শান্তি-সম্প্রীতির সপক্ষে মতৈক্য

ধর্ম
ধর্ম

মানবতার ঐক্য ও সংহতি জাতির অন্তর্নিহিত শক্তি বৃদ্ধি করে, ইমানি চেতনা ও মনোবলকে সুদৃঢ় করে। দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য, মৈত্রী, সামাজিক সংহতি ও শান্তি-সম্প্রীতি যে অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং মানবজাতির একান্ত কাম্য, এতে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দলমত-নির্বিশেষে সবাই মতৈক্য প্রকাশ করে। ইসলাম মানুষকে জাতীয় ঐক্য, সংহতি, দেশাত্মবোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধ শিক্ষা দান করে, আর দেশপ্রেমের মাধ্যমে এ সামাজিক সংহতি টিকে আছে। দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় জাতির ঐক্য ও সংহতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানবতার মতৈক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো, তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে।’ (সূরা আেল ইমরান, আয়াত: ১০৩)
জগতের কোথাও এমন কোনো ধর্মপরায়ণ লোক নেই যে সন্ত্রাস-সহিংসতা, নাশকতা-বর্বরতা, হানাহানি-উগ্রতা, পেট্রলবোমাবাজি, আত্মঘাতী হামলা, দ্বন্দ্ব-কলহ, সংঘাত-সংঘর্ষ, ঝগড়া-বিবাদ, যুদ্ধবিগ্রহ ও হত্যাযজ্ঞকে উপকারী বা উত্তম মনে করে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে মানবতার ঐক্য, সামাজিক সংহতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম-কর্ম ভুলে বিপথগামী লোকেরা বিভিন্ন দলমত, উপদল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ, সংঘাত-সংঘর্ষ, অন্তঃকোন্দল সৃষ্টি করার এমন নৈরাজ্যময় ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ অব্যাহত রয়েছে, যাতে মানুষের পারস্পরিক ঐক্য, সামাজিক সংহতি ও শান্তি-সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে চলেছে। এহেন মতবিরোধ, বিভেদ-বিভক্তি, তিক্ততা-রেষারেষি, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-ঘৃণা প্রভৃতি দূরীভূত
করে সামাজিক জীবনে সুসম্পর্ক ও সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা ও সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। কেননা, পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, তাহলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’ (সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৬)
মানুষের সামাজিক সুসম্পর্ক ও দেশে শান্তি-সম্প্রীতি স্থাপনের অনিবার্য ফলস্বরূপ নাগরিকেরা পরস্পর ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত হতে পারে। পরমতসহিষ্ণুতার অতুলনীয় শিক্ষা ও নীতি-আদর্শ থেকে দূরে সরে থাকলে মানুষের জাতীয় ও দলগত জীবনে যেমন বিপর্যয় নেমে আসে, তেমনি ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনও সুখকর হয় না। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন নিজের ক্ষমতা, শক্তি, সামর্থ্য ও স্বার্থপরতার দম্ভ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে, তখন সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দলমতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, ভাববিনিময় ও যোগাযোগ স্থাপন করা কঠিন হয়ে পড়ে। মুসলমানরা অভিন্ন সংস্কৃতি এবং একটি মহান ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব, তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজ করতে নিষেধ করবে।’ (সূরা আেল ইমরান, আয়াত: ১১০)
কোনো দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর যদি সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি, নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ না ঘটে, তাহলে সে দেশের স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে ওঠে না। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা, সংলাপ-সমঝোতা, সহযোগিতা ও সহানুভূতিশীলতাপূর্ণ সামাজিক সম্প্রীতি ছাড়া মানুষ নিরাপদে চলতে পারে না। মানুষের একের প্রতি অন্যের বিশেষ অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। এসব নাগরিক অধিকার ও কর্তব্যবোধ ধর্মভীরু মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে, ফলে সামাজিক ঐক্য-সংহতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই, সুতরাং তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করবে আর আল্লাহকে ভয় করবে, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১০)
মানবজীবনে জাতীয় মতৈক্য ও সংহতি স্থাপনের জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সংলাপ, পরমতসহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা ও সামাজিক সুসম্পর্ক। সুতরাং উম্মতে মোহাম্মদি পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। এক ধর্মাবলম্বী গোত্র অন্য গোত্রের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার বা অসৌজন্যমূলক আচরণ করবে না, কোনো রকম সহিংসতা বা উগ্রতা প্রদর্শন করবে না, এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ বা বোমা হামলা করবে না। মূলত বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সামাজিক সংহতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যভাব প্রকাশ করতে সংঘবদ্ধ প্রয়াস এবং মানবতার ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় ক্রান্তিকালীন মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জাতীয় ঐক্য ও সামাজিক সংহতি। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা সহকারে একতাবদ্ধ থাকার সপক্ষে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘একজন মুমিন অপর মুমিনের জন্য অট্টালিকাস্বরূপ, যার এক অংশ অন্য অংশকে সুদৃঢ় করে রাখে এবং তিনি আঙুলগুলো একত্রে মিলিত করলেন।’ (বুখারি)
আবহমানকাল থেকে সব ধর্ম ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন চির শান্তি ও সম্প্রীতির এ দেশের মানুষ দলবদ্ধভাবে সামাজিক সংহতি, পরমতসহিষ্ণুতা ও ধর্মীয় সহনশীলতার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান করছে। শান্তিকামী দেশবাসীর প্রত্যাশা সহিংসতা-হানাহানি ও দমন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে নয়, পারস্পরিক গঠনমূলক আলাপ-আলোচনা ও শান্তিপূর্ণ সমঝোতার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান ও মীমাংসা করতে হবে। তাহলেই দেশের সার্বিক উন্নয়ন-অগ্রগতি ও কল্যাণ-সমৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ফলে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিক থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে জাতীয় মতৈক্য ও পারস্পরিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বিবদমান দলমতের পারস্পরিক সমঝোতা, উদারতা ও সহযোগিতার মনোভাব বজায় রাখলে সমাজের বিভিন্ন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন সহজতর হতে পারে। এমনিভাবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য মানুষে মানুষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, জাতীয় মতৈক্য ও সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠায় সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে শান্তির ধর্ম ইসলামের মর্মবাণীর যথাযথ বাস্তবায়ন হোক আমাদের ধর্মপ্রাণ জাতির অন্তর্নিহিত শক্তি!
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]