল পোশাকশিল্পের প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ পোশাকশিল্প আজ যে নানা দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য, সেই শিল্পক্ষেত্রে নূরুল কাদেরের ভূমিকা পথিকৃতের। তার মনটা বড় ছিল। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও আমি একবার এক সৎ কাজের জন্য চাঁদা তুলতে দেশ গার্মেন্টস অফিসে তার কাছে গিয়ে আমাদের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলাম। ঝিলু আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার জন্য কত ধরেছ?’ বললাম, ‘৫০ হাজার।’ সে তার সচিবকে ডেকে কী বলল। আমাদের কফি খাওয়া শেষ হতে সচিব তার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে গেলেন। সেটা সে দিল আমাকে। তার মধ্যে ৫০০ টাকার ১০০ নোট।
আনিসুজ্জামান: লেখক ও শিক্ষাবিদ। ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।