ভবনে লাগুক প্রাণের ছোঁয়া

জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনে তাপমাত্রা বেড়ে নগরগুলো পরিণত হচ্ছে একেকটা তাপের হাটে। তাই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসি, ফ্যান, কুলার, ফ্রিজ ইত্যাদির ব্যবহার। কার্বন নিঃসরণ বেড়ে পরিবেশ বিপর্যয় অনেকটা চূড়ান্ত পর্যায়ে। জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন রোধে যেমন নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ, তেমনি তা মোকাবিলায়ও নানামুখী প্রয়াস লক্ষণীয়। আবাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও এর বাইরে নয়। ভবনকে পরিবেশবান্ধব ও প্রতিকূল-সহায়ক করতে স্থাপত্য ডিজাইনে আনা হচ্ছে নানা পরিবর্তন।
পরিবর্তন আনা হচ্ছে কংক্রিটে, যা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বহুল ব্যবহূত একটি নির্মাণ উপাদান। খুব শক্ত ও নিরেটধর্মী হওয়ায় স্থাপনার স্থায়িত্বের প্রশ্নে এটা অতুলনীয়। কংক্রিটকে ভালোভাবে ব্যবহার করা গেলে বাড়তি পলেস্তারার দরকার হয় না। এ জন্য অনেক ভবনে পলেস্তারা ব্যবহার না করে উন্মুক্ত কংক্রিট ব্যবহার করছেন স্থপতি ও প্রকৌশলীরা। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এটা অবশ্য উৎকৃষ্ট। তবে অনেকে ছাইরঙা কংক্রিট ঢাকতে সেখানে লতাবট, ফার্ন, মানিপ্ল্যান্ট ইত্যাদি উদ্ভিদের আবরণে ভবনকে ঢেকে দেন। সবুজের ছোঁয়া পেয়ে ভবনটিও হয়ে ওঠে অত্যন্ত চমৎকার। এগুলো পরিবেশবান্ধব হলেও অনেক সময় তা ভবনবান্ধব নয়। অর্থাৎ সঠিকভাবে পরিচর্যা না হলে গাছের শিকড় দেয়ালকে দুর্বল করে দেয়। অতিরিক্ত তাপমাত্রা রোধে গ্রিনরুফ বা সবুজ ছাদ কৌশলটিও স্থাপনায় অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায়। এই সিস্টেম ভবন ও ছাদের তেমন কোনো ক্ষতি না করে একদিকে যেমন তাপের হাত থেকে বাঁচায়, তেমনি কিছুটা ফল-ফুলও পাওয়া যায়। কিন্তু প্রগতিশীল পরিবেশবাদী স্থপতি ও প্রকৌশলীদের মতো ভবনকে পরিবেশবান্ধব করার বিষয়কে কিছুটা ভিন্নভাবে ভাবা যেতে পারে। পুরো ভবনকে সবুজে মুড়িয়ে তাতে করা যেতে পারে প্রাণের সঞ্চার, তাহলে ভবনটিও হয়ে উঠবে জীবন্ত। প্রতিটি ভবন পরিণত হবে পরিবেশ রক্ষার একেকটি দুর্গ।
কথাগুলো একটু উদ্ভট শোনালেও পরিবেশ গবেষকেরা অনেকটাই এর বাস্তবায়ন করেছেন। তাঁরা প্রচলিত কংক্রিটকে কিছুটা আধুনিকায়ন করে আবিষ্কার করেছেন জৈব কংক্রিট। বিশেষ ধরনের এই কংক্রিটে জন্মাবে ক্ষুদ্র শেওলা, শৈবাল, ছত্রাক, মস ইত্যাদি ধরনের রঞ্জক উদ্ভিদ। স্পেনের বার্সেলোনার ইউনিভার্সিট্যাট পলিটেকনিকা ডি ক্যাটালুনিয়ার (<http://www.upc.edu/?set_language=en>) অ্যান্টোনিও আগুয়াডোর (Antonio Aguado) নেতৃত্বে একদল গবেষক এই নতুন একাধিক স্তরবিশিষ্ট কংক্রিট উদ্ভাবন করেছেন। প্রচলিত কার্বোনেটেড কংক্রিটের (পোর্টল্যান্ড সিমেন্টভিত্তিক) পরিবর্তে পরিবর্তনশীল পিএইচযুক্ত সিমেন্ট ব্যবহার করেছেন তাঁরা। রঞ্জক উদ্ভিদ যেন সহজেই জন্মাতে ও বাড়তে পারে এবং দেয়াল তথা ভবনের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেভাবেই একাধিক স্তরবিশিষ্ট পৃষ্ঠতল গঠন করা হয়েছে। তাঁদের গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য উদ্ভিদ ও ক্ষুদ্র প্রাণীর স্বাভাবিক উপনিবেশ গড়ে পরিবেশকে রক্ষা করা। স্ট্রাকচারাল স্তর ছাড়াও তিনটি অতিরিক্ত স্তর যোগ করা হয়েছে। প্রথমটি পানিরোধী স্তর, যা পানির অনুপ্রবেশ রোধ করবে। দ্বিতীয়টি জৈব স্তর, যা উপনিবেশ স্থাপনে ও পানি ধরে রাখতে সহায়তা করবে। আর্দ্রতা ধরে রাখতেও এই স্তর কাজ করবে। শেষ স্তরে দেওয়া হয়েছে পানিরোধী বিচ্ছিন্ন প্রলেপ।
