মানবতাবাদী গৌতম বুদ্ধ

রাজপ্রাসাদে নয়, লুম্বিনী নামক উদ্যানে হয়েছিল তাঁর জন্ম। জন্মের পর নবজাতককে এক নজর দেখার জন্য রাজপ্রাসাদে জনতার ঢল নামে। হিমালয়ের গভীর অরণ্য থেকে এলেন ঋষি অসিত। তিনি শিশু রাজকুমারকে দেখে অভিভূত হয়ে প্রথমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তৎপর তাঁর দুই চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। ঋষির চোখে অশ্রু দেখে রাজা বিচলিত হয়ে বিনীতভাবে হর্ষ-বিষাদের কারণ জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে ঋষি বলেন, ‘মহারাজ! এই কুমার মহাজ্ঞানী বুদ্ধ হবেন। জগতে দুঃখ মুক্তির পথ প্রদর্শন করবেন। এ জন্য আমি উচ্ছ্বসিত হয়েছি। কিন্তু আমি বয়োবৃদ্ধ। তাঁর দুঃখ মুক্তির অমিয়বাণী শোনার সৌভাগ্য আমার হবে না। তৎপূর্বে আমার মৃত্যু হবে। এ জন্য মন বিষণ্ন, দুঃখভারাক্রান্ত।’ ভবিষ্যদ্বাণী শুনে রাজা বিষণ্ন হলেন।
একমাত্র পুত্র গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হবে এই চিন্তায় রাজা সারা দিন অস্থির থাকতেন এবং দিনরাত রাজকীয় ভোগ-ঐশ্বর্যে পুত্রকে আবিষ্ট করে সংসারমুখী করার চেষ্টা করতেন। তাঁকে বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ করালেন। কিন্তু জগতের কোনো রূপ-রস তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারল না। কীভাবে মানুষকে ক্রমবর্ধমান দুঃখের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি দেওয়া যায় সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অর্থাৎ জগতের দুঃখের কারণ অনুসন্ধানে তিনি ২৯ বছর বয়সে অবলম্বন করেন সন্ন্যাসজীবন।
সুদীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনায় তিনি ৩৬ বছর বয়সে আর এক বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধগয়ার বোধি বৃদ্ধের নিচে লাভ করেন বোধি জ্ঞান, জগতে খ্যাত হন বুদ্ধ নামে। জন্মের মতো তাঁর বোধিপ্রাপ্তিও ঘটেছিল প্রকৃতির সান্নিধ্যে। বোধি জ্ঞান লাভের মধ্যে দিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন জগতের প্রকৃত স্বরূপ ‘দুঃখময়তা’। তিনি আবিষ্কার করলেন জগতে দুঃখ যেমন আছে, তেমনি দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের নিরোধ আছে এবং দুঃখ নিরোধের উপায়ও আছে। তিনি দুঃখের স্বরূপ বিভাজন করে ঘোষণা করলেন, মানুষ জগতে আট প্রকার দুঃখ ভোগ করে। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, অপ্রিয় সংযোগ, প্রিয় বিচ্ছেদ, ইচ্ছিত বস্তুর অপ্রাপ্তি এবং পঞ্চ স্কন্ধের সমন্বয়ে গঠিত দেহই দুঃখের আকর বা দুঃখ প্রদায়ক। রক্ত-মাংসের দেহধারী মানুষ অবশ্যই এ আট প্রকার দুঃখ কোনো না কোনোভাবে ভোগ করে। দুঃখের ব্যবচ্ছেদের পাশাপাশি তিনি দুঃখের কারণও ঘোষণা করলেন। তিনি মানবজাতির দুঃখভোগের পেছনে ১২ প্রকার কারণ নির্দেশ করেন। এ ১২টি কারণ বৌদ্ধ সাহিত্যে দ্বাদশ নিদান নামে পরিচিত।
উপযুর্ক্ত ধর্ম-দর্শন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বুদ্ধের চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রে ছিল মানুষ। তাঁর প্রচারিত ধর্ম-দর্শনের আলোচ্য বিষয় মানুষ, মানবতা এবং মানুষের কল্যাণ সাধন। তাই তাঁর দর্শন মানবতাবাদী দর্শন হিসেবে খ্যাত। তাঁর দর্শনে অতিন্দ্রিয় সত্তা বা ঈশ্বরের কোনো উল্লেখ নেই। আছে মানুষ, মানুষের দুঃখ এবং দুঃখ মুক্তির নির্দেশনা। তাই তাঁর দর্শন মানবতাবাদী দর্শন হিসেবে খ্যাত। অধিবিদ্যাসংক্রান্ত