শ্রমিক-মালিকের সুসম্পর্ক চাই

ধর্ম
ধর্ম

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক হতে হবে ভাইয়ের মতো। দুই সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যেমন সম্বন্ধ থাকে, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যেও অনুরূপ ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। শ্রমিক মালিকের অর্পিত দায়িত্ব ভাই হিসেবে আঞ্জাম দেবে আর মালিক থাকবে শ্রমিকের প্রতি সহানুভূতিশীল, দয়ার্দ্র ও জনদরদি। মালিক শ্রমিককে কখনো শোষণ, নির্যাতন বা নিপীড়ন করবে না এবং সাধ্যাতীত কোনো কাজের বোঝাও তার ওপর চাপিয়ে দেবে না। অকারণে শ্রমিক ছাঁটাই করে তাদের অসহায়ত্বের দিকেও ঠেলে দিতে পারবে না। নানা ছল-ছুতা ও মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করিয়ে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক ছাঁটাই করা গুরুতর অপরাধ। এমন অন্যায় হস্তক্ষেপ ইসলামে বৈধ নয়। আলাদা করে একজন শ্রমিককে ছাঁটাই করে কাজের সময় কমানোর অর্জন তার কাছ থেকে আলাদা করে কেড়ে নেওয়া যায় বটে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে শ্রমিক শ্রেণিকে বঞ্চিত করা যায় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) মালিকপক্ষকে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তারা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। অতএব, আল্লাহ কারও ভাইকে তার অধীন করে দিলে সে যা খাবে, তাকে তা থেকে খাওয়াবে এবং সে যা পরিধান করবে, তাকে তা থেকে পরিধান করতে দেবে। আর যে কাজ তার জন্য কষ্টকর ও সাধ্যাতীত, তা করার জন্য তাকে বাধ্য করবে না। আর সে কাজ যদি তার দ্বারাই সম্পন্ন করতে হয়, তবে সে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবে।’ (বুখারি)
ইসলামে শ্রমিক ও মালিকের ন্যায্য অধিকার এবং দায়িত্ব-কর্তব্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মালিকের প্রধান কর্তব্য হলো কর্মক্ষম, সুদক্ষ, শক্তি-সামর্থ্যবান, আমানতদার ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে কায়িক শ্রমের জন্য মজুর নিয়োজিত করা এবং সময়, কার্যকাল ও মজুরি নির্ধারণ করে শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করা। অন্যথায় শ্রমিক-মালিক চরম অসন্তোষ, বিক্ষোভ ও আন্দোলন দেখা দেয় এবং উৎপাদন দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়। তাই মালিকের উচিত শ্রমিকের কাছ থেকে এতটুকু কাজ আদায় করে নেওয়া, যতটুকু সে অনায়াসে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারে এবং যা তার সামর্থ্যে কুলায়। এমন কিছু তার দ্বারা জোর-জবরদস্তিমূলক কাজ করাতে পারবে না, যার ফলে তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে এবং দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়। একজন সৎকর্মশীল শ্রমিকের কর্মে নিযুক্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তোমার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।’ (সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ২৬)
শ্রমের ব্যাপারে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে অবশ্যই লিখিত চুক্তি সম্পাদন করে নেওয়া উচিত। তাহলে শ্রমিক থেকে কাজ উশুল করে নেওয়ার পূর্ণ অধিকার মালিকের জিম্মায় থাকবে এবং শ্রমিক তার মালিকের কাছে কাজের জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। আবার কোনো শ্রমিককে এক কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ করে তার সম্মতি ছাড়া অন্য কোনো কঠিন কাজে নিয়োগ করাও বৈধ নয়। শ্রমিকদের মজুরি প্রাপ্তির বিষয়ে হাশরের ময়দানে মালিকের জবাবদিহি সম্পর্কে নবী করিম (সা.) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন: আমি রোজ হাশরে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়ে প্রকাশ্যে অভিযোগ উত্থাপন করব। তন্মধ্যে তৃতীয় সেই ব্যক্তি যে কাউকে মজুর হিসেবে খাটিয়ে ও তার দ্বারা পূর্ণ কাজ আদায় করা সত্ত্বেও শ্রমিকের মজুরি দেয়নি।’ (বুখারি)
