১৯৬১ সালের সমতুল্য সংস্কার বাংলাদেশে হয়নি

এম. শাহ আলমের জন্ম ১৯৫১ সালে, মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে। ১৯৮২ সালে মস্কোর পেট্রিস লুমুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমুদ্রবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। বর্তমানে প্রেষণে আইন কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নারী বিষয়ে দেশি-বিদেশি জার্নালে তাঁর বেশ কিছু নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

এম. শাহ আলম
এম. শাহ আলম

প্রথম আলো : বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ ছিল, তখন ১৯৬১ সালে পারিবারিক আইনে বড় পরিবর্তন আনা হয়। এর সঙ্গে তুলনা করা চলে—স্বাধীন বাংলাদেশে এমন একটি বড় সংস্কারের নাম বলুন।

শাহ আলম : ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইনে যে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল, তার সঙ্গে তুলনা করা যায়—এমন কোনো বড় আইন হয়নি। তবে নারীর অধিকার সংরক্ষণ করে সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে আমরা অনেক রায় পেয়েছি। উত্তরাধিকার বিষয়ে তেমন রায় নেই। তবে অভিভাবকত্ব, হেফাজত, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, বহুবিবাহ সম্পর্কে রায় আছে। এসবকে আমরা যদি সংবিধিবদ্ধ রূপ দিতে পারতাম, তাহলে ’৬১-এর অগ্রগতির (বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত) সঙ্গে তুলনা করা যেত। তবে সুপ্রিম কোর্টের রায় তো একধরনের আইন। এসবকে কীভাবে লিখিত আইনে রূপ দেওয়া যায়, আইন কমিশন থেকে আমরা ২০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদনে সরকারকে তা বলেছি। কিন্তু সরকার এখনো ব্যবস্থা নেয়নি।

প্রথম আলো : কুয়েত, ওমান ও প্রতিবেশী মালদ্বীপের মতো দেশের বিধান পবিত্র কোরআন-সুন্নাহসম্মত—সে কথা আমরা তো অবশ্যই স্বীকার করব? তারাও সিডওর গুরুত্বপূর্ণ বিধান গ্রহণ করেছে।
শাহ আলম: নিশ্চয়ই। এটা অনস্বীকার্য।

প্রথম আলো : তাহলে বাংলাদেশ কেন বিশেষ করে, সিডওর (কনভেনশন অন দি এলিমিনেশন অব অল ফর্মস অব ডিসক্রিমিনেশন অ্যাগেইনস্ট উইমেন) দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ, যেখানে বিদ্যমান জাতীয় আইনে থাকা নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বাতিল করতে ও সব আইনে তার সম–অধিকারকে সুরক্ষা দিতে বলেছে, সে সম্পর্কে আপত্তি জানিয়েছে। বহু মুসলিম দেশ যা করেনি, তা কেন করেছে বাংলাদেশ? তা ছাড়া বাহাত্তরের সংবিধান তো সিডওতে প্রদত্ত ওই একই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।

শাহ আলম : আমি বলব এটা অজ্ঞতাপ্রসূত। আমরা তাই রিপোর্টে সুপারিশ করেছি যে অন্তত সৌদি আরব ও পাকিস্তান যেভাবে অবস্থান নিয়েছে, আমরা যেন সেভাবে নিই। ১৯৮৪ সালে যখন ওই আপত্তিসহ বাংলাদেশ সিডও সই করল, তখন জার্মানি, বেলজিয়াম, সুইডেন ও নেদারল্যান্ডস বলেছিল, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ সম্পর্কে এ রকম আপত্তিকারী দেশের চুক্তি সইয়ের অধিকার নেই। 

প্রথম আলো : সামরিক শাসনে নেওয়া ওই অবস্থান আজও বদলে গেল না।

শাহ আলম : ঠিক। সিডওর চারটি বিষয়ে আপত্তি দেওয়া হয়েছিল। দুটি তুলে নেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ দুটিই বাকি। 

প্রথম আলো : তার মানে কি প্রকারান্তরে এই দাঁড়াল না যে সংসদ এবং আদালতও সিডওতে রাষ্ট্রের আপত্তিকে ঠিক মনে করছেন?

শাহ আলম : না। তঁারা তা মনে করছেন বলা যাবে না।

প্রথম আলো : সেটা এই অর্থে বলা যে বাহাত্তরের সংবিধানে নারীর যে সম-অধিকার নিশ্চিত করেছে, সেটা সিডওর ওই বিধানের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করে না। তাহলে?

