বিএনপি নেতাদের প্রতি খোলা চিঠি

এই হরতাল িক আদৌ হরতাল?
এই হরতাল িক আদৌ হরতাল?

মাননীয় নেতারা, সালাম নেবেন। আশা করি, ভালো আছেন। তবে খুব একটা ভালো আছেন কি না, এ প্রশ্ন বোধ হয় বাহুল্য। আমরাও খুব একটা ভালো নেই।
আমাদের ভালো না থাকার কারণ হলো, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার বোধ। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে বলে প্রস্তুত হয়েছিল, তারা এখন ফুটবলের মতো গড়াচ্ছে, আর হরতাল-কর্মসূচির লাথি খেয়ে পরীক্ষার তারিখ পেছাচ্ছে একের পর এক। নতুন তারিখ পড়ছে, সেই তারিখে পরীক্ষা হবে কি না, তা কেউ জানে না। আমরা কেউ জানি না, ঘর থেকে বের হলে নিরাপদে ফিরে আসতে পারব কি না। কোথায় কখন কার ওপরে পড়বে পেট্রলবোমা, হাতবোমা, ককটেল, কে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, কে দগ্ধ হয়ে যাবে হাসপাতালে, কারও জানা নেই।
আপনারা কি মনে করেন, অবরোধ ও হরতালের যে কর্মসূচি আপনারা দিয়ে যাচ্ছেন, তা সফলভাবে পালিত হচ্ছে? আপনারা খুব ভালো করে জানেন, জনগণ হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি অমান্য করছে। এটা তারা করছে নিজের গরজে, নিজের প্রয়োজনে। ঢাকা শহরে হরতালে দিনে প্রচণ্ড যানজট। সব অফিস-আদালত চলছে, সব দোকানপাট খোলা, গাড়ির চাকা ঘুরছে, কারখানার চাকা ঘুরছে, দোকানপাট খোলা। মাননীয় নেতারা, কাকে বলে হরতাল? হরতাল পালিত হচ্ছে না, কিন্তু আপনারা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস হরতাল দিয়ে যাচ্ছেন। কেন দিচ্ছেন, আপনারাই জানেন। আমাদের ধারণা, শুধু মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জিম্মি করে রেখে দাবি আদায়ের জন্য। সন্ত্রাসবাদীরা যেমন মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায় করার চেষ্টা করে, আপনারাও তেমনি মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জিম্মি করতে সক্ষম হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি দেওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুতেই হরতাল সফল হয়নি। আজ যাঁরা রাস্তায় বেরিয়েছেন, কাজে-কর্মে যাচ্ছেন, বাসের নিরীহ যাত্রী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বিএনপির ভোটারও আছেন, আওয়ামী লীগের ভোটারও আছেন। যাঁরা পুড়ে যাচ্ছেন, তাঁদের ভেতরেও বিএনপির ভোটার আছেন, আওয়ামী লীগের ভোটার আছেন।
আর অবরোধ? আপনাদের কাছ থেকে কি আমরা ব্যাখ্যা পেতে পারি, ‘অবরোধ’ কর্মসূচিটা কী? মাননীয় নেতারা, তিন জোটের ব্যানারে আপনারা আশির দশকে ও নব্বই সালে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, এর পরেও এই দেশে আন্দোলন হয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও হয়েছে, তাতেও ‘অবরোধ’ কর্মসূচি দেওয়া হতো, তাকে বলা হতো, রাজপথ-রেলপথ-নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি। সেই কর্মসূচির আগে বিভিন্ন স্পট নির্ধারণ করে দেওয়া হতো—এসব জায়গায় নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা জড়ো হবেন, তাঁরা সেই জায়গাগুলোয় বসে পড়বেন, সেটাই অবরোধ। কোন কোন স্পটে কোন কোন নেতারা থাকবেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কোন কোন শাখা থাকবে, তা-ও বলে দেওয়া হতো। আর এখনকার অবরোধ কী রকম? মানুষ তার প্রয়োজনে বের হয়, গাড়িঘোড়া চলে, কিন্তু অবরোধ যে জারি আছে, তা প্রমাণ করার জন্য পেট্রলবোমা ছোড়া হয়। আহা রে, কত কত মানুষ মারা গেল সেই পেট্রলবোমায়। সাধারণ মানুষ। ক্লাস টেনে পড়া মাইশা। চার বছরের শিশু। নারী-শিশুসহ নিরীহ মানুষ। যাদের কোনো অপরাধ নেই। রাজনীতির সঙ্গে যাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তাহলে বলুন, অবরোধ মানে কী? সবকিছু চলছে, হয়তো সংখ্যায় কম, আর মাঝেমধ্যে পেট্রলবোমা মারা, তার নাম অবরোধ? আপনাদের কাছে জানতে চাইতে পারি কি, আপনারা, মাননীয় নেতারা কখন কোথায় অবরোধ করতে গিয়েছিলেন? নিজেরা কোনো কষ্ট করবেন না, নিজেরা কোথাও গিয়ে বসবেন না, দাঁড়াবেন না, শুধু একটা রহস্যময় কর্মসূচি দিয়ে ১৬ কোটি মানুষকে দিনের পর দিন অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দেবেন?
