পিঁপড়া ও গুহাবাসীর কথা

বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা করছেন প্রাণিজগৎ নিয়ে। এমনকি পিঁপড়ার মতো ক্ষুদ্র প্রাণী নিয়েও। আমরা জানি, পিঁপড়া পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান প্রাণী। দল বেঁধে কাজ করার সামর্থ্যের জন্য পিঁপড়ার সুখ্যাতি আছে। সম্প্রদায়ের কল্যাণের বিষয়টি তারা বিশেষভাবে বিবেচনা করে বলে শুনে এসেছি। কিন্তু ব্রিটেনের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, পিঁপড়া স্বার্থপর এবং তাদের আবাসস্থল মূলত চাতুর্যপূর্ণ ও দুর্নীতিপরায়ণ আচরণের লীলাক্ষেত্র। আর এই অভিযোগের বেশির ভাগ তিরই তাদের শাসকপিঁপড়া তথা পুরুষ পিঁপড়ার দিকে। পিঁপড়াও অধিকাংশ মানবসমাজের মতোই পুরুষতান্ত্রিক।
গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিছু কিছু পুরুষ পিঁপড়া তাদের সন্তানসন্ততি যাতে পুনরুৎপাদনশীল রানি হতে পারে, তা নিশ্চিত করতে বেছে বেছে সে রকম জিন বের করে দেয়। পাতা কাটে এমন পিঁপড়াদের পাঁচটি আবাসস্থানের ডিএনএ নমুনা নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা এ তথ্য পেয়েছেন। তাঁরা বলছেন, একটি লার্ভা রানি হবে কি না, তা নির্ভর করে এটির পিতা কে ছিল।
এতকাল বিজ্ঞানীরা পিঁপড়া প্রজাতিকে ‘গণতন্ত্র ও সামাজিক সহযোগিতার মডেল’ হিসেবে দেখতেন। এখন তাঁরা বলছেন, পিঁপড়ারা বাঙালিদের মতোই চতুর, স্বার্থপর ও দুর্নীতিপরায়ণ। বিবিসি অনলাইন এটুকু মাত্রই বলেছে। কীভাবে পিঁপড়া চাতুর্য করে এবং দুর্নীতি করে অর্থাৎ টাকা মারে বা অন্যের জিনিস আত্মসাৎ করে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়নি। তবে চাতুর্য কত রকম, স্বার্থপর কতভাবে হওয়া যায় এবং দুর্নীতি যে কত প্রকার, তা আমাদের চেয়ে পিঁপড়ার সমাজে বেশি তা ভাবার কোনো কারণ নেই।
তবে নতুন নতুন গবেষণার সুবিধা এই যে, যত দেরিতেই হোক নতুন নতুন সত্য বেরিয়ে আসে। হাজার বছর ধরে পিঁপড়াকে আমরা জানতাম গণতন্ত্রের মানসপ্রাণী এবং সামাজিক সহযোগিতার মডেল। বঙ্গসমাজে আজ যা চলছে তা সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদপত্র কী বলছে তা পূর্ণ সত্য বা চিরসত্য নয়, একদিন পিঁপড়া নিয়ে গবেষণার মতো আসল সত্য বেরিয়ে আসবে।
একদিকে অবারিত ফসলের মাঠ, অন্যদিকে আম-জাম-কাঁঠাল-হিজলের ছায়াসুনিবিড় ছোট ছোট গ্রামগুলো ছিল শান্তির নীড়, যেখানে কোনো নারীকে দেখলে মা বলতে কবির প্রাণ আনচান করত, আজ সেই বাংলার আকাশ-বাতাস দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকারে ভারী। আজ বাংলার নারী—হতে পারে সে কোনো মা, কোনো স্ত্রী, কোনো মেয়ে, কোনো বোন—চোখের পানিতে বুক ভাসায়। হয়তো কারও প্রিয়তম পুত্র, কারও প্রেমময় স্বামী, কারও স্নেহশীল বাবা অথবা কারও আদরের ভাই এক দিন হঠাৎ হারিয়ে গুম হয়ে গেল। অথবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, কয়েক দিন পরে পাওয়া গেল তার লাশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা বললেন, কী জানি বাপু কোনখানে গেছে, কিছু জানি না। নিজেও লুকিয়ে থাকতে পারে।
বাংলার সব দল-মতের মানুষই অজানা আতঙ্কে কম্পিত। কিন্তু ভয় পেলেই বা তারা পালাবে কোথায়? পৃথিবীর অনেক সম্প্রদায়ের মানুষই ভয় পেয়ে কোথাও না কোথাও গিয়ে পালাতে পারে। সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কম হলে অন্তত একটা গুহা-টুহাতে গিয়ে পালাতে পারে। বাঙালি তো সংখ্যায় বেশি। পালাবে কোথায়?
