মাতৃভক্তি সুসন্তানের নিদর্শন

ধর্ম
ধর্ম

দুনিয়াতে একজন মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের যত নিবিড় সম্পর্ক হতে পারে, মা ও শিশু এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির টান। জন্মের পর থেকেই মানবসন্তান মুখ দিয়ে আহার গ্রহণ করে আর মাতৃগর্ভে থাকতে নাড়ির সাহায্যে আহার করে; তাই মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির সম্পর্ক। মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলার কী অপার সৃষ্টি মহিমা! মাতৃগর্ভে সন্তান তার প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টি নাড়ির সাহায্যে গ্রহণ করে। কারণ, সেখানে তার কোনো অঙ্গেরই পূর্ণ কার্যক্রম চালু হয় না। পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হলেই নাড়ির সম্পর্ক কেটে যায়, তখন আসে মাতৃক্রোড় বা কোলের সম্পর্ক। যার অশেষ স্নেহ-মায়া-মমতায় পৃথিবীর আলো-বাতাস চিনতে শেখে প্রতিটি মানবসন্তান, সেই মমতাময়ী মায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের নির্দেশনা দিয়ে একজন মায়ের গর্ভকালীন কষ্টের কথা আল্লাহ তাআলা ব্যক্ত করেছেন, ‘আমি তো মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি, জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে, সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (সূরা লুকমান, আয়াত: ১৪)

