'আগামী দিনে আরও বড় সাফল্য আসবে'

ডিএফআইডির স্থায়ী সচিব মার্ক লুকক
ডিএফআইডির স্থায়ী সচিব মার্ক লুকক

গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের উন্নয়ন সংস্থা ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ডিএফআইডি) স্থায়ী সচিব মার্ক লুকক দুই দিনের সফর শেষে বলেন, বাংলাদেশ তার সম্ভাবনার সবগুলো দ্বার উন্মোচন করতে পারলে বর্তমান গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০-১১ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে। মধ্যম আয়ের দেশে যেতে হলে এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করা দরকার। এ জন্য সামনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। তিনি জানান, কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে চলেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে। দারিদ্র্যহার হ্রাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিশু ও মাতৃমৃত্যুহার হ্রাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে লক্ষণীয় সাফল্য লাভের উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে ডিএফআইডি সব সময় বাংলাদেশের উন্নয়ন–সহযোগী হিসেবে অবদান রাখছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।
ডেইলি অবজারভার-এর সহযোগী সম্পাদক সৈয়দ বদরুল আহসান, দ্য ডেইলি স্টার-এর বিজনেস এডিটর অরুণ দেবনাথ ও প্রথম আলো থেকে আমি লুককের সঙ্গে কথা বলি। বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, উন্নয়নের বাধাগুলো দূর করতে হবে। নীতি, অর্থনৈতিক পরিচালন (গভর্নেন্স) ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে। কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিশেষভাবে নারীদের মৌলিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ডিএফআইডি এসব ক্ষেত্রে কাজ করছে। মেয়েদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ইউসেপকে তারা সহযোগিতা দেয়। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের শিকার। ডিএফআইডি এই ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়তা দিচ্ছে। দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশের বিপুল প্রাণশক্তির প্রশংসা করে লুকক বলেন, এ বছরের শেষদিকে প্যারিসে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের উদ্যম ও উদ্যোগ গুরুত্ব পাবে।
এর আগে ২০১১ সালে লুকক ঢাকা সফরে এসেছিলেন। এখন চার বছর পর কী পরিবর্তন তাঁর চোখে পড়ছে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডারের মজুত অনেক বেড়েছে। এখন সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে দেশটি। এটা বড় সাফল্য। তবে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত কম। এ ক্ষেত্রে অনেক কিছু করার আছে। আইএমএফ নতুন ভ্যাট আইনের কথা বলেছে। এগুলো ভাবতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (বাংলাদেশ ব্যাংক) আওতায় ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) প্রতিষ্ঠায় ডিএফআইডি সহায়তা দিয়েছে। ব্যাংকঋণ-সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য এখন মুহূর্তের মধ্যে পাওয়া যায়। কে খেলাপি, কার কোন ব্যাংকে কত টাকা ঋণ—এসব তথ্য আগে সহজে বের করা যেত না। এখন সিআইবির কল্যাণে অনলাইনে সব তথ্য হাতের মুঠোয়। এর ফলে আর্থিক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ কাঠামো শক্তিশালী হয়েছে। শুধু অর্থনীতি কেন, এখন যে সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে যাচ্ছে বা আগামী দিনে যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, তখন প্রার্থীদের ঋণ খেলাপ-সম্পর্কিত তথ্য নির্বাচন কমিশনকে চট করে দেওয়া সম্ভব হবে। ডিএফআইডির সহায়তা অর্থনীতি ও রাজনীতি, দুই ক্ষেত্রেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনে ভূমিকা রাখছে।
লুকক এমন এক অস্থির সময়ে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন, যখন অবরোধ-হরতাল চলছে। তিনি বলেন, উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজনীতি একটি বড় বিষয়। বাংলাদেশ তার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে। কারণ, বাংলাদেশের সামনে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাই তাকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেবে। সরকারকে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে হবে। পোশাকশিল্প খাত, ওষুধশিল্প, রাসায়নিক দ্রব্যসামগ্রী প্রভৃতি বাংলাদেশের জন্য খুব সম্ভাবনাময় খাত বলে তিনি উল্লেখ করেন।
২০২১ সালে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরের জন্য সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, বাজেটশৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন, শুল্কহার যুক্তিসিদ্ধ করা, অবকাঠামো উন্নয়ন প্রভৃতি নিশ্চিত করার ওপর লুকক গুরুত্ব আরোপ করেন।
আমরা জিজ্ঞেস করি, আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে কী করা দরকার? তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের জন্য যুক্তিসংগত মুনাফা চায় এবং সেই মুনাফা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের কাছে নেওয়ার সুযোগ চায়। এগুলো নিশ্চিত করতে হবে। আর তা ছাড়া বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ, উপযুক্ত অবকাঠামো, আইন, সুযোগ-সুবিধা তো লাগবেই। আমি বলি, সরকার তো আইন যথেষ্ট করেছে। কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়নই কি বড় সমস্যা?
আসলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে আনতে পারলে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে। এদিকে জোর দেওয়া প্রয়োজন।
লুকক একটি দিকের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনে গার্লস সামিটে গিয়ে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা বলে এসেছেন। তিনি এর প্রশংসা করেন। ডিএফআইডি মেয়েদের শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। ব্র্যাকের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য। লুকক বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা একটি বড় সম্পদ। মানুষ কঠোর পরিশ্রমী। এদের পেছনে ব্যয় করলে এরাই দেশের জন্য হবে মূল্যবান মানবসম্পদ।
আলোচনা শেষ প্রান্তে। আমাদের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে, আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে লুকক বলেন, বাংলাদেশের আছে সুসংগঠিত নাগরিক সমাজ। সক্রিয় গণমাধ্যম। বিপুল সম্ভাবনা। অন্তর্নিহিত এসব শক্তি-সম্ভাবনা নিয়ে আগামী দিনে আরও বড় সাফল্য দেখার আশায় আমরা রয়েছি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
[email protected]