প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকতে চাওয়া মানুষের আদিম ও অকৃত্রিম প্রবৃত্তি। শহরের আঁটোসাঁটো বাড়িতে সে সুযোগ না থাকলেও জৈব কংক্রিট প্রক্রিয়াটি যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে পুরো বাড়িটির বাইরের দেয়াল হবে সবুজ উদ্ভিদে মোড়া। এসব উদ্ভিদে বিভিন্ন রঙের ফুল ফুটবে; ফুলে ফুলে উড়বে প্রজাপতি; মধুর লোভে গুনগুন সুরে মৌমাছিরাও জুটে যাবে। হয়তো কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড়ও জন্মাবে তাতে, এমনকি এদের খেতে নানা ধরনের পাখিও জুটে যাবে। নগরায়ণের ফলে পশু, পাখি, কীটপতঙ্গের আবাসস্থল যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে, তা কিছুটা হলেও রোধ করা যাবে।
এই প্রযুক্তির ব্যবহার উদ্ভিদ জন্মানো ছাড়াও পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা এবং স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এই জৈব আবরণ বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এর পরিমাণ হ্রাস এবং অক্সিজেন বৃদ্ধি করবে। মাত্রা কমাতে সাহায্য করবে। পরিবেশে উৎপন্ন তাপ শোষণ করবে। ভবনের দেয়ালে উৎপন্ন প্রাণীর সৌর বিকিরণ শোষণক্ষমতা এবং এই কংক্রিট তাপকে ভবনে ঢুকতে বা বেরোতে দেয় না বলে ভবনের ভেতরে তাপ পরিবাহী-ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকে ও বসবাস আরামপ্রদ হয়। একই সঙ্গে এর সৌর বিকিরণ শোষণের ক্ষমতা আছে, যা কাঠামোর অভ্যন্তরীণ তাপ পরিবাহিতা নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখে। ফলে ঘরের আবহাওয়া থাকে শীতে উষ্ণ ও গ্রীষ্মে শীতল। তাপানুকূল যন্ত্রের কম ব্যবহারে মাসে বিদ্যুৎ ব্যবহার কমবে। শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে তাপ শোষণকারী এমন সবুজ গ্রীষ্মকালে শহরের গড় তাপমাত্রাও কমবে। এ ছাড়া সবুজ গাছপালা ভবনকে শব্দনিরোধী করতে সাহায্য করে, তাই অতিরিক্ত শব্দের যন্ত্রণা থেকেও বাঁচা যাবে। ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কমবে। সবকিছুর পরে ভবনটিও প্রাণীকুলের মতো নেবে শ্বাস-প্রশ্বাস, হবে জীবন্ত। করবে প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব।
নতুন উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে গবেষকেরা ইতিমধ্যেই পেটেন্ট সম্পন্ন করেছেন। বেশ কিছু ভবনেও এর সফল প্রয়োগ নিশ্চিত করেছেন। আবহাওয়ার সঙ্গে সংগতি রেখে কংক্রিটে প্রাণসঞ্চার ঘটাতে গবেষকদের করতে হয়েছে দীর্ঘ গবেষণা। কিন্তু আমাদের দেশে কাজটি অনেকটা মামুলি ব্যাপার। কারণ, এ দেশের জলবায়ুতে আর্দ্রতা অনেক বেশি। তাই সহজে দেয়ালে ছত্রাক, ফাঙ্গাস ও শেওলাজাতীয় অপুষ্পক উদ্ভিদ জন্মে। এর মধ্যে কিছু ছত্রাক ক্ষতিকর মাইক্রো-টক্সিন তৈরি করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অবশ্য সৌরতাপই এগুলো ধ্বংসে যথেষ্ট; তার পরও বিদেশি গবেষণার ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। একসময় হয়তো এই ব্যবস্থা এ দেশেও জনপ্রিয়তা পাবে, কিন্তু তা এদেশীয় আবহাওয়ায় খাপ খাবে না। তাই বুয়েট, হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্স ইনস্টিটিউটসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা বিষয়টিতে তৎপর হবেন, এটাই কামনা। স্থপতি ও প্রকৌশলীদের প্রতিও এ বিষয়ে চিন্তাভাবনার অনুরোধ রইল।
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
মাহফুজ ফারুক: পরিবেশ ও স্থাপত্যবিষয়ক সাংবাদিক।
[email protected]