কার নৌকায় কে ডোবে!

পুরান ঢাকার ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে ড্রেনে সিল মারা ব্যালট পেপার
পুরান ঢাকার ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে ড্রেনে সিল মারা ব্যালট পেপার

প্রথমে তাঁরা বিএনপির প্রার্থীর এজেন্টদের তাড়ালেন, তারপর তাড়ালেন সাংবাদিকদের, তারপর তাড়ালেন ভোটারদের... তারপর আর তাড়ানোর কিছু ছিল না। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ততক্ষণে নিজেরাই পলাতক। সেই যে সুকুমার রায়ের ছড়াচরিত্রের অর্ধেকটা বাঘে খেল বলে বাকি অর্ধেকটা সেই দুঃখে মারা গেল। ভোটাধিকার যদি খোয়া যায়, তাহলে গণতন্ত্র তো দূরের কথা, দেশে ন্যায় ও সত্যই বিলুপ্ত হয়।
কী করবেন, পারলে কইরেন
কয়েকটি ঘটনা বাদ দিলে তুমুল উৎসাহ ছিল তিনটি সিটি করপোরেশনেই। সেই উৎসাহ নিয়েই মোহাম্মদপুরের ভোটকেন্দ্রগুলোতে ঘুরতে শুরু করি সকাল নয়টা থেকে। ১০টার দিকে মোহাম্মদপুরের শারীরিক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ঢুকছি। রাজশাহী রেঞ্জের ব্যাজ পরা এক পুলিশ সদস্য আটকালেন। বললেন, ‘সাংবাদিকের সঙ্গে পুলিশ থাকবে।’ এবারে নির্বাচন কমিশন বিধিমালা তৈরি করে সাংবাদিকদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ খুব কঠিন করে দিলেও কোথাও বলা হয়নি যে ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকের সঙ্গে পুলিশ থাকবে। কেবল এতটুকু হলেও কথা ছিল না। ১২০ নম্বর কক্ষে ঢোকা গেল না, বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। ভবনটির নিচতলায় বারান্দার শেষ প্রান্তের ১০১৫ নম্বর কক্ষ। সেখানে তখন লোকজন নিয়ে ঢুকছেন ঘুড়ি মার্কার কাউন্সিলর পদপ্রার্থী। তাঁকে একটু আগে মকবুল কলেজের ভোটকেন্দ্রেও তদারক করতে দেখেছি। তিনি কী করছেন, সেটা দেখতে দরজার বাইরে দাঁড়াতেই রাজশাহী রেঞ্জের রফিক নামের একজন সহকারী পরিদর্শক হাতের ইশারায় ডাক দিয়ে একটা ফাঁকা ঘর দেখিয়ে সেখানে বসে থাকতে বললেন। আমি দায়িত্ব পালনের যুক্তি যতই দেখাই, ততই তাঁর কণ্ঠ চড়তে থাকে। একপর্যায়ে ধাক্কা দিয়ে তিনি আমাকে সেই কক্ষের সামনে থেকে সরিয়েই দিলেন। আর বললেন, ‘কী করবেন, পারলে কইরেন।’

বাস মার্কার নিখোঁজ এজেন্টরা
মোহাম্মদপুর এলাকার অন্তত ১০টি ভোটকেন্দ্রের একটিতেও বাস মার্কার পোলিং এজেন্ট পাওয়া যায়নি। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ঘড়ি মার্কার ব্যাজ নিয়ে ঘোরাঘুরি করা তরুণ, বাইরে দলে দলে ঘড়ি মার্কার সমর্থকদের পদচারণে ভুলেই যেতে হয়—নির্বাচন মানে প্রতিযোগিতা, নির্বাচন মানে একটি পক্ষের দাপট নয়। অনেক ভোটকেন্দ্রের কক্ষের ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করারও সুযোগ ছিল না, তাবিথ আউয়াল বা জোনায়েদ সাকির পোলিং এজেন্টরা আছেন কি নেই! শুধু শারীরিক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের বাইরে কাজ করা বিএনপি-সমর্থক রিয়াদ জানান, গতকাল তাঁদের দুজন এজেন্টকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।

