নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন

.
.

জার্মান দার্শনিক নিটশে বলেছিলেন, ‘সমাজ-রাষ্ট্রে চলতে গিয়ে আমরা কিছু দৃষ্টিভঙ্গি-মূল্যবোধ তৈরি করি। তৈরি করে আমরা তা ভুলে যাই, আর ভুলে যে যাই, তাও আমরা ভুলে যাই, ফলে তৈরি করা ওই সব দৃষ্টিভঙ্গি-মূল্যবোধকেই আমরা বৈধ আর স্বাভাবিক মনে করি।’ বোধ করি, এ কারণেই একজন মানুষ যখন পুরুষতান্ত্রিক জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠে, তখন সে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই নারীকে দেখে, বিচার ও বিবেচনা করে। আসুন, কয়েকটি নমুনা পরীক্ষা করি।
এক. নারীর পোশাকে পকেট নেই কেন?
খেয়াল করে দেখুন, বাংলাদেশের নারীদের পোশাক—বেশির ভাগের পোশাক হয় শাড়ি, নয় সালোয়ার-কামিজ। শাড়ি আর সালোয়ার-কামিজে পকেট থাকে না; পক্ষান্তরে পুরুষের পোশাক শার্ট, প্যান্ট, পাজামা-পাঞ্জাবি—প্রতিটিতেই পকেট থাকে। কেন পুরুষের পোশাক পকেটযুক্ত আর নারীর পোশাক পকেটহীন? কারণ, ‘পকেট’ মানে ‘অর্থ’। পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোয় এ সত্য নির্মাণ করা হয় যে টাকাপয়সা অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রের ‘অর্থনৈতিক এলাকা’ কেবল পুরুষের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তাই পুরুষ নারীর পোশাক থেকে পকেটকে ‘নাই’ করে দিয়েছে, যাতে অর্থের ওপর নারীর কোনো নিয়ন্ত্রণ তৈরি না হয়। পুরুষের টাকা এত বেশি যে কেবল পকেটে কুলায় না, উপচে পড়ে, এ জন্য তার বাড়তি ব্যাগ দরকার। কী নাম ব্যাগটির? ‘মানি ব্যাগ’। এ প্রত্যয়টি আবারও ‘মানি’ বা ‘অর্থ’ বা ‘ইকোনমি’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিপরীতে মেয়েদেরও একটি ব্যাগ থাকে, যার নাম মানি ব্যাগ নয়, ভ্যানিটি ব্যাগ। বাংলা একাডেমির অভিধানে ভ্যানিটি ব্যাগের বাংলা করা হয়েছে: ‘প্রসাধনপেটিকা, ছোট আয়না, প্রসাধনসামগ্রী ইত্যাদি রাখার জন্য ক্ষুদ্র থলে...’। পাঠক, বুঝুন এবার, কীভাবে নারীর পোশাক এবং অভিধান-ব্যাকরণ—দুিটই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় পুষ্ট। এর মধ্য দিয়ে পুরুষতন্ত্র তথাকথিত রূপ, সৌন্দর্য আর প্রসাধনের মতো তুচ্ছ কাজে নারীকে আটকে রাখতে চায়। অথচ কে না জানে, এক গার্মেন্টস খাতেই ৪০ লাখের বেশি নারী কাজ করেন। নারী আজ পাইলট, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, অধ্যাপক, ট্রেনচালক। সময় এসেছে পুরুষের তৈরি পোশাকের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার; পকেট সংযুক্ত করে নারীর পোশাকে অর্থনীতির নতুন মাত্রা যোগ করার আর পুরুষতান্ত্রিক ব্যাকরণ পাল্টে ফেলার।

দুই. রোকেয়া এখনো কেন অবরোধবাসিনী!
বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হল আছে, ‘রোকেয়া হল’। যেসব কৃতী পুরুষের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের নাম, যেমন স্যার এ এফ রহমান, বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমান, সার্জেন্ট জহুরুল হক। তাঁদের ভাস্কর্য কিংবা মু্যরাল হলের সামনে, বাইরে থেকে দৃশ্যমান; কিন্তু বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্যটি হলের ভেতরে, গেটের আড়ালে, দেয়ালঘেরা, যা কেবল নারীরা দেখতে পায়। এও এক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বৈকি! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত বছরের ছাত্রজীবনে কখনোই আমি রোকেয়ার ভাস্কর্যটি দেখতে পাইনি। কারণ, মেয়েদের হলে ছেলেদের ঢোকা নিষেধ। শিক্ষক হিসেবে প্রথম যখন এক বিতর্ক প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে রোকেয়া হলে যাই, তখন বেগম রোকেয়ার অসাধারণ ভাস্কর্যটি আমার নজরে আসে। বেগম রোকেয়া কি এখনো ‘অবরোধবাসিনী’? রোকেয়া হলে এখন সংস্কারের কাজ চলছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত রোকেয়ার দেয়ালবন্দী ভাস্কর্যটি হলের বাইরের ফটকে স্থাপন করা, যাতে নারী-পুরুষ সবাই তা দেখতে পায়।
তিন. মোটরবাইক: কেন দুই পা এক দিকে?
