দিল্লির বিরুদ্ধে এখন কড়া প্রতিবাদের সময়

আঙ্কন: মাসুক হেলাল
আঙ্কন: মাসুক হেলাল

তিস্তা চুক্তি না হওয়ার বেদনার ভার বাংলাদেশের পক্ষে আরও বেশি সময় ধরে বহন করা যখন অসম্ভব হয়ে পড়ছে, তখন কিনা ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির বহুল প্রত্যাশিত বাস্তবায়নেও নতুন করে অনিশ্চয়তার খবর মিলছে। এটা সত্যি হলে তা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর একটি গুরুতর ক্ষত সৃষ্টি করবে। এটা একটা অভাবনীয় খারাপ খবর। বিষয়টিকে আমরা হয়তো গুরুত্ব দিতাম না, কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজু ১৬ এপ্রিল ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ইকোনমিক টাইমসকে নির্দিষ্টভাবে বলেন, আসামকে বাইরে রেখে সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন হবে। ১৫ এপ্রিল পিটিআই ‘সরকারি সূত্রগুলোর’ বরাতে বলেছে, আসামকে বাদ দিয়ে চুক্তি করতে মন্ত্রিসভার নথি তৈরি হচ্ছে। এসব খবর ছাপা হওয়ার পর দুসপ্তাহ পুরো হতে চলেছে, অথচ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর এ রকম একটি বোমা ফাটানো বিষয়ে উভয় তরফে একপ্রকার নীরবতা পালনই চলছে। বরং আমরা ঢাকায় দায়িত্বশীল সূত্রে বাংলাদেশ আসামকে বাদ দিয়ে চুক্তিতে রাজি বলে ইঙ্গিত পাই, যদিও প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ১৭ এপ্রিল সাংবাদিকদের বলেন, এ রকম কথা তাঁদের জানা নেই।
অনেকে হয়তো বিশ্বাস করতে চান যে আসামের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি এবার সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখছে। সুতরাং সেখানে বিজেপির তথাকথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ ও প্রস্তাবিত সীমান্ত চুক্তি বিরোধিতার প্রকাশ্য কারণ মূলত সে কারণেই। তবে তিস্তা চুক্তির হতাশা নিয়ে এখন তো আমরা বছরের পর বছর, সরকারের পর সরকার কাটিয়ে দেওয়ার পথে রয়েছি। এখন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, ভারতের রাজনীতিকদের সেই আমলাকাতর মহলটি এখনো সক্রিয়, বাংলাদেশকে আস্থায় রাখা দূরে থাকুক, যারা গিভ অ্যান্ড টেক রাজনীতিতে নয়, ‘বড় ভাই’সুলভ আচরণ প্রদর্শনকেই সফল কূটনীতি মনে করে। আর বাংলাদেশও সেটা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিচ্ছে। উভয় পক্ষের এই আচরণ আমাদের ক্ষুব্ধ করছে।
ভারতকে এখন বাংলাদেশের তরফে সাফ জানিয়ে দিতে হবে যে বাংলাদেশের অঞ্জলি অনবরত গ্রহণ করার বিনিময়ে তার স্বার্থকে উপেক্ষার কূটনীতি যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। ভারতের রাষ্ট্রপতির আসনে আমাদের অনেকেরই বিরাট শ্রদ্ধাভাজন প্রণব মুখার্জি রয়েছেন। কংগ্রেস নানা বিষয়ে বিজেপির তাৎক্ষণিক সমালোচনা করতে দ্বিধাহীন। অথচ মোদি সরকারের নেহরু-ইন্দিরার চুক্তি বিরোধিতা কংগ্রেস নেতারা একদম গায়ে মাখছেন না। অরুণাচল থেকে নির্বাচিত ও উত্তর–পূর্ব ভারতে বিজেপি রাজনীতির রাজপুত্তুর খ্যাত কিরণ রিজুর মন্তব্যের বিষয়ে কংগ্রেস নীরবতা পালন করছে।
ভারত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে। বাংলাদেশ তার সুফলও পাচ্ছে। কিন্তু সে ধরনের সুফলের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি বা স্থলসীমান্ত চুক্তি না করার যে ঘাটতি, তা অপূরণীয়। দিল্লিতে মোদি ও নওয়াজ শরিফের করমর্দনের পরের বছরে ভারত পাকিস্তানে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার ও পাকিস্তান ভারতে মাত্র ৪৩০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে। সুতরাং বাণিজ্য-সূচকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুণগত পরিবর্তন যাচাই করা চলে না। প্রতিটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুণগত পরিবর্তনের নির্দেশক হিসেবে কতগুলো মৌলিক বিষয় থাকে, যা প্রায় বিনিময়যোগ্য নয় বলেই চলে। তিস্তার মতো নদীর পানি বণ্টন বা সীমান্ত চুক্তিগুলো হলো সেই মাপের মৌলিক বিষয়। এর বিনিময়ে অন্য কিছু বেশি পেলেও যেখানে সান্ত্বনার কিছু থাকার নয়।
ভারত সব সময় বলেছে, তাদের আর কিছুই চাই না, তাদের যত উদ্বেগ বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে তাদের প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি নিয়ে। বিএনপি-জামায়াত সরকার ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। আর এটা ভারতের সর্বমহলে স্বীকৃত যে, শেখ হাসিনা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে দিয়েছেন। তাহলে ভারত কেন এখন বাংলাদেশকে তার ন্যায্য প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে বাংলাদেশি জনগণের শুভেচ্ছা কুড়াতে এত বেশি দ্বিধান্বিত?
