মানুষের ঢাকা কী দাবি করে

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

বাংলা নতুন বছরের প্রথম দুই দিনের দুটো ঘটনা ঢাকা শহরের ক্ষমতাবানদের চেহারাই প্রকাশ করেছে। প্রথম দিনেই বর্ষবরণের উৎসবে যৌনসন্ত্রাসের ঘটনা হয়তো অন্য আরও বহুবারের মতো আড়ালেই থেকে যেত, যদি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না হতো। প্রশাসন এই সন্ত্রাসীদের রক্ষা করার জন্য প্রথম থেকেই যথারীতি চেষ্টা করে যাচ্ছে, প্রতিবাদের বিস্তারের কারণে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে পারছে না। এ ধরনের লোকজন বাদে সবাই স্বীকার করবেন যে ঢাকা শহর বিশ্বের অন্যতম অনিরাপদ শহর, বিশেষ করে নারী ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য শত্রুভাবাপন্ন। নগরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাদের ওপর, তারাই মানুষের সবচেয়ে বেশি ভয়ের কারণ। যৌনসন্ত্রাসের বিদ্যমান সংস্কৃতির সঙ্গে ক্ষমতারোগ যুক্ত হয়ে এখন ভয়ংকর আকার নিয়েছে। বয়স, পোশাকনির্বিশেষে নারী আক্রমণ ও হয়রানির লক্ষ্যবস্তু।
বছরের দ্বিতীয় দিনেই ঘটল অনেক মানুষের অকালমৃত্যুর ঘটনা। ঢাকা শহরে অকালে মানুষ মরছে অহরহ ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দুর্ঘটনা, পেট্রলবোমা, ক্রসফায়ার, গুম, ডাকাতি, নির্মাণকাজ করতে গিয়ে, ম্যানহোলে পড়ে, বস্তি বা কারখানার আগুনে। সর্বশেষ ঘটনা ঘটল শহরের অন্যতম জনবহুল খিলগাঁও আবাসিক এলাকায়। ঢাকা শহরের অংশ হিসেবে দখলের বিষ এখানেও। এলাকায় অনেকগুলো খেলার মাঠ ছিল, সেগুলোর প্রায় সবই বিভিন্ন সরকারের আমলে দখল করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করা হয়ে গেছে। পুরো শহরের মতো এখানেও এখন শিশু-কিশোর-তরুণ ছেলেমেয়েদের জন্য খেলার মাঠ নেই, তাদের জন্য আছে ঘর, ছাদ আর ফুটপাত। গরিব হলে রাস্তা, রেললাইন।
এই এলাকার বাড়তি সম্পদ ছিল একটি বড় ঝিল। তারও অনেকখানি দখল হয়ে গেছে, অদৃশ্য হয়ে গেছে বহুতল ভবনের নিচে। বাকি অংশ আছে দখলের প্রক্রিয়ায়। পুরো শহরেই জমি দখলের সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে দ্রুত বস্তি বানিয়ে তাতে গরিব মানুষকে বসানো। তাতে দখলও থাকে নিয়মিত, পয়সা কামাইও হয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের জন্য ভাড়ায় কিংবা ভয় দেখিয়ে লোক জোগাড়ের জন্য একসঙ্গে লোক পাওয়াও সুবিধা হয়। তারপর যখন প্রয়োজন হয়, যখন কাগজপত্র তৈরি হয়ে যায়, তখন বস্তি ভেঙে ফেলার আয়োজন হয়। বাধা পেলে বা ক্যাচাল হলে লাগে আগুন। তারপর সেখানে ওঠে বহুতল ভবন। বস্তিবাসী সহায়সম্বল হারিয়ে কিংবা পুড়ে মরে সন্তানকে হারিয়ে আবার নতুন কোনো মরণঘরে চলে যায়।
একইভাবে ঝিল দখলের প্রক্রিয়ায় সরকারি দলের নেতা বানিয়েছিলেন অনেকগুলো ঝুপড়ি ঘর, যার বড় অংশ ছিল ঝিলের ওপর বাঁশ দিয়ে
দাঁড় করানো, যা ক্রমে মাটি দিয়ে ভরাট হচ্ছিল। নিয়মিত এই ঘরগুলো থেকে ওই নেতা প্রতি মাসে অর্থ কামাই করতেন, যার ভাগ নিশ্চয়ই আরও অনেককে দিতে হতো। জেলা প্রশাসন, পুলিশ জানতই না যে এটা অবৈধ! রাজউক কোথায় ছিল, সেটাও প্রশ্ন। নিয়মিত অর্থ উপার্জনের উৎস হলেও এসব ঘর টেকসই করতে বাড়তি কোনো খরচে বরাবরই দখলদারদের অনীহা। যার পরিণতিতেই দুর্বল ক্ষয়ে যাওয়া খুঁটি একদিন ধসে পড়েছে। ইতিমধ্যে ১২ জন শিশু-নারী-পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এলাকার মানুষের দাবি, আরও মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ যথারীতি অপরাধীকে এখনো খুঁজে পায়নি!
