সৌহার্দ্যবন্ধন প্রতিষ্ঠায় সহনশীলতা

ধর্ম
ধর্ম

মানবজীবনে সৌহার্দ্যবন্ধন প্রতিষ্ঠায় সহনশীলতা একটি অনুকরণীয় ও অনুশীলনযোগ্য বিশেষ গুণ। সহনশীলতা মানুষকে শেখায় কীভাবে অন্যের মতামত ও আচার-আচরণ সহজভাবে গ্রহণ করতে হয় বা সহ্য করতে হয় এবং ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গে সম্প্রীতি ও সহানুভূতিশীলতার সঙ্গে এবং সহযোগিতার মনোভাব বজায় রেখে একসঙ্গে বা একই সামাজিক পরিবেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে হয়। সামাজিক জীবনে কাজকর্মে বিভিন্ন বাধা-প্রতিবন্ধকতা আসতেই পারে, সে কাজটি যদি মহৎ হয়, তাহলে সব বাধা ডিঙিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতা সহকারে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সহনশীলতার চেষ্টা করবে, আল্লাহ তাকে সহনশীলতা অবলম্বনের শক্তি দান করবেন, আর সহনশীলতা থেকে অধিক উত্তম ও ব্যাপক কল্যাণকর বস্তু আর কিছুই কাউকে দান করা হয়নি।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সহনশীলতার ক্ষেত্র বহুধাবিভক্ত; যেমন পরিবার, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে সংযত আচরণ, কর্মক্ষেত্রে সহনশীল হওয়া এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দলমতের ক্ষেত্রেও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন; এককথায় বলতে গেলে সব দিক দিয়ে সুস্থ সামাজিক পরিবেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে হলে সহনশীলতাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এমন জবরদস্তি প্রচেষ্টা চালানো উচিত নয়, যা অন্য মানুষকে দুঃখ-কষ্টে নিপতিত করবে, অহেতুক বিপদ বয়ে আনবে; তবু সমাজে কাঙ্ক্ষিত শান্তিশৃঙ্খলা অর্জিত হবে না। অথচ সমাজে নানা রকম সহিংসতা, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি ও বিপর্যয় একটার পর একটা লেগেই আছে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ-আপদ ও নিরাপত্তাহীনতায় সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বিপদে ধৈর্য ধারণের কথা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য-সহনশীলতা ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৩)
পরিবারে সহনশীলতার অভাব থাকলে পারিবারিক সুখ-শান্তি ব্যাহত হয়। মা-বাবা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী, অন্য কোনো আত্মীয়স্বজন পরস্পরকে যদি মোটামুটিভাবেও না বোঝে বা বুঝতে না চায়, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে পরস্পরের প্রতি অসহনশীল আচরণ; ফলে পরিবারের সুখ-শান্তি বিঘ্নিত হবে, মন খারাপ হবে এবং তা নানাভাবে পার্থিব জীবনকে কলুষিত করে পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্যবন্ধন ও সম্প্রীতিমূলক মনোভাব এবং আচরণকে অনুকূলভাবে প্রভাবিত করে, যার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী। এর প্রধান কারণ অসহিষ্ণু পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্তানের ঘরের ও বাইরের জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বেশ অসুবিধার মধ্যে পড়ে। তারা আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে যায়। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনগণ উটের মতো সহনশীল ও নরম; যদি আকর্ষণ করা হয়, তবে সে আকৃষ্ট হয়, আর যদি পাথরের ওপর উপবিষ্ট করানো হয়, তবে সে উপবিষ্ট হয়।’
সহনশীলতার অভাবের ফলে আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই সম্পর্কের ক্ষেত্রে আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে পরস্পরের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষের পরিবেশের উদ্ভব হয়। পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যেও সহনশীলতার অভাবে ঝগড়া-বিবাদ বা হিংসা-বিদ্বেষের মনোভাবের ফলে সামাজিক অশান্তি দেখা দেয়, সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এবং শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এসবের ফলে সাধারণভাবে ধীরে ধীরে সমাজের মধ্যে অস্থিরতা ও অশান্তি বেড়ে যায় এবং সুস্থ পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হয়। ফলে দুর্বল লোকেরা বারবার সবলদের দ্বারা আক্রান্ত, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের শ্রমফল নষ্ট করেন না।’ (সূরা হুদ, আয়াত: ১১৫)
বর্তমানে দেশের অধিকাংশ মানুষের মাঝে সহনশীলতা ও সহমর্মিতা নেই। এমনকি শিশু-কিশোর, তরুণ ও যুবকদের মধ্যেও পারস্পরিক সহনশীলতা ও সহমর্মিতার ঘাটতি রয়েছে। সহনশীলতার অভাব ব্যাপকভাবে কর্মক্ষেত্রেও বিক্ষোভের এবং চাপা ক্ষোভের পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা পালন করে, যাতে সহকর্মীদের মধ্যে সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে পড়ে, ফলে রেষারেষির ভাব এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিশোধমূলক ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের আশঙ্কা ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। এসব ক্রমেই মানসিক শান্তির চরম বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কর্মক্ষেত্রের অশান্তি পরিবারের মধ্যে সুস্থ সম্পর্কের ওপর অশুভ প্রভাব বিস্তার করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে সাবধান করে বলেছেন, ‘বিপদ ও পরীক্ষা যত কঠিন হবে, তার প্রতিদানও হবে তত মূল্যবান। আর আল্লাহ যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন, তখন অধিক যাচাই ও সংশোধনের জন্য তাদের বিপদ ও পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। অতঃপর যারা আল্লাহর সিদ্ধান্তকে খুশি হয়ে মেনে নেয় এবং সহনশীলতা অবলম্বন করে, আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট হন। আর যারা বিপদ ও পরীক্ষায় আল্লাহর ওপর অসন্তুষ্ট হয় আল্লাহও তাদের ওপর অসন্তুষ্ট হন।’ (তিরমিজি)
পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সৌহার্দ্যবন্ধন প্রতিষ্ঠা এবং শান্তিশৃঙ্খলা সুরক্ষার জন্য সহনশীলতা একটি উত্তম হাতিয়ার। তবে বর্তমানে আমাদের দেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে অসহনশীলতা দুর্বিষহ অবস্থান নিয়ে মানুষের মধ্যে অস্থির ও অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। দেশের আপামর জনসাধারণ এখন যতগুলো রাজনৈতিক গোষ্ঠী আছে, ততগুলো দলমত, জাতি-গোত্রের ভয়াবহ অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও মতপার্থক্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে সংঘাত, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, ভাঙচুর, বোমাবাজি ও অগ্নিসংযোগের ফলে সুস্থ রাজনীতি দারুণ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সন্ত্রাস, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা শুধু অশান্তিই ডেকে আনে। আর মানুষের দুষ্কৃতি ও অপকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। তাই আল্লাহ তাআলা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। সুতরাং দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ এবং শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজন অবিমিশ্র সহনশীলতা ও পারস্পরিক সমঝোতা। সহিংসতা ও সংঘাত এড়ানোর একমাত্র পথ সহনশীলতা। দেশের জনগণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে ও জাতির সেবায় মানবতার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার জীবনসংগ্রামে সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা ও সৌহার্দ্যবন্ধন প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষের অত্যন্ত সহনশীল আচরণ করা বাঞ্ছনীয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]