এস এ মান্নান (লাডু)

শহীদ বুদ্ধিজীবী, চাকরিজীবী, পশ্চিমবঙ্গ, পল্টন, ঢাকা

এস এ মান্নান (লাডু)

পাকিস্তান আমলে এ দেশের ক্রীড়াজগৎকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চেয়েছিলেন ক্রীড়াক্ষেত্রে সর্বজনপ্রিয় এস এ মান্নান (শেখ আবদুল মান্নান ওরফে লাডু ভাই)।

তখন বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হতো বলে তিনি প্রায়ই ক্ষোভে ফেটে পড়তেন। অকপটে সত্য কথা স্বাধীনভাবে বলে ফেলতে দ্বিধা করতেন না।

এ কারণে পাকিস্তানি, বিশেষত পাঞ্জাবিদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি।
মান্নানের পারিবারিক ডাকনাম লাডু।

তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতার পার্ক সার্কাসে।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের কয়েক বছর পর এ দেশে এসেছিলেন। এ দেশকে ভালোবেসে একাত্তরে জীবন উৎসর্গ করেছেন।

ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে (সঠিক তারিখ জানা যায়নি) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় দোসরেরা তাঁকে তাঁর পুরানা পল্টনের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এস এ মান্নান সম্পর্কে জানা যায় সাবেক প্রখ্যাত ফুটবল ও হকি খেলোয়াড় প্রতাপ শংকর হাজরার কাছ থেকে।

প্রতাপ শংকর বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ছিল লাডু ভাইয়ের আকর্ষণ। শুনেছি, পার্ক সার্কাস ময়দানে তিনি ফুটবল খেলতেন।

এ দেশে আসার পর তিনি আন্তরিকতা নিয়েই এ দেশের খেলাধুলার উন্নতি চাইতেন। কিন্তু পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে পাকিস্তানিদের অবহেলা আর উপেক্ষা ছিল প্রচণ্ড পীড়াদায়ক। এটা মুখ বুজে তিনি সহ্য করতেন না।

বিশেষ করে ফুটবলের স্বার্থরক্ষায় পাঞ্জাবি চক্রের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন মারমুখী। এ কারণেই হয়তো একাত্তরে পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যা করে। যদিও লাডু ভাই ছিলেন অজাতশত্রু একজন মানুষ। আমার জানামতে, বাঙালি কেউ তাঁর শত্রু ছিল না।

কিন্তু সরলপ্রাণ এই মানুষটি একসময় পাঞ্জাবিদের শত্রু হয়ে যান।’ (সাক্ষাৎকার ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।
এস এ মান্নান সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া যায় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর ‘আমার অগ্রজপ্রতিম’ রচনা থেকে। কামাল লোহানী লিখেছেন, ‘তিনি ছিলেন সবার প্রিয় “লাডু ভাই”।

দীর্ঘদেহী, প্রশান্ত, সৌম্যদর্শন। তাঁর চলার ভেতর ছিল গাম্ভীর্য, যা সকলকে শ্রদ্ধাবনত করে দিত।...

তিনি যখন ধীর পদক্ষেপে অফিসে ঢুকতেন, তখন সবাই সহকর্মী হিসেবে তাকিয়ে থাকতাম।

তিনি কখনো গম্ভীর হয়ে বসতেন। আবার কখনো প্রাণখোলা মিষ্টি হেসে কুশল বিনিময় করতেন। তারপর কাজ শুরু করতেন।
‘সাংবাদিক লাডু ভাই আর ক্রীড়া সংগঠক লাডু ভাই—এ দুইয়ে এমন সম্মিলন ঘটেছিল, এঁদের কোনো বিরোধ আমাদের চোখে পড়েনি।

সারাটা দিন কাটাতেন খেলার মাঠে অথবা ঘুরে, খেলা নিয়ে আলোচনা করে এবং দিন শেষে আসতেন চাকরিতে।

কারণ দৈনিক আজাদ-এ যখন ছিলেন, তখন নিয়মিতভাবে নৈশ পালার সাব এডিটর হিসেবে অনুবাদ করতেন।

আবার পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় যখন এলেন, তখন তো তিনি পুরোপুরি স্পোর্টস এডিটর। সুতরাং রাতেই তাঁর কাজ।


‘রাতের পালায় কাজ করতে ক্লান্তি এলে মাঝেমধ্যে রসিকতা করতেও ছাড়তেন না।...দারুণ রসবোধ ছিল তাঁর।’ (সূত্র: স্মৃতি: ১৯৭১, তৃতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯০, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

এস এ মান্নানের জন্ম ১৯২৮ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাসে। তাঁর বাবা ছিলেন কলকাতার পার্ক সার্কাস জামে মসজিদের ইমাম। তাঁরা ছিলেন চার ভাই ও তিন বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি বড়।

ছাত্রজীবনে ফুটবলসহ অন্যান্য খেলাধুলায় যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। ১৯৪৮ সালে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় দৈনিক আজাদ-এর সহসম্পাদক হিসেবে।

বাংলাদেশে আসার আগ পর্যন্ত আজাদ পত্রিকার কলকাতা অফিসে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫০ ও ’৫১ সালে ফুটবল লিগের দ্বিতীয় বিভাগে দৈনিক আজাদ-এর হয়ে খেলেছেন। জিমখানা ফুটবল লিগেও তিনি কিছুদিন খেলেছেন।

এ ছাড়া জিমখানা রেসকোর্সেও যুক্ত ছিলেন। দৈনিক আজাদ-এ দীর্ঘ ১৫ বছর কাজ করার পর পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় যোগ দেন।

একাত্তরে এখানেই কর্মরত ছিলেন।
এস এ মান্নান পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন, ফুটবল ফেডারেশন, অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, চ্যানেল ক্রসিং কমিটি, ক্রীড়া লেখক ক্লাব প্রভৃতি সংস্থার সদস্য ছিলেন।

ফুটবল ফেডারেশন ও ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে তাঁর বলিষ্ঠ সাংগঠনিক ভূমিকা ছিল। পাকিস্তান আমলে ক্রীড়াজগতের মানোন্নয়নের কথা চিন্তা ও নতুন কিছু করার তাগিদে খেলার খবর নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।

অবশ্য বেশি দিন এই পত্রিকা তিনি টিকিয়ে রাখতে পারেননি। অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
এস এ মান্নান অবিবাহিত ছিলেন।

প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (প্রথম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯১) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
[email protected]