মোটরসাইকেলে প্রায়ই দেখি, পুরুষ বাইক চালাচ্ছে আর মাঝখানে সন্তানকে রেখে মেয়েটি পেছনে বসে পথ চলছে। কোনো পুরুষ যখন বাইকের পেছনে বসে, তখন দুই পা দুই দিক দিয়ে বসে। এটাই বিজ্ঞানসম্মত এবং নিরাপদ বসার ভঙ্গি। কিন্তু দুই পা একই দিকে দিয়ে নারীকে দেখি বাইকের পেছনে বসতে। বসার ভঙ্গি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ। বোঝার চেষ্টা করি, কেন নারী এভাবে বসে? আসলে নারীর এই বসার ভঙ্গিও ঠিক করে দিয়েছে পুরুষবাদিতার দোষে দুষ্ট এ সমাজ। পুরুষ মনে করে, নারীর দুই পা দুই দিক দিয়ে বসা ‘শোভন’ দেখায় না; পুরুষের চোখে এ বসা অশ্লীল, সাহসী ও দাম্ভিক বসা। পুরুষতন্ত্র এটা মানতে নারাজ; সে কারণেই সে নারীর বসাকে ন্যুব্জ, দুর্বল আর অনিরাপদ করে দেয়। কিন্তু সেদিন আমার পরিচিত এক সাংবাদিককে দেখলাম, যিনি নারী, তিনিই সামনে বসে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন আর পেছনে বসে তার ছোট ভাই পথ চলছে। ছোট ভাইটি পেছন থেকে তার বোনকে আঁকড়ে ধরে আছে, পাছে না বাইক থেকে পড়ে যায়। তার মানে সময় পাল্টাচ্ছে, সমাজের বেঁধে দেওয়া নারী-পুরুষের গতানুগতিক ভূমিকার বদল হচ্ছে। নারী এখন ‘পেছনের যাত্রী’ থেকে ‘সামনের চালক’ হচ্ছে। আর কে না জানে, সামনে বসলে দুই পা এক দিকে দিয়ে বাইক চালানো যায় না, দুই পা দুই দিকেই দিতে হয়।

করণীয়
নারী-পুরুষের ছাঁচবদ্ধ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে পাঠ্যপুস্তক। রাষ্ট্র ও সমাজে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও চলচ্চিত্রের চেয়েও পাঠ্যপুস্তকের প্রভাব বেশি। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যমে ‘পাঠ্যপুস্তকের’ উল্লেখ বা গণমাধ্যম হিসেবে সমাজে এর ভূমিকা ও প্রভাব নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হতে আমরা দেখি না। যদিও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আধিপত্যশীল শ্রেণির মতাদর্শ বিনির্মাণে বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠান বড় ভূমিকা রাখে; শিশুর সামাজিকীকরণ, মানসগঠন কিংবা তার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে পাঠ্যপুস্তকের প্রভাব অন্য গণমাধ্যমের চেয়ে বেশি হওয়াই স্বাভাবিক; কেননা সুনির্দিষ্ট সময় ধরে পাঠ্যপুস্তক পড়তে বাধ্য থাকতে হয় বলে শিশুদের ওপর পাঠ্যপুস্তকের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, স্কুল হচ্ছে শিশুর সামাজিকীকরণের এক শক্তিশালী ক্ষেত্র। দেশের বিদ্যমান শিক্ষাকাঠামোয় স্কুলগুলোতে সুর্নিদিষ্ট পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করে শিক্ষা প্রদান করা হয়। এসব পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ কিংবা ছবিতে লিঙ্গীয় পক্ষপাতদুষ্ট প্রবণতা ফুটে ওঠার অভিযোগ মেলে। বলা হয়, এসব আধেয়তে পুরুষের ভূমিকাটি প্রধান হয়ে ওঠে আর নারীর প্রতিকৃতি ফুটে ওঠে অসহায়, দুর্বল আর নিষ্ক্রিয় হিসেবে। পাঠ্যপুস্তকে দেখা যায়, ছেলেরা ঝুঁকিপূর্ণ, শক্তিশালী ও তুলনামূলকভাবে স্বাধীন কাজে অংশ নিচ্ছে।
