ভুলে ভরা পাঠ্যবই

বর্তমান সরকারের আমলে যে কয়েকটি মন্ত্রণালয় কিছুটা পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের পাশাপাশি মুখস্থবিদ্যার বিপরীতে সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি চালু করে তারা প্রশংসিত হয়েছে। আগে পাঠ্যবইয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হতো, বর্তমান সরকার বছরের প্রথম দিনই তাদের হাতে ২৭ কোটি বই পৌঁছে দিতে পেরেছে। এর কৃতিত্ব নিশ্চয়ই শিক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করতে পারে।
কিন্তু প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে পাঠ্যবইয়ের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এই পাঠ্যবই প্রণয়ন ও সরবরাহের দায়িত্ব মূলত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। সেই দায়িত্ব যে তারা যথাযথভাবে পালন করেনি সেটা পরিষ্কার এবং সে কারণেই পাঠ্যবইগুলো নানা ভুল ও তথ্য বিকৃতিতে আকীর্ণ। পাঠ্যবইয়ে কোনো ধরনের ভুলই গ্রহণযোগ্য নয়, এর পরও কেবল বানান বা ভাষাগত ভুল থাকলে হয়তো মার্জনা করা যেত। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তথ্য ও তত্ত্বে মারাত্মক বিচ্যুতি লক্ষ করা গেছে, যা অমার্জনীয়। যে পাঠ্যবই শহীদ রুমীকে জামীর বাবা বানায়, সেই পাঠ্যবই এবং এর প্রণেতা প্রতিষ্ঠানটির আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, তা ভেবে দেখতে হবে।
প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেছেন। সরকারের তথ্যবিবরণীতে পাঠ্যবইয়ের ভুলগুলো সংশোধন করে তার একটি শুদ্ধিপত্র প্রকাশ ও প্রচার এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। তাদের এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে যাতে পাঠ্যবইয়ে কোনো ভুল না থাকে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ সজাগ থাকাও জরুরি বলে মনে করি।
পাঠ্যবই প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন লেখক-সম্পাদকের অভিযোগ, তাঁদের যে সম্মানী দেওয়া হয়, তা এতটাই অসম্মানজনক যে, তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর পরও এনসিটিবির কর্তাব্যক্তিরা লেখক-সম্পাদকদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেননি। কারণ, প্রতিষ্ঠানটি যোগ্য শিক্ষক ও লেখকদের দিয়ে পাঠ্যবই না লিখিয়ে অযোগ্য লোকদের দিয়েই কাজটি সমাধা করতে চায়। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে এনসিটিবি কর্মকর্তাদের গাড়ি ও অফিসের সাজসজ্জার পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও লেখক-সম্পাদকদের ন্যূনতম সম্মানী দিতে নারাজ। এ ধরনের হীন মানসিকতার কর্মকর্তাদের দিয়ে নির্ভুল পাঠ্যবই প্রণয়ন সম্ভব নয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এনসিটিবিকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে একটি স্বার্থান্বেষী চক্র গড়ে উঠেছে। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা এমনকি সরকার বদল হলেও এনসিটিবির সেই চক্র বহাল তবিয়তেই থাকে। যাঁর বা যাঁদের পাপে এসব ভুলে ভরা পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে চলে গেছে, সরকারের প্রতিশ্রুতি মতো তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে আশা করি। এনসিটিবিকে ঘিরে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাঁদের অনুগ্রহভাজন কথিত লেখকদের নিয়ে যে চক্রটি গড়ে উঠেছে, তা ভাঙতে না পারলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব সাধু উদ্যোগই ভেস্তে যাবে।