ঢাকা শহরে কেউ যদি জমি অবৈধ দখল করে, তাহলে তাদের প্রতি পুলিশ বা প্রশাসনের আচরণ বন্ধুসুলভই দেখা যায়। কিন্তু যারা এখানে ভাড়া নিয়ে থাকে, তাদের জীবন অনিশ্চিত ও অিতষ্ঠ করতে তাদের কোনো কমতি থাকে না। এই মানুষদের জীবিকা কী? কোনো কারখানা বা নির্মাণশ্রমিক, গৃহশ্রমিক, পরিবহনশ্রমিক, দিনমজুরি অথবা রেললাইনের ধারে কিংবা ফুটপাতে কিছু নিয়ে বসা। এসব রাস্তা বা ফুটপাত আবার বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে, যারা ফুটপাতে বসার বিনিময়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে। এই চাঁদা আদায়কারীরাই এখানকার মালিক, তাদের সঙ্গে প্রশাসন বা পুলিশের বোধগম্য কারণেই ভালো খাতির। কিন্তু বিভিন্ন কারণে মাঝেমধ্যেই এসব মানুষকে উচ্ছেদে কর্মসূচি নেওয়া হয়। তখন সব পুঁজি শুধু হারাতে হয় না, অনেক সময় ক্ষমতার খেলা বুঝতে না পারা মানুষদের হাজতবাসও ঘটে। ছাড়াতে গিয়ে ঋণ করতে হয় স্বজনদের। যাঁরা পারেন না, তাঁদের কতজন উধাও হয়ে যান, তার কোনো হিসাব নেই।
অর্থনীতির ধরনের কারণেই সারা দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আয়তন বাড়ছে। ঢাকা তার কেন্দ্র। ঢাকার রিকশা, ছোট দোকান, হকার, নির্মাণকাজ সবগুলোই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিত্তহীন শ্রমজীবী নারী-পুরুষের কাজের ক্ষেত্র। ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেশের গড় হারের দ্বিগুণের বেশি। ভোটার সংখ্যা যদিও প্রায় ৪৪ লাখ, কিন্তু মোট জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগই বস্তিবাসী। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী সম্পর্কে শহরের বিত্তবান বা মধ্যবিত্তের খুবই অস্বস্তি। অস্বস্তি দূর করতে তাদের উচ্ছেদ অভিযান প্রায়ই চলে। কিন্তু তা স্থায়ী হয় না। কেননা, এদের ছাড়া কারও চলে না, শহর অচল হয়ে যায়। কিন্তু এই সদা পরিশ্রমী মানুষদের জীবন ঘিরে থাকে অবৈধ বসতি, অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুৎ, অবৈধ পানির অনিশ্চয়তা। তাদের অর্থ দিতে হয় সবটাতেই, হারও বেশি। কিন্তু তা বৈধতা পায় না এবং সেই কারণে নিরাপত্তাও পায় না কখনো।
নাগরিক সুবিধা বা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনেক দূরে থাকলেও জমির দামের দিক দিয়ে ঢাকা মহানগর পাল্লা দিচ্ছে লন্ডন, নিউইয়র্ক, টরন্টোর সঙ্গে। ঢাকার কোনো কোনো অঞ্চলের জমির দাম গত তিন দশকে বিশেষ করে গত এক দশকে যে হারে বেড়েছে, তা ওই সব শহরেও ঘটেনি। এর পেছনে আছে দেশে, বিশেষ করে ঢাকায় চোরাই টাকার দ্রুত বৃদ্ধি ও কেন্দ্রীভবন। এ ছাড়া প্রবাসী–আয়েরও একটি ভূমিকা আছে। জমির দামের এই বৃদ্ধি জমি দখলের উন্মাদনা বৃদ্ধি করেছে বহুগুণ। আইনকানুন প্রতিষ্ঠান সবকিছু ভেঙে পড়ে এখানে। রাজনীতিও জিম্মি হয়ে পড়ে।
ক্ষমতা যেমন কেন্দ্রীভূত, নানা প্রশাসনিক দপ্তর এবং শিক্ষা-চিকিৎসাসহ নানা প্রয়োজনীয় সার্ভিসও এই শহরেই কেন্দ্রীভূত। সেই কারণে মহানগরের দিকে সারা দেশের মানুষের প্রবাহ অবিরাম। কিন্তু এই জনপ্রবাহের একাংশকে ধারণ করার জন্যও ঢাকা প্রস্তুত নয়। ঢাকা শহরে বহুতল ভবন নির্মাণ খুবই দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু পয়োনিষ্কাশন, পানি সরবরাহ, যোগাযোগব্যবস্থার সংগতিপূর্ণ বিকাশ নেই। শহরে সর্বজনের জায়গা ও অধিকারগুলোই বেশি আক্রান্ত বা অবহেলিত। নারীর জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো আরও উপেক্ষিত। অথচ ঢাকা মহানগরের শিক্ষা, কারখানাশ্রমিক, দিনমজুর, অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন পেশায় তাঁদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। পাবলিক টয়লেট, পাবলিক বা সর্বজন পরিবহনের সংকট তাদের প্রতিদিনের জীবন বিষময় করে, দীর্ঘ মেয়াদে শারীরিক–মানসিক ক্ষতির কারণ হয়।
