বর্তমান বাংলাদেশ ও বিসর্গতে দুঃখ

ছোটবেলার বর্ণমালা বইয়ে পড়েছিলাম, বিসর্গতে দুঃখ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টের পেয়েছি জীবনসাগরে সুখ ভেলামাত্র, বাকিটুকু দুঃখই। ফলে মেনে নিয়েছি বিসর্গতে দুঃখই সই। একপর্যায়ে একটা পূর্ণাঙ্গ বই লিখেছি বিসর্গতে দুঃখ নামে। সে বইটিকে বলা যেতে পারে বড়দের বর্ণমালা। প্রয়াত লেখক শহিদুল জহির বইটি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে একে বলেছিলেন মেটাফিকশন। কোনো কোনো বিপ্লবী মানসিকতার পাঠক অবশ্য প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছিলেন: এ বইতে ক্রোধ নেই, বিদ্রোহ নেই, আছে কেবল দুঃখের পাঁচালী। তাঁদের আবেগ বুঝতে পারি। তাঁরা মানুষের যাবতীয় চেতনা ছাপিয়ে কেবল বিপ্লবী চেতনার দিকেই মন দিতে চান। কিন্তু জীবনে কোনো কোনো সময় আসে, যখন মনের ভেতর ঝেঁপে আসে দুঃখ। তখন বুদ্ধের বাণীই অমোঘ মনে হয়, ‘জগৎ দুঃখময়’। বছর দশেক আগে জীবন, সমাজ, রাজনীতির নানা পাকচক্রে মনের ভেতর তেমন এক দুঃখের বাষ্প জমে উঠেছিল। বিসর্গতে দুঃখ বইটিতে ওই সময়ের সেই ক্রান্তি, দ্বিধা, বেদনাকেই উদ্যাপন করেছিলাম।
এই মুহূর্তে নতুন করে ঠিক তেমনিভাবেই মনের ভেতর জেঁকে বসেছে দুঃখ। চারদিকের রক্ত, রিরংসা, ভয়ের গুমোট বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মনের ক্রোধ ছাপিয়ে ধেয়ে আসছে দুঃখ। মনে হচ্ছে বহুদিনের, বহুজনের ভুলের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে একটা জটিল জটাজালের মধ্যে আটকে গেছে দেশ। এই জট খুলতে সবকিছু নিয়ে আগাপাছতলা ঝেড়ে ভাবার দরকার। আলোচিত দার্শনিক স্লাভোই ঝিঝেক সম্প্রতি যেমন বলেছেন, ‘ডোন্ট অ্যাক্ট, জাস্ট থিঙ্ক।’ আজকের লেজেগোবরে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে কিছুটা খেপে গিয়েই ‘শুধু ভেবো না, কাজ করো’—এই বাজারচলতি কথার বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন, গভীর চিন্তাহীন কাজ করার চেয়ে বরং বসে ভাবো, কোথায় তারটা ছিঁড়েছে। বাংলাদেশের অবস্থা দেখে ঝিঝেকের উপদেশ মানতে ইচ্ছা হয়। মনে হয় ধ্যানমগ্ন হয়ে বুঝে নেওয়া দরকার, কোথায় আমাদের তারটা ছিঁড়ে গেছে। এটুকু বোঝা যায় যে আমাদের গণতন্ত্রের তারটা ছিঁড়েছে অনেকটাই। ‘গণতন্ত্র’ এখন তারকা শব্দ। এ নিয়ে গণমাধ্যমে নানাজনের মত শুনি। ব্যাপার যে খুব খোলাসা হয়, তা নয়। রম্যলেখক শিবরাম চক্রবর্তীর কথা মনে পড়ে। তিনি একবার লিখেছিলেন, ‘জীবন একটি বুঝিবার বিষয় কিন্তু বুঝিল সে কে?’ এই পরিস্থিতিতে একজন হাস্যরসের লেখককে স্মরণ করাটা বোধ হয় সমীচীন নয়। কিন্তু একবার কোনো এক এসকিমো কবির কবিতা পড়েছিলাম, ‘ধু ধু তুষারে আমার স্লেজ গেল ভেঙে, মন তুমি হাসো কেন?’ দুর্দশা যখন চরমে পৌঁছায়, তখন হাসি একটা প্রতিরক্ষা, ঘুরে দাঁড়ানোর অস্ত্রও হতে পারে। তাই গভীর বেদনায় হাসিও পায়। মনে হয়, ‘গণতন্ত্র একটি বুঝিবার বিষয় কিন্তু বুঝিল সে কে?’