গত বছর প্রথম আলোয় একজন ভারতীয় বিশেষজ্ঞ এসেছিলেন। তাঁকে বলেছিলাম, ভারত তার নিরাপত্তা ও স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থে শেখ হাসিনা সরকারের যে সহযোগিতা পেয়েছে আর সেখানে ভারতের যে সন্তুষ্টি, তার সঙ্গে তুলনীয় সন্তুষ্টি শেখ হাসিনার প্রাপ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তি না করতে পারাটা শেখ হাসিনার জন্য ছিল ‘বিশ্বাসভঙ্গের’ শামিল। তিনি আমার সঙ্গে একমত হননি। এখন মোদি যদি স্থলসীমান্ত চুক্তিকে খণ্ডিতভাবে পাস করিয়ে ঢাকায় আসেন, তাহলে সেটা হবে শূন্য হাতে আসার শামিল, আর তখন বাংলাদেশ তো উজ্জ্বল হাসিতে মুখ ভরাতে পারবে না। আসাম কার্ডটি শেষ পর্যন্ত খেলা হোক বা না হোক, মোদির ঢাকা সফরকে এটা বিতর্কিত করতে পারে। অনেকের মতে শেখ হাসিনার সরকারের দীর্ঘায়ু কামনা করে দিল্লি, কিন্তু স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন থেকেও তাঁকে এখন বঞ্চিত করা হলে সেই দাবি টিকবে না। এমনকি তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া কেবল আওয়ামী লীগের ওপর পড়বে না, ভারতের বন্ধুমহল প্রকাশ্যে কিছু না বললেও এটা তাদের রক্তক্ষরণ বাড়াবে বলেও অনুমান করি। এটা ভারতবিদ্বেষী মহলকে ইন্ধন জোগাবে। বাংলাদেশের নির্দলীয়–নিরপেক্ষ নতুন প্রজন্মকে তা বিক্ষুব্ধ করবে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাবকে চাঙা হতে দেওয়ার বহুবিধ ও নানামাত্রিক নেতিবাচক মাত্রা রয়েছে, যা কেবল দ্বিপক্ষীয় নয়, তার সঙ্গে আঞ্চলিক স্থিতিরও একটা যোগসূত্র রয়েছে। ভারত যদি তা মানে, তবে তাকে তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তি ঠিকঠাকভাবে করতে হবে।
ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজু দাবি করেছেন, আসামকে বাদ দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়ন করা হলে তা ‘উভয় দেশের’ জন্য মঙ্গল ডেকে আনবে। তাঁর যুক্তি আসামে এ নিয়ে ‘বিরাট প্রতিবাদ আছে এবং অনেক সমস্যা আছে’। কিরণ রিজু বোকার স্বর্গে বাস করছেন, কারণ কোনো অর্থেই এ ধরনের পদক্ষেপ ভারত বা বাংলাদেশ কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।
বাংলাদেশের চিহ্নিত ভারতবিরোধী গোষ্ঠীর ভ্রু কুঁচকানো অগ্রাহ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। সত্যি বলতে কী, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় মোর্চাও গতানুগতিকভাবে তা
নাকচ করতে পারেনি। সুতরাং একটু সরলীকরণের ঝুঁকি সত্ত্বেও এটা বলা চলে যে সাতচল্লিশের পর সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে শেখ হাসিনা এমন একটি উচ্চতায় নিয়েছেন, যাকে আগলে রাখা দরকার।
আর তাই ভারত তার নিকটতম প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে মৌলিক সমস্যা মেটাতে যে অন্যায্য আচরণ করে চলছে, তার যতি টানা উচিত। অভ্যুদয়ের জন্য কৃতজ্ঞ বাংলাদেশ এই দুটি বিষয়ে দিল্লির বিরামহীন উপেক্ষার ভার আর বহন করতে পারছে না। ভারত একান্ত না পারলে সেটা খোলাখুলি বলুক। সমুদ্রসীমার সমস্যা মেটাতে তারা পারেনি। সালিসকার মেনেছে। এবারও দরকার হলে সালিসি
হবে। কিন্তু অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতায় তিস্তা চুক্তি না করা, এখন আবার আরেকটি অঙ্গরাজ্যের দোহাই দিয়ে সীমান্ত চুক্তি না
