ইশতেহারগুলো শূন্যে ঝুলে আছে

আগামীকাল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এই নির্বাচন উপলক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীরা নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছেন। মেয়র প্রার্থীদের নির্বাচনী ইশতেহার ও নানা প্রতিশ্রুতি নিয়ে লিখেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ ।

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের ইশতেহারগুলোর বক্তব্য অনেক কাছাকাছি। রাজনৈতিক দলের ইশতেহারের মতো এতে সবকিছু ঢোকানো হয়েছে। কিন্তু এক দিক থেকে ইশতেহারগুলো নিরর্থক। ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের সম্মতিতে এসব ইশতেহার তৈরি হয়নি। মেয়র যে দলের সমর্থিত, সেই দল কি একে নিজের ইশতেহার মনে করে? এগুলো বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও রূপরেখাও স্পষ্ট করা হয়নি। তাই বলা যায়, ইশতেহারগুলো শূন্যে ঝুলে আছে। এর প্রাসঙ্গিকতা এতটুকুই, যে সমস্যাগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেসব বিষয়ে নগরবাসীও সজাগ। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব সমাধানের দায়িত্ব কতটা সরকারের আর কতটা মেয়রের? সিটি করপোরেশনের আর্থিক সামর্থ্য, প্রশাসনিক সক্ষমতা, আইনগত এখতিয়ার, জনবল ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়েই সমাধানের চিন্তা করতে হবে। মেয়রের এখতিয়ারের অন্তর্ভুক্ত সমস্যার সমাধান মেয়রকেই করতে হবে।
মানুষ যানজট নিয়ে কথা বলে। এর সমাধান পুরোটা সিটি করপোরেশনের হাতে নেই। তবে তারা অবদান রাখতে পারে তিন ক্ষেত্রে: ১. ঢাকার ২০ শতাংশ মানুষ ফুটপাতে হাঁটে। ফুটপাতকে দখলমুক্ত করে হাঁটার উপযোগী করলে যানবাহনের ওপর চাপ কমবে। ২. বাসগুলো কোথায় থামবে, তা নিয়ম করে দিতে হবে। বাস চলাচল সুশৃঙ্খল ও জনবান্ধব করতে হবে। ৩. সব শপিংমল ও বড় প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করাতে হবে। নইলে জরিমানা করতে হবে। ৪. সড়কবাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
আইনে মেয়র কর্তৃপক্ষের যতটা ক্ষমতা দেওয়া আছে, ততটা প্রয়োগ করা হচ্ছে না। আরও ক্ষমতা যে চাওয়া হচ্ছে, সেটা কোথায় হবে? ক্ষমতা থাকলেও নেতৃত্বের গুণাবলি ও দায়বদ্ধতা না থাকলে কাজ হবে না। গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের ক্ষমতা মেয়রের হাতে নেই। আবাসন ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এসব রাজউকের সঙ্গে সম্পর্কিত। রাজউকের উচিত ছিল ভবন নির্মাণের তদারকি করা। অথচ তারা জমি বিক্রি, প্লট তৈরি এমনকি নির্মাণকাজেও নিয়োজিত হচ্ছে। অথচ তাদের মূল কাজ হলো ভবন নির্মাণের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ। তারপর ড্যাপ কারা বাস্তবায়ন করবে? বিআরটিএ গাড়ির লাইসেন্স দিচ্ছে। তাদের গন্ডগোলের কারণে নাগরিক ভোগান্তি পাচ্ছে। কিন্তু নাগরিক তো বিআরটিএ চেনে না, তারা চেনে সিটি করপোরেশন। সুতরাং যার যা কাজ, তা না করলে সিটি করপোরেশন সফল হবে না।