মানবজীবনকে সুন্দর ও সফল করতে যিনি আত্মপ্রত্যয় জাগিয়ে তুলতে পারেন তিনিই হলেন ‘মা’। মায়ের আত্মত্যাগ আর অকৃত্রিম স্নেহ-মমতা নবজাতককে নিরাপদ করে, সন্তানের সুকুমার বৃত্তিকে জাগ্রত করে। শিশু তার মায়ের কোলেই সর্বাধিক নিরাপদ, পরম আনন্দে-নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে। সন্তান জন্ম দিতে মা যে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেন, শিশুকে লালন-পালন করতে যে সীমাহীন ধৈর্যধারণ করেন, নিজের সুখ যিনি সন্তানের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দেন, মায়ের সেই ভূমিকাকে অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘...তার জননী তাকে গর্ভে ধারণ করেন কষ্টের সঙ্গে এবং প্রসব করেন কষ্টের সঙ্গে, তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার স্তন্য ছাড়াতে লাগে ৩০ মাস, ক্রমে সে পূর্ণ শক্তিপ্রাপ্ত হয়।’ (সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ১৫)
আল্লাহ তাআলা মায়ের অন্তরে সন্তানের প্রতি সৃষ্টি করেছেন এক পরম মমত্ববোধ। সন্তান গর্ভে ধারণ করা থেকে অপরিসীম কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগের পর প্রসব। অতঃপর সন্তানের মুখে ‘মা’ ডাক তাঁকে ভুলিয়ে দেয় দীর্ঘ দিবস-রজনীর সেই অসীম যাতনা। সন্তানকে মানুষ করার ব্যাপারে মায়েরা কখনো কোনো স্বীকৃতির প্রত্যাশা করেন না, বুকের ধন নিজেই আগলে রাখেন। সন্তানের জীবনে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেন, এমনকি সাধ্যাতীত মনে হলেও সন্তানকে মানুষ করার ব্রত পরিত্যাগ করেন না। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিকূলতা, দুঃখ-কষ্ট থেকে প্রাণ দিয়ে তিনি বড় করে তোলেন শিশুকে। আর সে জন্যই সৃষ্টির শুরু থেকেই মায়ের ভূমিকা অনন্য উজ্জ্বল। মাকে মহিমান্বিত করে প্রকৃতপক্ষে নারী জাতির মর্যাদাকেই ইসলাম সমুন্নত করেছে এবং মাতৃত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীকে দিয়েছে সম্মানজনক মর্যাদা। সন্তানের সার্বক্ষণিক কল্যাণ কামনায় মায়েরা অনেক ত্যাগ ও যথাসম্ভব কষ্ট সহ্য করেন। তাই সন্তানকে সুস্থ ও সৎ মানুষ রূপে গড়ে তোলার জীবন সাধনাকে অম্লান করতে রাসুলুল্লাহ (সা.) মায়ের সুউচ্চ মর্যাদা ঘোষণা করে বলেছেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ (আহমাদ, নাসাঈ)
আল্লাহ পাক নারী জাতিকে মায়ের মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। গর্ভধারিণী মা তাঁর মাতৃত্বের কারণে সন্তানের ভক্তি, শ্রদ্ধা, সম্মান ও সদাচরণ পাওয়ার বেশি হকদার। তাই ‘মা’ নারী ও পুরুষ সব সুসন্তানের কাছে মর্যাদার স্বর্ণ শিখরে অধিষ্ঠিত। বাল্যকালে মাতৃহারা হওয়ায় নবী করিম (সা.) পরিণত বয়সে মায়ের সান্নিধ্য পাননি। মায়ের সেবা করতে না পারার আফসোস তাঁর অন্তরে সর্বদা পীড়া দিত। এ জন্য তিনি দুধমাতা বিবি হালিমা (রা.)-কে নিজের গায়ের চাদর বিছিয়ে দিয়ে মাতৃভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন। সন্তানের ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কোমল ব্যবহার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মাকে তিন গুণ অগ্রাধিকার দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, অতঃপর মাতার সঙ্গে, অতঃপর মাতার সঙ্গে, অতঃপর পিতার সঙ্গে, অতঃপর নিকট-আত্মীয়ের সঙ্গে।’ একদা এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করল, আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি অধিকারী কে? তিনি বললেন, তোমার মা। তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। তারপর? তিনি বললেন, তোমার মা। তারপর? তিনি চতুর্থবার বললেন, তোমার পিতা।’ (বুখারি)
পরিবারে সুসন্তানের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই মাতৃভক্তি তথা মাতাপিতা উভয়ের প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও আন্তরিক ভালোবাসা জ্ঞাপন করা বাঞ্ছনীয়। তবে বিশেষ কোনো দিনে বা বিশেষ কোনো সময়ে নির্দিষ্টভাবে কোনো উপহারসামগ্রী বা পানাহারের ব্যবস্থা করলে এতে আপত্তির কিছু নেই কিন্তু তা যদি প্রথা না হয়ে যায়। যদিও মা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য মাকে যথাযথ সম্মান দেওয়া, তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। অথচ অন্য সময়ে আমরা ভুলে যাই মায়ের অপরিসীম ত্যাগের কথা। যিনি নিজের বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন, যে মায়ের বুকের দুধে সন্তান জীবন ধারণ করেছিল, যাঁর স্বপ্ন ছিল সন্তানকে ঘিরে, সেই মাকে সন্তানেরা পরিণত বয়সে যথেষ্ট অবহেলা করে। যে সময়ে মাকে একটু সাহস দিতে হয়, জীবনসায়াহ্নে তাঁর একাকিত্বকে দূর করতে হয়, একটু সাহচর্য দিতে হয়, সেই সময়ে মানুষ নিজের সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। বেমালুম ভুলে যায় গর্ভধারিণী মায়ের কথা!
যারা আজ সন্তান, যারা সবল জীবনের অধিকারী, কখনো কি তারা ভেবে দেখেছে, তাদেরও একদিন বার্ধক্যের করুণ জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে? প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় নিয়মে সব প্রাচুর্যের মধ্যেও অসহায়ত্বকে বরণ করতে হবে! বেঁচে থাকার জন্য যৌবনে যতই পরিশ্রম করা হোক না কেন, বৃদ্ধ বয়সে অন্যের সহায়তা ছাড়া চলা যাবে না। পারিবারিক পরিবেশ ছাড়া একজন মানুষ একাকী বাঁচতে পারে না। বৃদ্ধাশ্রম যতই সুন্দর হোক, মনে শান্তি দেয় না! সন্তানরা কি এমতাবস্থায় নিজেকে নিয়ে উপলব্ধি করার সামান্যতম চেষ্টা করছে? তাই আত্মোপলব্ধি নিয়েই মাতৃভক্তি দ্বারা সুসন্তানের নিদর্শন প্রকাশ করতে হবে। যেই মা তাঁর জীবনের সুদীর্ঘ সময় সন্তানকে দিয়েছেন, সেই মা যখন বৃদ্ধ বয়সের ভারে একটা শিশুতে পরিণত হন, তখন সন্তানের কী দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের আছে তা ভেবে দেখা উচিত। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই পৃথিবীর সব মাকে। মাতৃভক্ত সুসন্তানের তত্ত্বাবধানে সব মায়েরা ভালো থাকুন!
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]