আমরা বলছি না যে আপনাদের দাবি-দাওয়া ন্যায্য নয়। আমরা বলছি না, আপনারা আন্দোলন করবেন না। আমরা বলছি না, আন্দোলন দমনে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো গণতান্ত্রিক। আমরা বলছি না, সরকারের অগণতান্ত্রিক আচার-আচরণ পদক্ষেপের প্রতিবাদ করবেন না। কিন্তু আমরা বলতে চাইছি, এই অবরোধ কি আদৌ অবরোধ? এই হরতাল কি আদৌ হরতাল? একেই কি বলে হরতাল, যেখানে যানজটে ঢাকার রাস্তায় নাগরিকেরা নাকাল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি নিয়ে আমরা গৌরব করতাম, বলতাম, পৃথিবীকে আমরা একটা নতুন ধারণা ও মডেল উপহার দিতে পেরেছি, যা বিভিন্ন দেশে অনুসৃত হতে পারে। মাননীয় আদালত সেটাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করলেও পরবর্তী দুই মেয়াদে এই পদ্ধতি রাখার সুযোগ রেখেছিলেন। সেটা থাকল না, সংসদ সেই পদ্ধতি তুলে দিল। আপনারা প্রতিবাদ করলেন, আপত্তি করলেন। তখন থেকেই শুরু আপনাদের আন্দোলন। বছরের পর বছর সেই আন্দোলন চলেছে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে আন্দোলন তীব্র করে তুললেন। কিন্তু আপনাদের আন্দোলনে আমরা মানুষের সমাবেশ দেখলাম না, দেখলাম পেট্রলবোমার ভয়াবহ নৃশংসতা। সেই সহিংসতা যত বাড়তে লাগল, জনগণের অংশগ্রহণ তত কমতে লাগল। রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে রাখায় রেলদুর্ঘটনায় মানুষ মারা পড়ল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের শতাধিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় আগুন দেওয়া হলো, প্রতিষ্ঠানগুলোর অপরাধ, তারা চিরদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলেও কেন এক দিনের জন্য ভোটকেন্দ্র। সেই আন্দোলন দিয়ে আপনারা নির্বাচন ঠেকাতে পারলেন না। একতরফা নির্বাচন, বিতর্কিত নির্বাচন, কিন্তু নির্বাচন। তার আগে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়াকে টেলিফোন করেছিলেন। বেগম জিয়ার দেওয়া আলটিমেটামের সময় পেরিয়ে যাওয়ার আগেই আলোচনার দাওয়াত দিয়ে হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আপনারা হরতাল প্রত্যাহার করেননি। নির্বাচনে যাননি। কিন্তু গণ-আন্দোলনও কি আপনারা করতে পেরেছিলেন? আপনাদের আন্দোলন কি সফলতার মুখ দেখেছিল?