শ্রমিকের প্রাপ্য বেতন-ভাতা বা মজুরি যতক্ষণ পর্যন্ত স্থিরীকৃত না হবে এবং সন্তুষ্ট মনে সে তা গ্রহণ না করবে, ততক্ষণ বল প্রয়োগ করে তাকে কাজে নিযুক্ত করা ইসলামসম্মত নয়। যে শ্রমিকেরা তাদের কায়িক শ্রম দিয়ে সুরম্য প্রাসাদ ও অট্টালিকা নির্মাণ করে বা খাদ্য উৎপাদন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করে, দেখা যায় তারা ন্যূনতম মজুরিও অনেক সময় পায় না। তাই ন্যূনতম মজুরি প্রত্যেক শ্রমিকের প্রয়োজন ও কর্ম অনুসারে নির্ধারিত হবে। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকেরা কাজ করে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। তার শ্রমশক্তিকে সে বিক্রি করে মজুরির বিনিময়ে। প্রাপ্ত মজুরি দিয়ে সে তার ক্ষয়ে যাওয়া শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদন নিশ্চিত করতে তার নিজের ও পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণ, শিক্ষা-চিকিৎসা, মাথা গোঁজার ঠাঁই ইত্যাদির ব্যবস্থা করে। তাই শ্রমিককে কমপক্ষে এমন ন্যায্য মজুরি দিতে হবে, যাতে সে এর দ্বারা তার ন্যায়ানুগ ও স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিয়োগ করতে নিষেধ করেছেন।’ (বায়হাকি)
ইসলামি শ্রমনীতি অনুযায়ী হাটে-মাঠে-ঘাটে, কল-কারখানায় খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ তথা কৃষক, শ্রমিক বা কোনো কর্মজীবীকে কেউ বিনা পারিশ্রমিকে খাটাতে পারবে না। কায়িক শ্রমের ন্যায়সংগত পারিতোষিক অবশ্যই তাদের যথাসময়ে দিতে হবে। নবী করিম (সা.) কোনো দিন শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরি কম দেননি। তিনি শ্রমজীবীদের যেসব অধিকার নির্ধারণ করেছেন, তন্মধ্যে শ্রমিককে শুধু তার পূর্ণ মজুরি প্রদান করাই যথেষ্ট নয়, বরং যতটা সম্ভব ত্বরিত পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে। কেউ অতিরিক্ত বা অতি উত্তম কাজ করলে তারও প্রকৃত মজুরি বা সে জন্য ঘোষিত পুরস্কার লাভের অধিকার রয়েছে। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি প্রদান সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দিয়ে দাও।’ (ইবনে মাজা)
কৃষক, শ্রমিক, মজুর ও মেহনতি মানুষ নিজেকে কখনো হীন মনে করবে না, পক্ষান্তরে মালিকও নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করবে না। বরং মালিক থাকবে শ্রমিকের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল, সহমর্মী, দয়াবান ও দরদি। উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরস্পরকে পরিপূরক মনে করতে হবে। তাই শ্রমিকেরা যেমন ন্যায্য মজুরি পাওয়ার অধিকারী, তেমনি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত লোকেরা নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতন-ভাতা এবং পুঁজি মালিক উদ্যোক্তারা ন্যায়সংগত মুনাফা লাভের অধিকারী। বস্তুত কর্মঘণ্টা নির্ধারণ ও ন্যায্য মজুরির বিষয়ে মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, অসন্তোষ ও আয়বৈষম্য বর্তমান পৃথিবীতে বিড়ম্বিত ও বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে, এর সঠিক সমাধান এবং উভয়ের মধ্যে ইনসাফপূর্ণ সমন্বয় একমাত্র ইসলামি জীবনব্যবস্থার আলোকে শ্রমিক-মালিক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমেই নিরসন করা যেতে পারে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]