পরিবারে নারীর ভূমিকা

ধর্ম
ধর্ম

মানুষকে নারী ও পুরুষ ভিন্ন সত্তায় সৃজন না করলে হয়তো মানববংশই বিস্তার লাভ হতো না; প্রথম মানুষ হজরত আদম (আ.) পর্যন্তই তা থেমে যেত! তাই সৃষ্টির আদি থেকে নারীর প্রতি পুরুষের এবং পুরুষের প্রতি নারীর রয়েছে প্রবল আকর্ষণ। উভয়ের বৈবাহিক সম্পর্ককে পারিবারিক স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য প্রদত্ত হয়েছে পারস্পরিক ভালোবাসা। যার প্রয়োজনে নারী ও পুরুষের সৃষ্টিতে সুন্দর কাঠামোতে অবয়ব ও বৈশিষ্ট্যগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু মর্যাদার দিক দিয়ে আল্লাহর কাছে নারী বা পুরুষ বলে আলাদা কিছু নেই; পুরুষের বেশি মর্যাদা আর নারীর কম মর্যাদা এমনটি নয়। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, পরে তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকি।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
আরব বিশ্বে যখন নারীর কোনো সম্মান ও মর্যাদা ছিল না, যখন পুরুষেরা তাকে শুধুই ভোগের জন্য ব্যবহার করত, যখন মেয়েশিশু জন্মগ্রহণকে অপমানজনক মনে করে তাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো, তখন মহানবী (সা.) নারী ও পুরুষের প্রাপ্য মর্যাদার কথা বললেন। পরিবারে মেয়েশিশুর প্রতি কোনো রকম তাচ্ছিল্য প্রদর্শন, ছেলে ও মেয়ের মধ্যে পার্থক্য বিধান এবং মেয়েদের ওপর ছেলেদের অহেতুক প্রাধান্য দিতে কঠোরভাবে নিষেধ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার তত্ত্বাবধানে কোনো মেয়েশিশু থাকে আর সে তাকে জীবিত দাফন না করে, মেয়েকে তুচ্ছ না করে এবং ছেলেকে অগ্রগণ্য না করে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।’ (আবু দাউদ)
পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে পোশাকের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে, পোশাকের সঙ্গে দেহের সম্পর্ক যত নিবিড়, আদর্শ পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ততটাই নিবিড় হওয়া চাই। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭) স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে, যেমন তাদের ওপর পুরুষদের অধিকার আছে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৮)
ইসলাম পরিবার ও সমাজে নারীর ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি প্রদান করেছে। নারীদের উদ্দেশে শিক্ষামূলক ভাষণ দিয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্যই জ্ঞানার্জন করা ফরজ।’ (ইবনে মাজা) প্রয়োজনে নারীরা ঘরের বাইরে গমন, সমাজকল্যাণ, জাতিগঠন ও উন্নয়নমূলক কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা এমনকি দেশের প্রতিরক্ষায় যুদ্ধক্ষেত্রে যোগদান প্রভৃতি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে। নারীকে ঘরের বাইরে যেতে হবে বলেই ইসলাম তার সম্ভ্রম ও নিরাপত্তার জন্য পর্দার ব্যবস্থা করেছে। জীবিকা অর্জন ও প্রয়োজনের তাগিদে নারীদের বহির্গমনের আদেশ দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রয়োজনীয় কাজে বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ (বুখারি)
স্বামীর সংসারে গৃহকর্ত্রী হিসেবে নারীর ভূমিকা নির্ধারণ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘স্ত্রী তার স্বামীর পরিজনবর্গের এবং সন্তানদের তত্ত্বাবধানকারিণী।’ (বুখারি ও মুসলিম) পিতা যেহেতু বাইরে চাকরি বা ব্যবসার কাজে কর্মব্যস্ত, সেহেতু মুসলিম পরিবারে সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া ও চরিত্র গঠন করার মতো গুরুদায়িত্ব মাতাকেই পালন করতে হয়। সন্তানকে সুস্থ ও সৎমানুষ রূপে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মায়ের অবদানকে অম্লান করতে মানবসমাজ ও পরিবারে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে মহানবী (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ (আহমাদ ও নাসাঈ)
সমাজ–সংসারে যদি নারীর বুদ্ধিমত্তা ও প্রচেষ্টায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং সন্তানসন্ততি শিক্ষিত, ভদ্র-নম্র ও সৎচরিত্রবান হয়, তবেই তা একটি আদর্শ পরিবার। পরিবারে নারী ও পুরুষ উভয়ে নিজ নিজ বলয়ে একে অপরের বন্ধু ও সঙ্গীসাথি হয়ে সমাজ-সংসারে যৌথভাবে কাজ করবে। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য যেকোনো উপায়ে প্রাপ্ত অর্থবিত্তে নারীর ইচ্ছেমতো ব্যয় করার একচ্ছত্র অধিকার ইসলামে স্বীকৃত। সম্পদে নারীর অধিকার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ।... পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তির প্রতিটির জন্য আমি উত্তরাধিকারী করেছি এবং যাদের সঙ্গে তোমরা অঙ্গীকারবদ্ধ, তাদেরকে অংশ দেবে।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩২-৩৩)
আদর্শ পরিবার গঠনে ইসলাম নারী জাতির যথাযথ অধিকার, সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করেছে। বর্তমান সমাজে কিছু বখাটে লোক নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, অসম্মান ও অমর্যাদা করছে। এ ক্ষেত্রে নারীদের সম্পত্তির ন্যায্য অধিকার, মোহরানার অধিকার, দাম্পত্য অধিকারসহ ইসলাম প্রদত্ত নারী জাতির বিভিন্ন অধিকার রক্ষায় এবং নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌতুক প্রভৃতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও মেয়েশিশুর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সামাজিকভাবে গণসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]