আজকের দিনে কি সহিংস পদ্ধতিতে পৃথিবীর কোথাও কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব? ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ১৯২২ সালে তা সহিংস রূপ পরিগ্রহ করে, উত্তর প্রদেশের চৌরি চৌরা এলাকায় জনতা পুলিশ ব্যারাকে আগুন দিলে ২৩ জন পুলিশ সদস্য মারা যান, মহাত্মা গান্ধী তখন ওই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন, কারণ, তাঁর নীতি হলো অহিংসা, হিংসার দ্বারা তিনি দাবি আদায় করতে চান না। আপনাদের আন্দোলনেও জনগণের অংশগ্রহণ নেই। আছে শুধু সন্ত্রাস। এই বোমাবাজি সন্ত্রাস অগ্নিসংযোগ আপনারা করেন না, আপনাদের এই দাবি যদি সত্য বলে ধরে নিই, তাহলেও আপনাদের কর্তব্য হবে, এই হরতাল ও অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া, কারণ এতে সন্ত্রাসের উপাদান ভয়াবহভাবে যুক্ত হয়েছে। একজন মানুষের প্রাণের বিনিময়েও কোনো দাবি আদায় করা ন্যায্য নয়।
আপনারা বলতে পারেন যে সরকার আন্দোলন করতে দেয় না, মিছিল করতে দেয় না, সভা করতে দেয় না, গ্রেপ্তার করে, গুলি করে; আর তো কোনো উপায় নেই। আপনারা আমাদের চেয়ে বাংলাদেশের ও অন্যান্য দেশের আন্দোলনের ইতিহাস ঢের ভালো জানেন। উপায় একটাই, আর তা হলো ধৈর্য ধারণ করা। আন্দোলনকে ধীরে ধীরে তীব্র করে তুলে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়া। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশজুড়ে দাবানলের মতো যে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল, ১৯৫২ সালের এপ্রিলেই সেই আন্দোলনে ভাটা নেমে এসেছিল। হাজার হাজার নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার। কিন্তু তার ফল ফলেছিল ১৯৫৪-এর নির্বাচনে। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন, তাঁকে বিদায় করতে ১১ বছর লেগেছিল। ১৯৮২ সালে এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেন, ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রসমাজ রাজপথে তুমুল আন্দোলন করে, রক্ত দেয়। কিন্তু এরশাদকে গদিচ্যুত করতে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগেছিল। ১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাস। ১০ নভেম্বরে তিন জোটের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ছিল, আজকের মতোই এরশাদ সরকার রেল-সড়ক-নৌপথ বন্ধ করে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে পড়েছিল, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান বুকে-পিঠে লিখে নূর হোসেন পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন। ওই নভেম্বরেও পুরো মাস হরতাল ছিল, এরশাদ সরকার দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, কিন্তু তার পতন হয়নি। পতন হয়েছিল নব্বইয়ে, যখন কারফিউ ভেঙে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল।
এখন ঢাকা শহরে দেড় কোটি থেকে দুই কোটি মানুষ। ১০০ জন মানুষও কেন নেমে আসে না রাজপথে? আপনারা কি দয়া করে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখবেন, আপনাদের এই আন্দোলনের সমস্যাটা কোথায়? কেন মানুষ রাস্তায় একযোগে বেরিয়ে আসছে না?
আর আঘাত ও কষ্ট নিজেরা বুক পেতে নিন। জনগণকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন? মহাত্মা গান্ধী দিনের পর দিন অনশন করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী দিনের পর দিন অনশন করেছেন। আপনাদের একজন নেতা এক বেলাও যদি প্রেসক্লাবের সামনে বসে না খেয়ে থাকতেন, তা-ও তো বুঝতাম, আপনারা আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছেন। নিজেরা কোনো কিছু ত্যাগ করবেন না, জনগণকে আজ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে জিম্মি করে রেখেছেন। এর নাম মানুষের মুক্তির আন্দোলন?
আবারও বলছি, আপনাদের দাবি-দাওয়ার ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন এখানে আমরা তুলছি না। কিন্তু আন্দোলনের পদ্ধতি নিয়ে আমাদের ঘোরতর প্রশ্ন আছে। এভাবে আন্দোলন সফল করা যাবে না। কিন্তু দেশের মানুষ সীমাহীন কষ্ট পাচ্ছে। প্রধানত সেই কষ্ট অনিশ্চয়তার, নিরাপত্তাহীনতার বোধের। কৃষকেরা শাকসবজি রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন, দুগ্ধ খামারিরা রাস্তায় দুধ ঢেলে দিয়েছেন, পরিবহন খাত পথে বসেছে, সেসব তো আছেই। মানুষ মারা যাচ্ছে। নারী ও শিশুরা মারা যাচ্ছে। এ জন্য যদি সরকারও দায়ী হয়, তবু আপনাদের, বিএনপি নেতাদের উচিত, এই আন্দোলন থেকে সাময়িকভাবে ফিরে আসা এবং নতুন করে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি গ্রহণ করা। যেমনটা করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী, আন্দোলন সংহিস হয়ে যাওয়ায় একতরফাভাবে নিজের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
আমরা বিশ্বাস করি, আপনাদের রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য, মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেদের কর্মসূচি পুনর্বিবেচনা করুন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।