শাহ আলম : হ্যাঁ। সেভাবে দেখলে তা-ই দাঁড়ায়। আইন কমিশন যত সুপারিশ করেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পুত্রের অবর্তমানে কন্যাসন্তানের অংশ বৃদ্ধি এবং সিডওর উল্লিখিত আপত্তি প্রত্যাহার করার বিষয়। এই দুটি বিষয়েই আমাদের অভিমত উত্তম গবেষণাপ্রসূত। আমি মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া—সব ধরনেরদৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছি যে ওটা প্রত্যাহার করলে কোনো ধরনের লঙ্ঘন ঘটে না।

প্রথম আলো : সিডওতে রাখা রাষ্ট্রের আপত্তি নারীর সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক মানবাধিকারকে আঘাত করে। আর তাই সেটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত হানছে?

শাহ আলম : আমি সম্পূর্ণ একমত। অবশ্যই সিডওর আপত্তিটা বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিরুদ্ধ। 

দেখুন, সিডও বলুন আর কন্যাসন্তানের সম্পদ বৃদ্ধি বলুন, কোথাও পবিত্র ধর্মের বিধানাবলির লঙ্ঘন নেই। তার পরও আপত্তিটা টিকে আছে। দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আমার আর কিছু বলার নেই। আমিও অবাক হচ্ছি। জনস্বার্থে এত মামলা হলো। এটা কেন হলো না? এটা অবিলম্বে চ্যালেঞ্জ হতে দেখলে আমি খুশি হব। 

প্রথম আলো : বিশ্ব বাংলাদেশের কিছু শীর্ষ রাজনৈতিক পদে নারী দেখছে। অথচ সেই নেতৃত্বও নারীর অধিকারের ক্ষেত্র বৃদ্ধিতে হাত দিচ্ছে না। এর উত্তরণ কীভাবে?

শাহ আলম : আসলে সামাজিক শক্তির বিকাশের দরকার আছে। সরকারগুলো ভয় পায়, মৌলবাদীরা আবার ইস্যু করে কি না।

প্রথম আলো : এই ভয় কতটা প্রকৃত? রাজনীতিতে তারা যে আপস করে, তা থেকে হয়তো এটাও বিচ্ছিন্ন নয়।

শাহ আলম : আমি সেদিনও একজন মন্ত্রীকে বললাম যে আপনারা খামোখা ভয় পাচ্ছেন। তাদের বোঝাতে হবে যে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো পবিত্র ধর্মীয় বিধানের কোনো ব্যত্যয় নয়। এ জন্য জনমত তৈরিতে হাত দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের মাধ্যমে আইন কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে কন্যাসন্তানদের সম্পদের আইনটা কীভাবে কী করা যায়।

প্রথম আলো : আপনার সুপারিশ কী ছিল?

শাহ আলম : আমি এ বিষয়ে খুবই গভীর ও ব্যাপক গবেষণা করে প্রতিবেদন দিয়েছিলাম। নিয়ম হলো পিতার সম্পত্তি ছেলেমেয়েদের মধ্যে তো ভাগ হয়, অন্যরাও কিছু পায়। মূল ভাগ সন্তানদের। কন্যা যা পায়, পুত্র তার দ্বিগুণ পায়। যদি কারও পুত্র না থাকে, কেবল কন্যা থাকে, তাহলে পুত্রের অংশটা কন্যা কিছু পায়, বাকি বেশির ভাগই অন্যদের কাছে চলে যায়। আমাদের প্রস্তাব ছিল, পুত্র-কন্যার সম্মিলিত যে অংশটা, যদি পুত্র না থাকে তাহলে তার পুরোটাই কন্যা পাবে, অন্যরা পাবে না। যুক্তি হলো, অন্য যারা, তাদের ভাগ তো থাকছেই। কন্যাসন্তানকে এ রকমভাবে হিস্যা দেওয়া অনেক মুসলিম দেশ আইন করে করেছে।

ওই সময়ে মন্ত্রীর পরামর্শে আমি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) মহাপরিচালক শামীম আফজালসহ বেশ কয়েকজন মুফতি ও মুসলিম আইনবিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করি। তাঁরা মত দিলেন, এটা করা যাবে না। এটা সংবেদনশীল বিষয়।

প্রথম আলো : ইফা মহাপরিচালক একজন কর্মরত জেলা জজ। তিনিও বিরোধিতা করেছিলেন?

