ব্যক্তিস্বাধীনতা ও পরমতসহিষ্ণুতা

ধর্ম
ধর্ম

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মানুষই জন্মগতভাবে স্বাধীন। তাই প্রত্যেক রাষ্ট্রে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকা বাঞ্ছনীয়। বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের অনুসারী ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে এবং অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা থাকবে—এটাই ধর্মের বিধান। ব্যক্তির কথায়, কাজে বা আচার-ব্যবহারে নমনীয়তা থাকবে। আচরণে, কথাবার্তায় সংযম ও মধ্যমপন্থা অবলম্বন, উদার মনোভাব, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সমঝোতা ও সহযোগিতার দ্বারা উদ্ভূত সংকট নিরসনের মানসিকতা প্রয়োজন। সর্বজনীন মতামত গ্রহণ করায় উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ, যারা বিনয় নম্র নিজেদের সালাতে। যারা অসার ক্রিয়াকলাপ বা নিরর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকে।’ (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ১-৩)
ইসলাম মানুষের মতামত প্রকাশের ও প্রচারের অধিকার সংরক্ষণ করেছে। ন্যায়সংগত ও গঠনমূলকভাবে সরকারি নীতির সমালোচনা করা যাবে, কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহ বা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড অন্যায় ও অসংগত বলে বিবেচিত হবে। তবে মতামত প্রকাশের মধ্যে কোনো মিথ্যাচার থাকবে না। ইসলামের ইতিহাসে স্বাধীন মত প্রকাশের অজস্র ঘটনা রয়েছে। মানুষকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য পারস্পরিক সমঝোতা ও সহিষ্ণুতা গ্রহণ করতে হবে। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা সুরক্ষায় ব্যক্তিস্বাধীনতা ও পরমতসহিষ্ণুতার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এটি মানবজাতির একটি মহৎ গুণ।
ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে মানুষ নানা প্রকার দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদের সম্মুখীন হয়। কিন্তু বিপদে ধৈর্য ধারণপূর্বক সব বাধাবিপত্তি ও দুঃখ-কষ্ট অতিক্রম করেই মানুষ স্বাধীনভাবে লক্ষ্য অর্জন করে থাকে।
সফলতা ও উদ্দেশ্য সিদ্ধির ক্ষেত্রে পরমতসহিষ্ণুতার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে, ব্যক্তিজীবনের চরম লক্ষ্য হলো সফলতা অর্জন করা; কিন্তু যার মধ্যে সহিষ্ণুতার অভাব রয়েছে সে সাফল্য অর্জন ও উদ্দেশ্য সাধন করতে সক্ষম হয় না। পক্ষান্তরে সহিষ্ণুতার মাধ্যমে সফলতা লাভ করা সম্ভব হয়।
তাই মানুষকে সহিষ্ণুতার মাধ্যমে নিজ  দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হতে হবে এবং বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণপূর্বক আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলবে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার ওপর এমন দুঃখ-কষ্ট চাপিয়ে দিয়ো না, যাতে আমি ধৈর্যচ্যুত হই, বরং তুমি আমার ওপর দয়া কর।’ যেমনভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাদের ওপর এমন বোঝা চাপিয়ে দিয়ো না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৮৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান জীবনচরিত ছিল উদারতা, মহানুভবতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, বিভিন্ন দলমতের সমঝোতা ও পরমতসহিষ্ণুতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জন্মভূমি মক্কাবাসীর ঠাট্টা-বিদ্রূপ, অত্যাচার-নির্যাতন চরমে পৌঁছালেও তিনি কিছুতেই সহিষ্ণুতা হারাননি। হিজরতের পরে রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা ও তায়িফ বিজয়ের সময় যে অতুলনীয় ক্ষমার আদর্শ প্রদর্শন করেছেন, বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল। তাঁর সার্থক ও নির্মল ক্ষমাসুন্দর উদারতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গি, সমঝোতা, সহমর্মিতা ও পরমতসহিষ্ণুতার সুমহান চরিত্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ দলমত-নির্বিশেষে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে চিন্তা ও মত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ প্রদান করে মহানবী (সা.) ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বতোরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। মদিনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবাই শান্তিশৃঙ্খলার এক অপূর্ব মেলবন্ধন লাভ করেছিল।
নিজস্ব চিন্তাধারায় সীমাবদ্ধ না থেকে পাশাপাশি অন্যান্য বুদ্ধিমান বিবেকসম্পন্ন জ্ঞানী লোকের অভিজ্ঞতা ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, ধৈর্যের সঙ্গে শ্রবণ করা, সহনশীল হয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের পরামর্শ বা অভিমত প্রকাশ করার সুযোগ দিয়ে প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় রাখা দরকার।
সর্বোপরি পারস্পরিক মতামতের সারবত্তা ও যৌক্তিকতা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর মধ্যে যা সঠিক ও যুক্তিযুক্ত প্রমাণিত হবে, তা সর্বান্তকরণে মেনে নেওয়ার মানসিকতা নিজের মধ্যে সৃষ্টি করা এবং প্রয়োজনে নিজের অভিমত ত্যাগ করেও অন্যের মতামত সহনশীলতার সঙ্গে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকাই হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিক দিয়ে প্রকৃতপক্ষে উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতা এক ও অভিন্ন। একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ পরমতসহিষ্ণু হয়ে থাকে, অনুরূপভাবে একজন পরমতসহিষ্ণু মানুষকে উদার হতে হয়। যে সমাজে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি, শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা যত বেশি, সে সমাজে অপরাধপ্রবণতা তত কম। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহের মধ্যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার ক্ষমতাদান সবচেয়ে বেশি মূল্যবান।’ (বুখারি) ইসলামের আলোকে ধৈর্য, সংযম, উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতা মানুষের ইমানকে পরিপক্ব করে। ইমানের যতগুলো শাখা-প্রশাখা রয়েছে, তন্মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা অন্যতম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ইমানের অর্ধাংশ।’ (আবু নাঈম) তিনি আরও বলেছেন, ‘সহিষ্ণুতার পুরস্কার জান্নাত।’ (বায়হাকি)
সমাজজীবনে মানুষ যেকোনো সময় বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে পারে, সে জন্য তাকে পশ্চাৎপদ হলে
চলবে না, বরং সহনশীলতার সঙ্গে সেসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে নিরপেক্ষতার সঙ্গে যথাযথভাবে কর্তব্য পালন করতে হবে। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মানুষের যুক্তিসংগত মতামতকে পরামর্শের ভিত্তিতে প্রাধান্য দিতে হবে। জাতিগঠনমূলক সংলাপ, আলাপ-আলোচনা, পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসে জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
এভাবে ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী যদি সব ক্ষেত্রে অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সহিষ্ণুতার সঙ্গে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা যায় তাহলে সমাজজীবনে শান্তিশৃঙ্খলা, ঐক্য, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সমঝোতার অনুশীলন ব্যতিরেকে ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত জীবনে সাফল্য আশা করা যায় না।
ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তিশৃঙ্খলা ও কল্যাণকর জীবনযাপনের জন্য ব্যক্তিস্বাধীনতা ও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা একান্ত অপরিহার্য। অন্যথায় সমাজে বিশৃঙ্খলা ও হানাহানি ঘটার আশঙ্কা থাকে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]