বাঙালি মুসলিম সমাজে নববর্ষ

ধর্ম
ধর্ম

সময় বয়ে চলেছে তার আপন গতিতে। একটি বছরের বিদায়ের মধ্য দিয়ে আরেকটি বছরের আগমন ঘটছে। একটি সালের পরিবর্তন মানে বর্ষপঞ্জিতে এক বছরের যোগ। একটি বছরের বিদায়লগ্নে নতুন আরেকটি বছরের আগমন নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাই জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজের মতো বর্ষ গণনাকেও জরুরি বলে মনে করা হয়। সকলে বিগত বছরটির প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অঙ্ক কষেন এবং আগত বছরটিকে নতুন স্বপ্নে বরণ করার প্রস্তুতি নেন। দিবা-রাত্রির পরিবর্তন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে এই দিনগুলোর আমি পর্যায়ক্রমে আবর্তন ঘটাই।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৪০)
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই ইহজগতে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে মানুষের পথচলা। ইসলামে সময়ের সদ্ব্যবহারের কথা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। সূরা আল-আসরের প্রারম্ভিক আয়াতে যুগের শপথ গ্রহণ করা হয়েছে, যাতে সত্য, ন্যায়পরায়ণতা ও ধৈর্য-সহনশীলতার মাধ্যমে মানবজাতি তার আয়ুষ্কাল বা সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারে এবং নিজেদের অনিষ্টের কবল থেকে রক্ষা করতে পারে। সময়ের আবর্তনে ঘটমান সবকিছু থেকে আল্লাহ তাআলা মানুষকে উপদেশ গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘এবং তাদের আল্লাহর দিবসগুলো দ্বারা উপদেশ দাও। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে পরম ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ লোকদের জন্য।’ (সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৫)
বাঙালি জাতির জীবনে বাংলা নববর্ষ উৎসব একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। মৌসুমি ফসল উৎপাদন ও ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করে যুগে যুগে উপমহাদেশে বাংলা সনসহ একাধিক সন গড়ে উঠেছে। বাংলা নববর্ষ উৎসবে প্রথমদিকে মুসলমানরা পুরোপুরি সম্পৃক্ত ছিল। বৈশাখী অনুষ্ঠান ছাড়াও আবহমান বাংলার গ্রামীণ লোকজ অনুষ্ঠানে মুসলমান ও হিন্দু কৃষিজীবীরা একাত্মÄ হতেন।
নববর্ষ পৃথিবীর সর্বত্রই দেশীয় সংস্কৃতি, জনগণের অনুভূতি, আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে উদ্যাপিত হয়। সবার প্রত্যাশা থাকে নতুন বছরে অতীতের সব গ্লানি ধুয়ে-মুছে নতুনভাবে শুরু হোক জীবন, সৌভাগ্যের রাজটীকা শোভিত হোক ললাটে, বিষাদ ও বিড়ম্বনার অবসান হোক! ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম বণিক বা শাসকেরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশে আসেন, তখন তাঁদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে কৃষ্টি-সভ্যতার অংশবিশেষ আমাদের সংস্কৃতিতে মিলিত হয়েছে। আরবরা ইসলাম গ্রহণের পরও অনেক ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান অকৃত্রিম রেখেছিল।
বাংলা সন-পরবর্তী একাধিক সন তৈরিতে ইসলামের প্রভাব সুস্পষ্ট ছিল। ১৭৮২ সালে পিতা হায়দার আলী খানের ইন্তেকালের পর টিপু সুলতান মহীশূর রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি পিতার নামে নয়, বরং মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত লাভের বছরকে গণনায় এনে মুহাম্মদী সন নামে একটি নতুন সাল প্রবর্তন করেন। এটিই নবী করিম (সা.)-এর নবুওয়াত লাভের স্মারকে উপমহাদেশে প্রথম সন। সম্রাট আকবরের সময় ফসলের মাধ্যমে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে ফসলি সন নামে আরও একটি সন চালু ছিল। এ মাসগুলোর নাম হিজরি মাসের নামেই ছিল। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ও আরাকানে মগি সন নামে আরেকটি সন প্রচলিত ছিল। এটিও হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তনের মতোই। হিজরি সনের আদলে এ অঞ্চলে আরও গড়ে উঠেছিল বিলায়তি সন, আসলি সন, ইলাহী সন প্রভৃতি। এসব সনের উৎপত্তি ও তারিখ গণনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে মহানবী (সা.), নবুওয়াত, ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিষয়গুলো সম্পৃক্ত ছিল।
মোগল সম্রাট আকবর প্রবর্তিত সেই বাংলা নববর্ষই আজ বাঙালিদের প্রাণের অনুষ্ঠান। যে বাংলায় আজ নববর্ষ উদ্যাপিত হচ্ছে একসময় তা ছিল প্রাচীন কৃষিসভ্যতার অংশ। বাংলার কৃষি অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের ছোঁয়া তখনো লাগেনি। নগদ অর্থের প্রবাহ কম থাকায় দোকানদার-মহাজনের সঙ্গে শ্রমজীবী কৃষকেরা বাকি-বকেয়ায় জড়িত হয়ে পড়তেন। সেই বকেয়া শোধের কাঙ্ক্ষিত দিন ছিল পয়লা বৈশাখ। মহাজন-দোকানদারেরা এ উপলক্ষে আয়োজন করতেন বর্ণাঢ্য হালখাতা অনুষ্ঠান। দেনাদারকে চিঠির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে জানিয়ে দিতেন দেনা পরিশোধ করার জন্য। দেনাদারেরাও নানাভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন সে অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য। দেনা শেষে দোকানদার-মহাজনেরা মিষ্টি, দই-সন্দেশ দিয়ে তাঁদের আপ্যায়ন করাতেন। খাজনা পরিশোধের পর প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানোরও রেওয়াজ ছিল।
বঙ্গীয় মুসলমানরা এ সময় ভালো খাবার-দাবারের বন্দোবস্ত করেন। পোশাকপরিচ্ছদেও থাকে পরিপাটির ছাপ। প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার মুসলমানরা ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি পুরোনো ঘরদোরের সংস্কারে নিয়োজিত হন। নীতিমান ব্যবসায়ীরা হালখাতার উৎসবে মেতে ওঠেন। এ ধারাটি এখনো অক্ষুণ্ন আছে মুসলিম সমাজে। মুসলমান ব্যবসায়ীরা বৈশাখের প্রথম দিনে দোকান পরিষ্কার, ঝাড়মোছ করার পর দোয়ার মাহফিল ও মিলাদ শরিফ পড়ানোর বন্দোবস্ত করেন। দেনা-পাওনা মেটানোর পর দেনা পরিশোধকারীদেরও মিষ্টিমুখে বিদায় করার সাংস্কৃতিক রেওয়াজ এখনো মুসলিম সমাজে লক্ষণীয়। লৌকিক বাংলার ধারাবাহিকতায় সিক্ত বাঙালি মুসলমান সমাজে নববর্ষের প্রথম দিনে হতদরিদ্র মানুষের জন্য কাঙালিভোজ ও শিরনি-পায়েস খাওয়ানোর রেওয়াজও ছিল।
আবহমান কাল থেকে বাংলা নববর্ষের সূচনালগ্ন পয়লা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির একটি অনন্য দিন। দেশের প্রতিটি ঘরে বিরাজ করে নবান্নের উৎসবের আমেজ। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ইহলোকিক কল্যাণ ও পরকালীন সফলতার প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতিটি দিন, মাস ও বছর মানুষের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। সময়ের যথার্থ মূল্য দিতে পারলেই কেবল জীবনে সফলকাম হওয়া যাবে। পূর্ব দিগন্তে প্রভাতের সূর্য হাসুক, খুশির বার্তা নিয়ে পাখিরা মুক্ত মনে গান গেয়ে উড়ুক খোলা আকাশে। মুছে যাক ব্যর্থতার সব স্মৃতিচিহ্ন। সূচনা হোক নতুন বছরের। হারিয়ে যাওয়া দিনের প্রাপ্তি প্রত্যাশার হিসাব। স্বপ্নিল আগামী গড়ার দৃঢ়প্রত্যয়ে সূচিত হোক নতুন দিনের, নতুন বছরের। বাংলা সন হোক আমাদের জীবনে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার অনুপ্রেরণা!
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]