বিষয়ে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। তাই ঈশ্বর বিষয়ে তিনি নীরব ভূমিকা পালন করতেন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ শাশ্বত বা অশাশ্বত, সন্ত বা অনন্ত, মৃত্যুর পর আত্মা থাকে বা থাকে না, দেহ ও আত্মাÄ এক নাকি ভিন্ন প্রভৃতি প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে যেতেন। তাঁর মতে, ‘কেউ তিরবিদ্ধ হলে প্রথম কাজ হচ্ছে তির উত্তোলন করা, চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া এবং ওষুধসেবনপূর্বক তাঁকে আরোগ্য করা। তা না করে কে তির মারল, কোন দিকে থেকে তির নিক্ষিপ্ত হলো, তিরের ফলায় কী ধরনের বিষ ছিল প্রভৃতি অনুসন্ধান করতে গেলে তিরবিদ্ধ মানুষটির মৃত্যু ঘটবে।’ তিনি আরও বলেন, ঈশ্বর আছে কি নেই, জগৎ শাশ্বত বা অশাশ্বত, আত্মা মৃত্যুর পর থাকে কি না প্রভৃতি প্রশ্নের উত্তরের প্রয়োজন নেই। দুঃখে জর্জরিত মানুষের দুঃখ মুক্তির জন্য এগুলো অর্থহীন। বরং দুঃখের কারণ ও তার প্রতিকারের উপায় জানাই অধিক প্রয়োজন।
তাই তিনি অতিপ্রাকৃত বিষয়াদির বদলে প্রকৃতিকে জানা এবং মানবীয় সমস্যাবলি সমাধানের ভারও মানুষের ওপর ন্যস্ত করেছেন। তাঁর মতে, ‘মানুষের মুক্তির জন্য মানুষই যথেষ্ট। মানুষ নিজেই নিজের ত্রাণকর্তা, নিজেই নিজের প্রভু এবং নিজেই নিজের আশ্রয়। মানুষ প্রজ্ঞাযুক্ত এক বিরাট সম্ভাবনাময় সত্তা এবং নিজেই সবকিছু করার অধিকার রাখে।’ তাই বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের উপদেশস্বরূপ বলেছিলেন, ‘আত্মদ্বীপ প্রজ্বলিত করে নিজের মুক্তির পথ পরিষ্কার করো, আত্মশরণ নাও, অন্যের ওপর নির্ভর করো না।’ ব্যক্তিস্বাধীনতা বা আত্মশক্তির প্রাধান্য সম্ভবত প্রাচ্যের দর্শনে বুদ্ধই প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন। ‘অতিপ্রাকৃত সত্তা বা ঈশ্বরের সাহায্য ছাড়া মানুষ তাঁর কর্মের মাধ্যমে দুঃখ থেকে হতে মুক্তি লাভ করতে পারে’—এ ঘোষণার মাধ্যমে তিনি মানুষের মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে মানবতার জয়গান গেয়ে গেছেন, যার অনুরণন দেখতে পাই কবির ভাষায়—‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’।
মৈত্রী করুণা বা প্রেম ভালোবাসা বুদ্ধের ানবতাবাদের প্রকৃষ্ট দিক। তাঁর হাতে ছিল মানবপ্রেমের বাঁশরি, কণ্ঠে ছিল মৈত্রী-করুণার অমৃতবাণী এবং লক্ষ্য ছিল সাম্য ও ন্যায়ের ধর্ম বিতরণে। বুদ্ধ আত্মজয়কে শ্রেষ্ঠ জয় বলে নির্দেশ করেছেন। তিনি হিংসাকে অহিংসা দিয়ে, শত্রুকে মৈত্রী দিয়ে জয় করার উপদেশ দিয়েছেন। হিংসাত্মক মনোভাব মানুষকে উত্তরোত্তর সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। এই মহামন্ত্রই সেদিন ভারতবর্ষকে বিশ্বের সঙ্গে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল। এই দীক্ষা নিয়ে সম্রাট অশোক চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত হয়েছিলেন। দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে উন্মত্ত এ পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধের মানবতাবাদী দর্শনের অনুশীলন একান্ত প্রয়োজন। শুভ বুদ্ধপূর্ণিমায় কামনা হোক ‘হিংসা নয়, শত্রুতা নয়, যুদ্ধ নয়, জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক, দুঃখ মুক্ত হোক’।
ড. দিলীপ কুমার বড়ুয়া: সাবেক সভাপতি, পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, সেন্টার ফর বুড্ডিস্ট হেরিটেজ এবং কালচার, ঢাবি।