শাহ আলম : হ্যাঁ। তিনি বিরোধিতাকারী মুফতিদের সঙ্গে একমত হলেন। তাঁরা বললেন, মুসলিম আইনে হাত দেওয়া যাবে না। অথচ বহু মুসলিম ও ইসলামি রাষ্ট্রে ওই নিয়ম চালু আছে।

নারী অধিকার বিষয়ে আমার সবচেয়ে পছন্দের প্রতিবেদন দুটি। একটি সিডওর ওই আপত্তি তুলে নেওয়া, অন্যটি প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে কন্যাসন্তানের ক্ষমতায়ন-সংক্রান্ত ওই প্রস্তাবটি দেওয়া। আইন কমিশনের অন্য আরও বহু প্রতিবেদনের মতো এ সম্পর্কেও আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং উইং কঠিন নীরবতা পালন করছে। তারা আমাদের অনেক প্রতিবেদনের খাম খুলে দেখেন কি না, সন্দেহ।

প্রথম আলো : সরকার একটি নারী উন্নয়ন নীতিমালা করতেই আমরা বিতর্ক দেখেছিলাম। অথচ সেটি আইন ছিল না, আদালতের মাধ্যমে প্রয়োগযোগ্যও ছিল না। তাহলে এ রকম উদ্যোগ কেন? রাজনৈতিক সুবিধাবাদ?

শাহ আলম : আমি তা বলব না। সরকার হয়তো দ্বিধান্বিত, একটু সময় নিচ্ছে। প্রতিক্রিয়া হবে বলে ভয় পাচ্ছে। কারণ, মৌলবাদীরা ভুল বোঝায়, একটা ভাবাবেগের বিষয়ও জড়িত। তারা বলবে, এই দেখো আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের ধর্মীয় আইন বদলে দিচ্ছে। অবশ্য তারা ’৬১ সালেও বলেছিল। বাংলাদেশ তো এখন একটা অনিশ্চিত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জামায়াত ও হেফাজতিরা যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছে। তাই আমি মনে করি, সরকার যখন এটা পারবে, তখনই হয়তো তারা করবে।

প্রথম আলো : নারীবিষয়ক আইনকানুন উন্নয়নে গত ছয় বছরের অগ্রগতির যদি একটা সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করেন?

শাহ আলম : নারীর অধিকারের উন্নয়নটা মূলত এনজিও, মিডিয়া, নাগরিক সমাজ ও কর্মজীবীদের হাত ধরে এসেছে। বিভিন্নভাবে সচেতনতার প্রসার ঘটেছে। আমরা কমিশন থেকে মুসলিম আইনের তিনটি, হিন্দু ও খ্রিষ্টান আইনে দুটি পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছি। কিন্তু কোনোটিরই বাস্তবায়ন নেই। কিছু ক্ষেত্রে নতুন নিয়মরীতি ও বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তথ্য অধিকার আইনও সুফল দিচ্ছে। যৌন হয়রানি বন্ধে আইন না হলেও সুপ্রিম কোর্ট ও মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়েছে। নীতিমালারও একটা ভালো প্রভাব রয়েছে। সুতরাং
নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনের দিকে একেবারেই কিছু ঘটেনি সেটা সঠিক নয়।

প্রথম আলো : নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নের জায়গায় মৌলিক পরিবর্তন এসেছে কি না?

শাহ আলম : তেমনটা আসেনি।

প্রথম আলো : বিষয়টি গণতন্ত্রায়ণের সঙ্গেও জড়িত। অনেক দেশ সংসদে বিপুলসংখ্যক নারী এনে উন্নতি করেছে। অথচ সংরক্ষিত আসন থেকে আমরা নারীকে মুক্তি দিতে চাই না।

শাহ আলম : গণতন্ত্রায়ণের সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের সম্পর্ক অবশ্যই আছে। এ প্রসঙ্গে তাহলে আপনাকে একটি মৌলিক কথা বলি, বাহাত্তরের সংবিধানে ১০ বছরের জন্য ১৫টি নারী আসন দেওয়া হয়েছিল। পরে এটা সংশোধন করে ক্রমাগত বাড়ানো (২০১১ সালে ৪৫ থেকে ৫০-এ উন্নীত) হয়েছে। এটা মূল সংবিধানের লঙ্ঘন।

প্রথম আলো : বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে আমরা একমত যে এটা সংশোধন করে সময় বাড়িয়ে নিতে সংসদের এখতিয়ার নেই।

শাহ আলম : তিনি এটা সব সময় বলেন এবং আমি তাঁর সঙ্গে একমত। এ ব্যবস্থা থাকা উচিত নয়। নারীদের নির্বাচিত হতে দিতে হবে, তাহলেই নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন ঘটবে। বর্তমান আইনে শুধু দলের সর্বস্তরের কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নারীকে স্থান দেওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু আইন করতে হবে, প্রত্যেক দল যাতে নির্দিষ্ট একটি অংশের আসনে নারীকে মনোনয়ন দিতে বাধ্য হয়।

প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।

শাহ আলম : ধন্যবাদ।