দেশে শিক্ষা ও চিকিৎসা বাণিজ্যিকীকরণের ঢলে এবং দোকানদারি অর্থনীতির বিস্তারে ঢাকার বহিরঙ্গে জাঁকজমক অনেক বেড়েছে। গত দুই দশকে অভূতপূর্ব হারে বেড়েছে বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল ও শপিং মল। কিন্তু বাড়েনি সর্বজনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল। ঢাকার মানুষের স্বার্থ বিবেচনা করলে এত শপিং মল তার দরকার নেই, তার দরকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো বৃহৎ অন্তত ১০টি সর্বজনের হাসপাতাল। ঢাকা ভরে গেছে, রাস্তা অচল হয়ে আছে প্রাইভেট কারে, দরকার সর্বজনের পরিবহনব্যবস্থার বিকাশ হয়নি। দরকার সর্বজনের উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ। ঢাকায় নির্বোধ পরিকল্পনায় আর অর্থ আত্মসাতের নানা প্রকল্পে সৌন্দর্যবৃদ্ধির কর্মসূচিতে লাগানো হয় প্লাস্টিক গাছ, দরকার সর্বত্র অসংখ্য ফলের গাছ, বটগাছসহ বড় গাছ। দরকার শিশুদের আনন্দ ও নিরাপত্তা।
বুড়িগঙ্গায় যদি নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহিত হতে পারে, যদি এই শহরে পানের জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত হয় (বোতলের পানি নয়), তাহলে ঢাকা শহরের মানুষের অসুখ-বিসুখ বিনা খরচেই অর্ধেক কমে যাবে। বুড়িগঙ্গায় এযাবৎ ‘বহু প্রকল্প’ বাস্তবায়ন হয়েছে, কিন্তু নদী দখল এবং বর্জ্যমুক্ত হয়নি। হিসাবে দেখা যায়, এসব প্রকল্পে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। টাকা পানিতে পড়েনি, কিছু লোকের পকেটে গেছে।
ঢাকাকে মানুষের নগর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে দরকার হবে,
প্রথমত, ঢাকা মহানগরের ভূমি সংস্কার। ঢাকায় বসবাসের জন্য কারও একাধিক জমি বা ফ্ল্যাট থাকার দরকার নেই। কম জমি বেশি মানুষের এই শহর আরও দাবি করে পরিবারপ্রতি বসবাসের জমি বা ফ্ল্যাটের আয়তনের সিলিং বা ঊর্ধ্বসীমা। মাথাপিছু ৫০০ বর্গফুট এবং পরিবারপ্রতি সর্বোচ্চ তিন হাজার বর্গফুট প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। তার পরও যদি এটাকে সিলিং ধরা যায়, তাহলে অনেক বাড়তি জমি ও ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে প্রয়োজনীয় আবাসন পরিকল্পনার জন্য।
দ্বিতীয়ত, বিজিএমইএ ভবনসহ অবৈধভাবে নির্মিত স্থাপনা সরিয়ে জমি জলাশয়, খাল দখলমুক্ত এবং পুনরুদ্ধার করে তাতে সর্বজনের অধিকার নিশ্চিত করা আবশ্যক। যেকোনো জমি ব্যবহারে সর্বজনের হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও খেলার মাঠকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাঁচতে হলে বুড়িগঙ্গাসহ সব নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। ফলের গাছে ঢাকা ভরে দিতে হবে।
তৃতীয়ত, এই শহরে যানজট দূর করার সবচেয়ে যৌক্তিক ও কার্যকর পথ হচ্ছে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বজন বা পাবলিক পরিবহন সম্প্রসারণ। সপ্তাহে এক দিন গাড়ি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রাখা দরকার। কোনো পরিবারে একটির বেশি গাড়ি থাকা ঠিক নয়। বাণিজ্যিক এলাকাসহ বেশ কিছু জায়গায় প্রাইভেট গাড়ি চলাচল সব সময়ই নিয়ন্ত্রিত থাকতে হবে।
চতুর্থত, কর্মজীবী ও শিক্ষার্থী নারীর চলাচল ও বাসস্থানব্যবস্থা সম্প্রসারণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নারীর একা পথচলায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতে হবে, সংবেদনশীল নারী পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
মেয়র নির্বাচন হচ্ছে। আমরা সবাই জানি মেয়রের বা সিটি করপোরেশনের ক্ষমতা ও এখতিয়ার খুবই সীমিত। তবে এই নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু এটুকু বলা যায় যে যদি চোরাই টাকা, ছল আর বলে দখলদার কিংবা দখলদারদের প্রার্থী এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়, তাহলে ঢাকা আরও দূষণ ও দখলে বিপর্যস্ত হবে, মানুষের জন্য আরও বৈরী হয়ে উঠবে। ভোটের ফলাফল যা-ই হোক, ঢাকাসহ দেশের প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের জন্য রাজনীতির অনেক পরিবর্তন লাগবে। আমরা কী চাই, তা পরিষ্কার করা ছাড়া এই পরিবর্তন ঘটবে না।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]