একদিন এক বিশিষ্ট টিভি টক শো বক্তাকে বলতে শুনলাম, ‘আমরা যদি পশ্চিমে তৈরি যন্ত্র কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারি, তাহলে পশ্চিমে জন্ম নেওয়া গণতন্ত্র কেন ব্যবহার করতে পারব না?’ দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। পশ্চিমা একটা ‘টেকনোলজি’ চর্চা আর পশ্চিমা একটা ‘আইডিয়োলজি’ চর্চা কি একই ব্যাপার? পশ্চিমের প্রতি আমাদের এই অকুণ্ঠ আনুগত্য তো বহুকালের। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ কী, সেটা জানার জন্য দেখি পশ্চিমের এক দেশের রাষ্ট্রদূতের নাকেমুখে মাইক্রোফোন ধরে আছেন সংবাদ শিকারিরা। তারপর দেখি প্রাচীন সম্রাট যেমন জনতার ভেতর মোহর বিলাতেন, তেমন ভঙ্গিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাণী দেন পশ্চিমা রাষ্ট্রদূত। শ্রোতৃমণ্ডলীর আপাদমস্তক চুইয়ে পড়ে হীনম্মন্যতা। গণতন্ত্র নিয়ে পরাক্রমশালী আমেরিকার অনেক বড়াই। রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাট নামে নিজেদের মধ্যে খানিকটা পার্থক্য জিইয়ে রেখে গণতন্ত্রের যে পুতুলখেলা তারা খেলে, তার নমুনা তো পৃথিবী দেখে আসছে অবিরাম। সেদিন একটা স্যাটায়ার পোস্টার দেখছিলাম অনলাইনে, লেখা: ‘আমেরিকার সঙ্গে বেশি গোলমাল কোরো না, তাহলে ওরা তোমাদের দেশে গণতন্ত্র এনে দেবে।’ কৌতুকটার ইঙ্গিত স্পষ্ট। গণতন্ত্র এনে দেওয়ার নামে ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানকে আমেরিকা যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, তাতে তাদের গণতন্ত্র এনে দেওয়ার মহান ব্রতকে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ব্রিটেনে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এদের বহু শতাব্দীর গণতন্ত্রচর্চার গর্ব থাকলেও কোনো জনমতের তোয়াক্কা না করে সরকার এক ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি বাড়িয়ে দিয়েছে তিন গুণ। এর বিরুদ্ধে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনকে দমানো হয়েছে জোরালো পুলিশি তৎপরতায়। চীন তো গণতন্ত্রের দিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রমাণ করেছে, বহুদলীয় গণতন্ত্র ছাড়াই পৃথিবীর অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠা যায়।
আর আরব বসন্তের পর গণতন্ত্রের চেহারা হয়ে উঠেছে আরও গোলমেলে। সিরিয়ায় গণতন্ত্র আনতে গিয়ে তা পরিণত হয়েছে এক মৃত্যুপুরীতে। মিসরে স্থিতাবস্থা আনতে গিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে বল প্রয়োগ করে সরাতে হয়েছে সামরিক বাহিনীকে। আবার অন্যদিকে, যেখানে সূত্রপাত ঘটেছিল আরব বসন্তের, সেই তিউনিসিয়ায় অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এবার প্রথম শুরু হয়েছে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পার্লামেন্ট। এশিয়ায় ভারত দীর্ঘদিন বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চার মধ্য দিয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হলেও পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র চর্চা না করেই একধরনের কর্তৃত্বপরায়ণ গণতন্ত্রের মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া। কথা হচ্ছে গণতন্ত্রের কোনো একক চেহারা নেই। যে পশ্চিমা ‘নাগরিক’ ধারণা এবং ভোটাধিকারভিত্তিক গণতন্ত্রের মডেল সারা পৃথিবীর জন্য প্রযোজ্য বলে চালু করা হয়, তাকে বহু আগেই চ্যালেঞ্জ করেছেন পোস্ট কলোনিয়াল, সাব-অলটার্ন তাত্ত্বিকেরা। তাঁরা তর্ক তুলেছেন উত্তর ঔপনিবেশিক দেশগুলোর সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ভেতরের চেহারা থেকে। পশ্চিমের অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগতে পারে, কিন্তু ফর্মুলাটা বের করতে হবে আমাদেরই। গণতন্ত্রের থাকতে পারে একটা দেশজ রূপ। ফলে পশ্চিম থেকে কম্পিউটার এনে আমরা যেভাবে চালাতে শুরু করেছি, সেভাবে গণতন্ত্রের ধারণা এনেও চালানো যাবে বা যাওয়া উচিত, সেটা তেমন কোনো কাজের ধারণা নয়।
