অস্বীকারের রাজনীতি

পয়লা বৈশাখে টিএসসি চত্বরে যে সংঘবদ্ধ যৌনসন্ত্রাসের ঘটনাটি ঘটেছে, সে বিষয়ে পুলিশ প্রশাসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের অস্বীকারের বিপরীতে দেশবাসী বিশ্বাস করেছে ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি লিটন নন্দীর নিজের ভাঙা হাতের সাক্ষ্যে দেওয়া বক্তব্যকে। তাই একজন-দুজন করে জড়ো হতে হতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী-শিক্ষক-সাংস্কৃতিক কর্মীর মানববন্ধন ২০ এপ্রিল কলা ভবন থেকে রাজু ভাস্কর্য হয়ে দোয়েল চত্বর পেরিয়ে কার্জন হল পর্যন্ত উপচে পড়েছে। একটি ছাত্র সংগঠনের ডাকে হাজার হাজার মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, এসব আন্দোলনে দেওয়া বক্তব্য এবং সামাজিক মাধ্যমে নানা প্রজন্মের নারীদের ক্রমেই নিজেদের অভিজ্ঞতার উন্মোচন এক অভূতপূর্ব জাগরণের সূচনা করেছে। সারা দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই বিষয়ে সংহতি জানিয়ে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন অব্যাহত রেখেছে।
অথচ শুরুর দিন থেকেই পুলিশ প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঘটনাটি অস্বীকার করা এবং লিটন নন্দীকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে চাওয়ার মরিয়া চেষ্টা দেখে মনে হয়েছে যেন লিটন নিজের হাতটি ভেঙে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করেছে। এসব অস্বীকারের বিপরীতে সারা দেশ লিটনকেই বিশ্বাস করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার ধারাবাহিক চেষ্টা।
অস্বীকারপর্ব এক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এত বড় একটি আয়োজনে, যেখানে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ হওয়ার কথা, সেখানে আইনশৃঙ্খলা ÿরক্ষাকারী বাহিনীকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এত মানুষের ভিড়ে এমন ঘটনা ঘটা দুঃখজনক ও নিন্দনীয় হলেও এমনটি ঘটে যেতে পারে, সেটিও বোধগম্য। পুলিশ প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে এমন ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। কারণ, চালু থাকা সিসি টিভিতে কন্ট্রোল রুমে বসেই কোথায় কী হচ্ছে দেখে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। লিটন নন্দী বারবার বলেছেন যে তিনি ও তাঁর বন্ধু সুমন, অমিত, তুহিন, সাদ্দাম পুলিশের কাছে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে সোপর্দ করা সত্ত্বেও পুলিশ তাদের ছেড়ে দিয়েছে।
শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রক্টর ঘটনাটিকে অস্বীকার করেছেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন যে লিটন নন্দী ছাড়া এই ঘটনার কোনো সাক্ষী নেই, কোনো নারী তো কোনো অভিযোগ দেননি, এমনকি তিনি পুলিশকে সোপর্দ করার বিষয়ে লিটন নন্দীর দাবিকেও অস্বীকার করার জন্য পুলিশকেই সাক্ষ্য মেনেছেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত তো ছিল যে লিটন নন্দী যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র, যেহেতু তাঁর ভাঙা হাত একটি অস্বাভাবিক ঘটনাকে সাক্ষ্য দেয়, প্রথমে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তিনি পুলিশ প্রশাসনের কাছে জবাবদিহি চাইবেন। এ ঘটনায় লিটন নন্দী তো একজন প্রত্যক্ষদর্শী। কেন তাঁর সাক্ষ্য একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য হিসেবে তিনি আমলে নিতে চাইলেন না, সেটিও বোধগম্য নয়।
অস্বীকারপর্ব দুই: পুলিশ প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে লিটন নন্দীর আনা অভিযোগকে প্রথমে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে মাত্র কয়েক গজের মধ্যে পুলিশ বক্স, একই রাস্তার মাথায় শাহবাগ থানা এবং ১৯টি সিসি টিভি চালু থাকা সত্ত্বেও প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে টিএসসির মতো জায়গায় দিনের আলোতে এমন সংঘবদ্ধ ঘটনার দায় তারা এড়াতে পারে না। কাজেই ঢালাও অস্বীকার করা ছাড়া তাদের উপায় নেই।
ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারী তুহিন দাস বারবার সুনির্দিষ্টভাবে দাবি করে গেছেন পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর আশরাফুল ইসলামের কাছে দুজনকে সোপর্দ করার কথা। প্রথম দিন পুলিশ অস্বীকার করেছে। ডিএমপির রমনা জোনের উপকমিশনার আবদুল বাতেন বলেছেন, এ ঘটনার কি কোনো ডকুমেন্ট আছে বা কোনো ছবি আছে? মাত্র একটি সিসি টিভির ফুটেজ প্রকাশিত হওয়ার পরই ঘটনাপ্রবাহ পাল্টে যেতে থাকে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ইব্রাহিম খান স্বীকার করেছেন যে ‘আশরাফের কাছে যে দুর্বৃত্তকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আশরাফ তাকে ছেড়ে দেন। কারণ, তাঁকে আরেক জায়গায় যেতে হয়েছিল তাঁর সুপারভাইজারের নির্দেশে।’ (দ্য ডেইলি স্টার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৫)