করার কৈফিয়ত দাঁড় করানো ভ্রাতৃপ্রতিম বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি অবমাননাকর। এটা আমাদের সার্বভৌমত্বের অনুভূতিতে আঘাত লাগার শামিল।
নরেন্দ্র মোদি এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজসহ প্রতিটি নির্ভরযোগ্য মহল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে আশ্বস্ত করেছে যে অনতিবিলম্বে তিস্তা না হলেও সীমান্ত চুক্তি হবে। এখন কিরণ রিজুর কথা তো বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার শামিল। আমরা ভাবতেই পারি না, মোদি কী করে খণ্ডিত চুক্তি হাতে বাংলাদেশে তাঁর প্রথম ঐতিহাসিক সফরটি সম্পন্ন করবেন? এ ধরনের পরিস্থিতি এই সফরটি না হওয়ার আশঙ্কাকেই জোরদার করছে।
নুন-নেহরু চুক্তিটা যেন ভারতীয় রাজনীতিকদের ভ্রান্তিবিলাস কিছুতেই যেন ঘুচবার নয়। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৫৮ সালে যখন নুন-নেহরু এই চুক্তিটা করেছিলেন, তখনকার রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ আপত্তি তুলেছিলেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টে বিশেষ রেফারেন্স পাঠান। সে অনুযায়ী ভারত সংবিধানের নবম সংশোধনী এনেছিল। চুয়াত্তরে মুজিব-ইন্দিরার চুক্তির পরে বেরুবাড়ি ও তিনবিঘা নিয়ে ফের ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা হলো। সেই রায়েও চুক্তি সমর্থিত হয়। এতে বলা আছে, দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে ভারতকে অবিলম্বে ওই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। ওই রায়ে আরও স্পষ্ট করা হয় যে ভারত যে জমি বাংলাদেশকে দিচ্ছে, সেটা স্যার রেডক্লিফের কাটাকুটির পরে তা কখনো ভারতের ভূখণ্ড বলে স্বীকৃত হয়নি। তাই পরের জমি পরকেই দিচ্ছে ও বুঝে নিচ্ছে ভারত। তাই কিরণ রিজুর মন্তব্য ওই রায়ের পরিপন্থী। অবশ্য বিরোধী দলে থাকতে বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা বর্তমান অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকেও একই ভুল করতে দেখেছি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে রাজ্যসভার সচিবকে লেখা এক চিঠিতে জেটলি সাংবিধানের মৌলিক কাঠামোর প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ভারতের ভূখণ্ড সংবিধানের অংশ। তাই তার হেরফের সংশোধনের অযোগ্য।’ সুষমার যুক্তি ছিল, ভারত কেন খামোখা এত জমি বাংলাদেশকে দিয়ে দেবে। আসাম এখন একই সুরে বলছে, আমাদের দুই শ একর জমি কমে যাবে! আর বাংলাদেশ কিন্তু ৪১ বছর আগেই সংবিধানে সংশোধনী এনে চুক্তি অনুসমর্থন করে বেরুবাড়ী হস্তান্তর করেছিল।
রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। তিস্তা চুক্তির অভিজ্ঞতা মনে রেখে শেখ হাসিনার সরকারের এ বিষয়ে ভারতের কাছে বিস্তারিত জানতে চাওয়া এবং তা বাংলাদেশের জনগণকে অবহিত করা উচিত। মোদি সরকারের সফরকালে সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তির একটি বিধান বদলাতে ভারতীয় আপত্তি এই মুহূর্তেও বিবেচনায় নিতে আমাদের প্রশাসন ব্যস্ত। অতি তৎপর কর্মকর্তারা ভারতের বিরক্তির কারণ হতে চান না। আসলে দৌড়াতে থাকা বাংলাদেশের জিরিয়ে নেওয়া উচিত। ভারতকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া উচিত, ৪১ বছর অপেক্ষার পরে তার পক্ষে আরও অপেক্ষায় থাকা কঠিন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]