তাহলে প্রশ্ন আসবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের চেহারাটা কেমন হবে? ইংরেজিতে একটা অভিব্যক্তি আছে, ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’। আলাপ যা নিয়েই করি না কেন, ঘরের ভেতর প্রকাণ্ড হাতিটাকে নিয়ে আগে কথা বলতে হবে। আমাদের জন্য সেই হাতিটা হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধ’। সোজা কথা এই যে বাংলাদেশ নামে যে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী নিয়ে আমরা কথা বলছি, তার জন্ম হয়েছে একটা মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটা নিয়ে বিস্তর যথেচ্ছাচার হয়েছে, এমনকি আজকাল ‘চেতনাবাজ’ নামে একটা শব্দও শুনতে পাই। কিন্তু এসব ধোঁয়াশা সরিয়ে কেন একটা রাষ্ট্রের অংশ থাকা সত্ত্বেও একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে আরেকটা নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে হলো, সেটা বোঝা রকেট-বিদ্যা বোঝার মতো কঠিন কোনো কাজ নয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধ নামের হাতিটার সঙ্গে মোকাবিলা না করে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিষয়ে কোনো মীমাংসা সম্ভব বলে মনে হয় না। কোনো তত্ত্ব, কোনো পশ্চিমা দূত এই মীমাংসা দিতে পারবেন এমন ভাবারও কোনো কারণ দেখি না।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর একই সঙ্গে কী করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের উভয় শক্তিরই স্বার্থ, অধিকার রক্ষা করে গণতন্ত্র চর্চা হতে পারে, সেটা ঠিক বোধগম্য নয়। অথচ বহুকাল ধরে সেই জোড়াতালির রাষ্ট্রই চলছে। দেখা যাচ্ছে পুরো রাষ্ট্র সংকটের একটা নতুন মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে, ঠিক যখন থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের একটা আইনগত জবাবদিহির ভেতর আনার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এখন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা আরও জটিল হয়ে গেছে, কারণ এত দিনে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা আর একা নয়। নানা ঘটনাচক্রে, নানা রাজনৈতিক, সামাজিক পটপরিবর্তনে ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে তাদের অনেক সহযোগীর। নানা স্বার্থে সেই সহযোগীদের মধ্যে রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষও। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর ধর্মীয় চেতনার বিতর্ক, যুক্ত হয়েছে নতুন নানা আন্তর্জাতিক শর্ত। ফলে ব্যাপারটা হয়েছে আরও ঘোলাটে।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া একটা দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী একটা শক্তি কোনো আইনগত জবাবদিহির ভেতর না এসে, তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা না চেয়ে অবিরাম বিত্তবৈভবে কেবলই শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকবে, কেবলই তাদের প্রভাববলয় বাড়তে থাকবে, এমন একটা নৈতিক বিভ্রান্তি নিয়ে দেশ কী করেই বা এগোতে পারে? এ বিভ্রান্তি চূড়ান্তভাবে দূর করা না পর্যন্ত বাংলাদেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন—সব ভাবনাই মুখ থুবড়ে থাকবে বলেই মনে হয়। কিন্তু কী করে এই বিভক্তি দূর করে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে, যেখানে সরকারি ও বিরোধী উভয় দলই হবে মুক্তিযুদ্ধের নিরঙ্কুশ পক্ষের শক্তি, তার উত্তর বোধ করি সহজ নয়।
নানা কূটতর্ক, ইতিহাস বিকৃতি, ষড়যন্ত্র, ফায়দা লোটার সংস্কৃতি মিলিয়ে ব্যাপার আরও জট পাকিয়ে গেছে। এই জটের সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। ফলে আমরা স্পষ্ট চূড়ান্ত একটা ক্রান্তির সময় অতিক্রম করছি। এই ক্রান্তি অতিক্রমে আমাদের হয়তো আরও মূল্য দিতে হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটার মৌল চরিত্র আমরা কেমন দেখতে চাই, আমাদের সবাইকেই বোধ হয় এ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং যার যার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। হয়তো আরও অনেক দিন আমাদের জপতে হবে বিসর্গতে দুঃখ। তার পরও দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে মঙ্গল আলোক, তবে তা-ই হোক।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
[email protected]