নেতার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য পৃথিবীর সব সম্প্রদায়ের মানুষেরই। রাশিয়ার পেনজা এলাকায় একটি রক্ষণশীল সম্প্রদায় বাস করে। তাদের জনসংখ্যা ২৮ জন। তবে তাদেরও একজন নেতা আছেন। সেই প্রাজ্ঞ নেতা ভবিষ্যদ্বাণী করেন, নয় মাসের মধ্যে কেয়ামত হবে। পৃথিবী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। শুনে ভয়ে তাদের অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য নিয়ে গোটা সম্প্রদায়ের ২৮ জনই একটি গুহার ভেতরে গিয়ে ঢোকে। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে গুহার ভেতরে পাঁচ মাস কাটানোর পর হঠাৎ একদিন ওপর থেকে মাটি ধসে পড়লে তারা মনে করে কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। দুটি শিশুসহ ১৪ জন দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসে। আপসহীন নেতা অন্যদের নিয়ে গুহার ভেতরেই অবরুদ্ধ থেকে যান।
পেনজা প্রদেশের গভর্নর ওলেগ মেলনিচেনকো বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্সকে জানিয়েছেন, ওই রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের চার শিশুসহ ২৮ জন তাদের নেতার নির্দেশে কেয়ামতের ভয়ে গুহায় গিয়ে ঢোকে। শুরু হয় কেয়ামতের জন্য অধীর আগ্রহে প্রহর গোনা। নেতা যখন বলেছেন সুতরাং কেয়ামত না হয়েই পারে না। খোঁজ পেয়ে গভর্নর মহোদয় সেখানে পুলিশ পাঠান। পানিকামান বা বালুভর্তি ট্রাক পাঠানোর প্রয়োজন হয়নি। পুলিশ গুহাবাসীর সঙ্গে আলোচনা অর্থাৎ সংলাপ শুরু করে। পৃথিবীর অনেক দেশেই যেমন বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ ব্যর্থ হয়, সেখানেও সরকারের পুলিশ ও গুহাবাসীর মধ্যে সংলাপ ব্যর্থ হয়। গভর্নর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পুলিশ তাদের গুহা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য চাপ দিলে তাদের নেতা বলেন, বেশি চাপাচাপি করলে গ্যাসের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাঁরা নিজেদের উড়িয়ে দেবেন। তাঁরা কেয়ামত বা দুনিয়া ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত গুহাতেই থাকতে চান।
তাঁদের হুমকিতে পুলিশ ভয় পেয়ে সেখান থেকে চলে আসে। ওখানে পেট্রলবোমার চেয়ে গ্যাসের ব্যবস্থাটাই ভালো।
নেতা কেয়ামতের যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন, তা একদিন পার হয়ে যায়। তারপর অনির্দিষ্টকাল অবরোধের মতো নেতা তাঁর লোকদের অনির্দিষ্টকাল গুহাবাসের নির্দেশ দিয়েছেন কি না, সে খবর আর পাওয়া যায়নি। একসময় তাদের খাবারের রসদ ফুরিয়ে গিয়ে থাকবে। তখন ওখানে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ বন্ধ করে দিলে নেতা কেয়ামতের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেন, তা ছিল দেখার বিষয়। গুহাবাসী না হোক, গৃহবাসীদের খাওয়াদাওয়ার জিনিস বন্ধ করার দৃষ্টান্ত কোনো কোনো দেশে আছে।
সে যাহোক, ওই সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ২৮ জন। ১৬ কোটি হলে কোনো গুহায় গিয়ে আশ্রয় নিতে পারত না।
কবে রোজ কিয়ামত হবে তা যেমন আগাম বলা সম্ভব নয়, তেমনি বহু দেশে কেউই সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারে না যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কবে হবে। তাই নেতার নির্দেশে অনির্দিষ্টকাল অবরোধ চললেও গুহাবাসীর মতো দেশবাসীর বলার কিছু নেই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