৪০০ টাকার আনসার-ভিডিপি
কাদেরিয়া মাদ্রাসায় অনিয়ম হচ্ছে শুনে বেলা একটার দিকে হাজির হলাম। এদিন যিনিই কোনো ভোটকেন্দ্রে গেছেন, দেখতে পেয়েছেন সাধারণ পোশাকের ওপর আনসার-ভিডিপির লোগো লেখা জ্যাকেট গায়ে একদল নারী-পুরুষকে কাজ করতে। এঁদের মধ্যে ১৫ বছর থেকে ৫৫ বছর বয়সীরাও আছেন। মোহাম্মদপুরের কাদেরিয়া মাদ্রাসায় গিয়ে এমন কয়েকজন ‘আনসার’ পরিচয়পত্র দেখাতে ব্যর্থ হলেন। তাঁদের কাছ থেকেই জানা গেল, এই কেন্দ্রে এ রকম ১৬ জনকে নিয়ে এসেছেন ‘গুলশান আপা’। মাদ্রাসার চতুর্থ তলায় তাঁকে পেলাম। তিনিও ‘পরিচয়হীন’ গৃহিণী। জানালেন, হাসিনা নামের এক নারী তাঁদের ৪০০ টাকা দিন চুক্তিতে এখানে পাঠিয়েছেন। এর বাইরে তাঁরা আর কিছু জানেন না। এখন শুনছি যে কোথাও কোথাও নকল আনসারের মতো নকল পুলিশও নাকি দেখা গেছে। সকালবেলায়ই পুলিশের উদ্ধত হুমকির পর পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়ার সেই সাহস কার থাকে?

ভূমিকম্পাতঙ্ক বনাম ভোটাতঙ্ক
ঢাকাবাসী এদিন ভুলে গিয়েছিল ভূমিকম্পের আতঙ্কের কথা। তার জায়গা নিয়েছিল অন্য এক আতঙ্ক, যার নাম ‘ভোটাতঙ্ক’। ভোটকেন্দ্রগুলো ঘুরে ঘুরে মনে হলো স্বয়ং নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিরাও ভোটারদের ভয় পাচ্ছেন। তরুণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নাজমুল নূরজাহান রোডের বেঙ্গল একাডেমি বিদ্যালয়ে সাত-আটজনের ভোটের সারিতে দাঁড়িয়ে গজগজ করছিলেন, ‘একজনের ভোট নিতে এতক্ষণ লাগে, লাইন আগায় না ক্যান?’ জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বললেন, ‘ভোটারদের স্লিপ ও বুথ খুঁজতে সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে না। একটা ভোট কাস্ট করতে অনেক দেরি নিচ্ছে। আমার ফ্যামিলির মহিলারা তো বিরক্ত হয়ে ভোটই দিতে চাইতেছে না।’
দুপুর ১২টায় বেশির ভাগ বুথেই দু-তিনজনের বেশি ভোটার মিলল না। দোতলায় নারীদের বুথে গিয়ে দেখা গেল, বেশির ভাগ কক্ষে ভোটার নেই, শুধু একটি কক্ষের সামনে ৩০-৪০ জনের ভিড়। তাঁদেরও অভিযোগ, ভোট নিতে দেরি করা হচ্ছে। যাঁরা বাচ্চা কোলে এসেছেন, তাঁরা আর অপেক্ষা করতে রাজি হচ্ছিলেন না। এঁরা ছিলেন অবাঙালি ভোটার। এঁদের প্রসঙ্গেই নাজমুল দাবি করলেন, ‘আগের রাতে তাঁর সামনেই বিহারি ভোটারদের হুমকি দেওয়া হয়েছে যে ভোট দিতে গেলে বিহারি ক্যাম্পের গ্যাস ও পানির সংযোগ কেটে দেওয়া হবে।’
সার্বিকভাবে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে—ভূমিকম্প, যানজট, দূষণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নগরের ভোটাররা যখন সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে উৎসবের আমেজে স্বাগত জানাচ্ছিলেন, তখন সরকারি আয়োজনের লক্ষ্য ছিল ভোটারদের দূরে রাখা। কোনো সরকার যখন নির্বাচনকে ভয় পায়, তখন ভোটারের রায় দেওয়ার সুযোগ কমে। আর দিনের শেষে ভোটার তো দেশেরই নাগরিক এবং ভরসাপ্রার্থী মানুষ। তাঁদের এভাবে তুচ্ছ করে দিলে হয়তো ক্ষমতা জিতবে, কিন্তু সেই ক্ষমতার রাজনৈতিক ভিত্তির মৃত্যু ঘটবে।

কার নৌকায় কে ডোবে!
এক নৌকায় মাঝি আর যাত্রী মিলে দুজন যাচ্ছেন। হঠাৎ যাত্রী চিৎকার করে উঠলেন, ‘নৌকায় তো ফুটা, ডুবতেছে ডুবতেছে!’ সেটা শুনে নৌকার মালিক ওই মাঝি ধমকে উঠলেন, ‘নৌকা ডুবলে আমার ডুবতেছে, আপনার কী? আপনি বয়া থাকেন চুপচাপ।’ এ রকম অবস্থায় চুপচাপ বসে থাকা কঠিন। কারণ, নৌকার মালিক ডুবতে রাজি থাকতে পারেন, কিন্তু নৌকার আরোহী হিসেবে ডুবব তো আমরা সবাই!
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]