কিছু কাজ মেয়র করবেন আর কিছু কাজ জনগণকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলন আকারে সরকারের কাছে হাজির করবেন। এভাবে কাজ ভাগ করে নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কী কাজ করা যায় তা চিহ্নিত করে প্রচেষ্টা নিতে হবে। যেমন ওয়াসার সঙ্গে কিংবা তিতাস গ্যাসের সঙ্গে।
কতগুলো বিষয় হলো মেয়রের এজেন্ডা না। যেমন ঢাকার চারটা নদীর দূষণ, এগুলো উদ্ধার করতে হবে। এটা সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্ভব না। তা ছাড়া, নগর অবিভাজ্য, ওয়াসা একটা, পুলিশ একটা, রাজউক একটা, কিন্তু সিটি করপোরেশন দুটি। দুজন মেয়রের মধ্যে সমন্বয় কীভাবে হবে, তা স্পষ্ট করতে হবে।
নগর সরকারের দাবি যাঁরা করছেন, তাঁদের রূপরেখা স্পষ্ট করতে হবে। এ শহরে যে ৫৬টি নাগরিক সেবা প্রতিষ্ঠান আছে, নগর সরকার কি এদের সবার ওপরেই কর্তৃত্ব করবে? আলাদা করে ঢাকা বা চট্টগ্রামের জন্য নয়, সমগ্র স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে। সিটি করপোরেশন যদি সঠিকভাবে কাজ করে, তবে সেটাই নগর সরকার। সংবিধানে স্থানীয় সরকারকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে তা কিন্তু স্বশাসিত নগর সরকারের মতোই। কিন্তু আইন সংবিধানে বলা স্থানীয় সরকারের ধারণার মতো না। যেমন এমপিকে স্থানীয় সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা আইনেও নেই, এটা সার্কুলার দিয়ে করা হচ্ছে। এখানে সংবিধান আইন ও সংসদের বাইরে সার্কুলারতন্ত্র চলছে। এভাবে স্থানীয় সরকারকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। নগর সরকারের অনেক মডেল বিভিন্ন দেশে কাজ করছে, এগুলো পর্যালোচনা করে আমরা আমাদের মতো করে বানাতে পারি।
দ্রুত নগরায়িত হচ্ছে বাংলাদেশ, গ্রামেও শহুরে কায়দায় জীবনযাপন হচ্ছে। স্থানীয় সরকারকে তাই আগের কায়দায় না রেখে সারা দেশের জন্যই সমন্বিত নাগরিক কাঠামো দরকার। খালি ঢাকা নিয়ে ভাবলে হবে না, সারা বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে নাগরিকদের মধ্যে সিভিক সেন্স তথা দায়িত্ববোধ সৃষ্টির কথাও। সিটি করপোরেশন ময়লাগুলো সরিয়ে নিয়ে কোথাও ফেলবে, আর নাগরিকেরা কিছুই করবে না, এটা সুষ্ঠু নগর–সংস্কৃতি নয়। যাঁরা ময়লা আবর্জনা ছড়াচ্ছেন তাঁদেরও দায়িত্ব আছে। সিটি করপোরেশনের উচিত মানুষকে বোঝানো, তাদের নগর পরিচালনার কাজে জড়িত করা। তাদের গাড়ি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ডাম্প করছে। ওয়ার্ড পর্যায়ে কতটা ময়লা তৈরি হচ্ছে, সেই ময়লার কত অংশ ওয়ার্ডের মধ্যে নিজেরাই রিসাইক্লিং করবে কি না, ইত্যাকার বিষয়গুলোও ভাবতে হবে।
নির্বাচনের প্রাক্কালে নীরব সহিংসতা চলছে। চাপ, হুমকি ও আতঙ্কের জন্য বিরোধীপক্ষের প্রার্থীরা পোলিং এজেন্ট পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে বেশ কিছু অঘটন ঘটেছে, যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। এখনো বেশির ভাগ ভোটার সিদ্ধান্ত নেননি। এঁরাই নির্ধারক, এঁদের ভোটকেন্দ্রে আনার পরিবেশ সৃষ্টি করা না গেলে এত আয়োজন পুরোপুরি সার্থক হতে পারবে না।
ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সদস্য, স্থানীয় সরকার কমিশন।