অস্বীকারপর্ব তিন: সিসি টিভির ফুটেজ প্রকাশের পরে পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাগুলোকে যখন আর অস্বীকার করতে পারলেন না, তখন যা দেখা গেছে ফুটেজে, সেসব ঘটনাকে ‘যৌন হয়রানি’ বলতে অস্বীকৃতি জানালেন। ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম বললেন, ‘এ পর্যন্ত কোনো নারীর বস্ত্র হরণের চিত্র পাওয়া যায়নি’, ‘যা পাওয়া গেছে, তা সামান্য ধাক্কাধাক্কি, যৌন হয়রানি নয়’। (দ্য ডেইলি স্টার, ওই) এমনকি তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে লিটন কি একজন আদর্শ নাগরিকের কাজ করেছেন? টিএসসিতে যে পুলিশ ছিল, তাদের সাহায্য কি তিনি চেয়েছেন? ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বললেন, ‘নববর্ষে বিবস্ত্রের কোনো ঘটনা ঘটেনি।’ (সমকাল, ১৯ এপ্রিল) এসব উদ্ধৃতি আর না বাড়াই।
স্বীকৃতিপর্ব: জয়তু ফুটেজ: ঘটনাটি ঘটার একদিন পর্যন্ত গণমাধ্যমে বিষয়টি সেভাবে আসেনি অনলাইন পত্রিকা ছাড়া, তোলপাড় হয়েছে সামাজিক মাধ্যম। তবে ১৬ এপ্রিল থেকে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এ বিষয়ে টক শো এবং লিটন নন্দীর বক্তব্য প্রচার করতে থাকে। ১৭ এপ্রিল থেকে সিসি টিভি ফুটেজ পরীক্ষা শুরু হলে প্রায় সব গণমাধ্যমেই বিষয়টি প্রকাশিত হতে থাকে গুরুত্বের সঙ্গে নাগরিক মতামতসহ। হাইকোর্টের নির্দেশ এ ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দেরিতে হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ২০ এপ্রিল মানববন্ধন ও প্রতিবাদ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডয়েচেভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যৌন নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, তারা বহিরাগত।’ এমনকি আবদুল বাতেন পর্যন্ত ডয়েচেভেলেকে বলেছেন, ‘আমরা সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছি। তাতে পয়লা বৈশাখের দিনে টিএসসিতে নারী লাঞ্ছনার সঙ্গে জড়িত তিন থেকে চারজনকে চিহ্নিত করতে পেরেছি।’
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি: প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকার-অস্বীকারের চাপান-উতোরের মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে লিটন নন্দী যদি তাঁর বন্ধু-সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সেদিনের ঘটনায় রুখে না দাঁড়াতেন, তবে চাপা দেওয়া হতো ঘটনাটি। তাঁদের আন্দোলনের কারণেই গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে সব প্রজন্মের নারীরা জানাচ্ছেন পয়লা বৈশাখে, একুশের বইমেলায়, বসন্ত উৎসবে, বাজারে, গানের কনসার্টে তাঁদের ওপর অহরহ ঘটা যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা, যার কোনো প্রতিকার হয়নি কখনো। এ বছরও টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে বৈশাখী মেলা দেখতে এসে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এ জাতীয় ঘটনা খুব বেশিই ঘটছে। প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ–জাতীয় ঘটনাগুলো চেপে রাখতে চেষ্টা করে মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির কথা চিন্তা করে; দ্বিতীয়ত, এসব অপকর্মের সঙ্গে প্রায়ই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন জড়িত থাকেন, যার সবশেষ উদাহরণ জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বছরের ঘটনা। ২০০০ সালের শুরুর দিনে এই টিএসসিতেই বাঁধন লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছিল। তখনকার সরকারদলীয় এক সাংসদ ঘোষণা দিয়েছিলেন, যদি কোনো মেয়ে থার্টি ফার্স্ট রাতে বাইরে আসে, তবে তার পরিণতিও হবে বাঁধনের মতো। সেই সাংসদকে এই কদর্য বক্তব্যের জন্য আইনের আওতায় আনা হয়নি, আনা হয়নি আইনের আওতায় ১৯৮৯ সালে ডাকসু নির্বাচনোত্তর রোকেয়া ও শামসুন নাহার হল সংসদের বিজয়ী নেতাদের মিছিলে পরাজিত ছাত্রসংগঠনের নেতাদের হামলার। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্যেই প্রশ্রয় পায় এসব অপরাধ।
‘যৌন নির্যাতন’বিরোধী আন্দোলন হলো সেই দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন, যেখানে দলমত-নির্বিশেষে সবার আন্তরিক অংশগ্রহণ প্রয়োজন। নববর্ষের মতো অসাম্প্রদায়িক উৎসবকে বিতর্কিত করার জন্য এবং জনপরিসরে নারীর অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার জন্য ধর্মীয় উগ্রগোষ্ঠীর উসকানি ও প্রচারণা এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে জোরারোপিত হয়। যেমন শফী হুজুর ইতিমধ্যেই এই ঘটনার জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করে শুধু নববর্ষে নারীর অংশগ্রহণ নয়, বরং স্কুল-কলেজে নারীর পড়াশোনাও বন্ধ করতে বলেছেন। তাই রাষ্ট্রও এমন ঘটনায় মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারে না।
অতএব, দাবি পরিষ্কার। প্রথমত, এ ঘটনায় যারাই জড়িত হোক, প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। দ্বিতীয়ত, ঘটনার দিন পুলিশ প্রশাসন ১৩১টি ক্যামেরায় কন্ট্রোল রুমে এসব ঘটনা পরিষ্কারভাবে দেখেও (প্রথম আলো, ২১ এপ্রিল ২০১৫) কেন ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে, সেই বিষয়টিও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তে আসতে হবে, এটি কেবল শাহবাগ থানার এসআই আশরাফুল আলমকে প্রত্যাহার করার মাধ্যমে শেষ হতে পারে না।
উন্মোচিত হোক অস্বীকারের রাজনীতি। জয়যুক্ত হোক জনপরিসর নারীর জন্য বাধাহীন করার আন্দোলন।
ড. কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।