গণতন্ত্রে শুধু 'সরকার' থাকবে

বিলেতি সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে শক্তিশালী বিরোধী দলের যে চল আছে, খুব সম্ভবত তার দিন শেষ হতে চলেছে। বাংলাদেশ ও ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনী ফলের নাটকীয় যে চেহারা দেড় দশক ধরে দেখা যাচ্ছে, তা নিশ্চয়ই রাষ্ট্রতাত্ত্বিক, সমাজবিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।
বিরোধী দল সংসদে ও সংসদের বাইরে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবে—‘কেতাবি’ এই ধারণা দিন দিন মার খাচ্ছে। সর্বশেষ দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনও সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিধানসভার ৭০ আসনের মধ্যে আম আদমি পার্টি একাই পেয়েছে ৬৭ আসন। নির্বাচনে কংগ্রেসের বেশির ভাগ প্রার্থী জামানত খুইয়েছেন। মাত্র তিনটি আসন ‘মুখরক্ষা’ তো দূরের কথা মোদি হাওয়ায় উড়তে থাকা বিজেপিকে বড় ধাক্কা দিয়েছে।
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে গত বছর দল ও জোটগতভাবে বিজেপির জয় এতটাই বিশাল ছিল যে বিরোধী দলের ‘মর্যাদা’ পেতে যত আসন দরকার, প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো দলই তা অর্জন করতে পারেনি। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে ৫৪৩ আসনের লোকসভাতেও কেন কোনো দল বিরোধী দলের ‘মর্যাদা’ পায়নি, এর চুলচেরা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু এর সামাজিক কারণ, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ২০০৮ সালের নির্বাচনেও এমনটা দেখা গেছে, সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় ২৩০ ও বিএনপি পায় ৩০টি আসন। ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফলেও এমন আকাশ-পাতাল ব্যবধান দেখা গেছে।
ভালো হোক, মন্দ হোক মানুষ শুধু ‘চরম’ ক্ষমতাবান সরকার দেখতে চায়। সরকারি নীতি-সিদ্ধান্তে বিরোধী দল ‘অহেতুক ষড়যন্ত্র’ খুঁজে রাজপথ গরম করুক, তা দেখতে নারাজ ভোটাররা। তাদের কাছে শাসনব্যবস্থায় সরকারই ‘সব’। সরকার ভুল করলে পরের নির্বাচনে মানুষ তার মোক্ষম জবাব দেবে। তখন হয়তো এর আগের নির্বাচনে ছুড়ে ফেলা সেই বিরোধী দলকেই আবার বেছে নেবে।
পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত সরকারের ভুল নীতি ও সিদ্ধান্তের সমালোচনা হচ্ছে। ব্লগেও মানুষ মতামত জানাচ্ছে। কিন্তু বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে শামিল হচ্ছে না মানুষ, তারাও সে রকম কর্মসূচি দিতে পারছে না।
রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের ভূমিকার এই পরিবর্তন কেন ঘটছে, এটি শাসনব্যবস্থায় কতটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু এই পরিবর্তন যে ঘটতে শুরু করেছে, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। মানুষের মনোজগতের এই রাজনৈতিক পরিবর্তন কি সমর্থনযোগ্য?
লেখক: সাংবাদিক, ঢাকা।