পক্ষান্তরে মেয়েরা কেবল গৃহস্থালির কাজের সঙ্গে সংশ্লি­ষ্ট থাকছে। কন্যা-জায়া-জননীর গৎবাঁধা চরিত্রের বাইরে নারী চিত্রিত হয় ডাকিনী, ছেলেভোলানো বুড়ি অথবা পরি-অপ্সরা হিসেবে। জেন্ডার বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাঠ্যপুস্তকে মেয়েশিশু বা নারীর এ ধরনের একপেশে নির্মাণ শিশুর মনোজগতে পুরুষতান্ত্রিকতার স্থায়ী বীজ রোপণ করতে পারে। বলা হয়, ‘জেন্ডার পক্ষপাত ও লৈঙ্গিক ছাঁচীকরণগুলো সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ছেলে/পুরুষ এবং মেয়ে/নারীর মধ্যে অন্তঃস্থিত হয়। এভাবে সমাজকাঠামো জেন্ডার–বৈষম্য জিইয়ে রাখে। গতানুগতিক পুরুষতান্ত্রিক ধারণা হলো, মেয়েদের জন্য প্রায়োগিক বিষয়গুলোকে মা ও গৃহিণী হিসেবে ভবিষ্যৎ ভূমিকার সঙ্গে সম্পর্কিত করা উচিত আর ছেলেদের বিষয়গুলো আনুষ্ঠানিক চাকরির বাজারে প্রবেশের প্রয়োজন বোধ করে প্রণীত হওয়া উচিত। যেমন কৃষি পড়বে ছেলেরা, গার্হস্থ্য অর্থনীতি পড়বে নারীরা। প্রচলিত পাঠ্যসূচি এই পার্থক্যসূচক কর্মপন্থাকে জোর দেওয়ার অনুমোদন দেয়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীদের অবদান ও জ্ঞানের অভিজ্ঞতাকে খাটো করে দেখা হয় কিংবা একেবারেই তা বাদ দেওয়া হয়।’
‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। এই শিক্ষানীতির ‘নারী’ শীর্ষক অধ্যায়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকগুলোতে জেন্ডার সংবেদনশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। শিক্ষানীতির এ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে পাঠ্যসূচিতে নারীর ইতিবাচক ও প্রগতিশীল ভাবমূর্তি ও সমান অধিকারের কথা তুলে ধরা হবে, যাতে নারীর প্রতি সামাজিক আচরণের পরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যসূচিতে আরও অধিকসংখ্যক মহীয়সী নারীর জীবনী ও নারীদের রচনা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। মাধ্যমিক স্তরের শেষের দুই বছরের পাঠ্যক্রমে জেন্ডার স্টাডিজ এবং প্রজনন-স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্ত করা হবে। মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে বিষয় নির্বাচনে ছেলেমেয়ে-নির্বিশেষে সবার পুরো স্বাধীনতা থাকবে এবং সব বিষয়ের ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে। কোনো বিশেষ বিষয়ের দিকে (যেমন গার্হস্থ্য অর্থনীতি) মেয়েদের উৎসাহিত করা বা ঠেলে দেওয়া যাবে না।’
আসলে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণার ভেতর থেকে আমরা চিন্তা করি বলেই নারীর অধস্তন রূপটি আমরা লক্ষ করি। শ্রেণিবিন্যস্ত আর বৈষম্যমূলক এ সমাজকাঠামোয় পুরুষও নানা বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার, কিন্তু সমাজকাঠামোর প্রকৃতি পুরুষতান্ত্রিক
হওয়ায় পুরুষের তুলনায় নারীর অবস্থান আরও নিচে, আরও প্রান্তে। যেকোনো বৈষম্যের প্রথম শিকার হয় নারী; সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেও নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক এ কাঠামোটিই টিকিয়ে রাখতে চায়। এ কাজে পরিবার, আইন কিংবা সমাজের অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ভূমিকা রাখে। পাঠ্যপুস্তকে তাই আমরা নারীর প্রতি প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের প্রকাশ দেখি; নারীর অধস্তন, দুর্বল, অসহায় আর নির্ভরশীল রূপটি দিনের পর দিন পুনরুৎপাদিত হতে দেখি। এভাবে জেন্ডার সামাজিকীকরণে পাঠ্যপুস্তক যে ভূমিকা রাখছে, তার ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী। দরকার নারীর গতানুগতিক ও অধস্তন অবস্থানের বিপরীতে পাঠ্যপুস্তকে নারীর ইতিবাচক, প্রগতিশীল ও আধুনিক ইমেজ তুলে ধরা।
রোবায়েত ফেরদৌস: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]