আরিফ-মান্নান-বুলবুল বরখাস্ত, নূর হোসেন বহাল!

মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, আরিফুল হক চৌধুরী, এম এ মান্নান, নূর হোসেন
মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, আরিফুল হক চৌধুরী, এম এ মান্নান, নূর হোসেন

আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু আইনের রক্ষক সরকার যে সেটি মানে না, তার প্রমাণ স্থানীয় সরকার সংস্থার জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে তাদের দ্বৈতনীতি ও সিদ্ধান্ত। সিলেট ও গাজীপুরের পর রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে সরকার। তাঁর বিরুদ্ধে আদালত পাঁচটি মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করায় স্থানীয় সরকার বিভাগ এ আদেশ জারি করেছে। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সরকার বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এর ধারা ১২ অনুযায়ী তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এর আগে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও গাজীপুরের মেয়র এম এ মান্নানকেও সরকার আইনের একই ধারায় সাময়িক বরখাস্ত করে। আরিফুল হক চৌধুরী সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হিসেবে বর্তমানে কারাগারে আছেন। এম এ মান্নানকে আসামি করা হয়েছে গাজীপুরের বোমা হামলা ও গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায়। তিনিও কারাগারে এবং দুই দফায় রিমান্ডে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। কুমিল্লা ও বরিশালের মেয়র সরকারি দলের সঙ্গে ‘আপস’ করে চলেন; ভয় কখন পদ চলে যায়।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো যে নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগের হয়েও নানা রকম হয়রানির শিকার। তাঁর বিরুদ্ধে সাংসদ শামীম ওসমানের (যাঁর বিরুদ্ধে তিনি লক্ষাধিক ভোটে জয়ী হয়ে মেয়র হয়েছিলেন) আনা অভিযোগ তদন্ত করছে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি। অন্যদের বিরুদ্ধে এর চেয়ে গুরুতর অভিযোগ এলেও আমলে নেওয়া হয় না।
সরকার নানা অজুহাতে বিএনপির তিনজন মেয়রকে সরিয়ে দিলেও নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত হত্যার প্রধান আসামি নূর হোসেন ও তাঁর সহযোগী শাহজালাল বাদলের বিষয়ে একেবারে নিশ্চুপ। তাঁরা দুজনই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর। পর পর চারটি মাসিক সভায় অনুপস্থিত থাকায় তাঁদের বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে গত অক্টোবরে চিঠি দেয় সিটি করপোরেশন। আইন অনুযায়ী, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হলেও স্থানীয় সরকার বিভাগ গত ডিসেম্বরে সিটি করপোরেশনকে পলাতক দুই কাউন্সিলরের মামলার পূর্ণাঙ্গ তথ্য এবং তাদের বিরুদ্ধে করণীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠানোর চিঠি দেয়। ২০০৯ সালে প্রণীত স্থানীয় সরকার আইনের মেয়র ও কাউন্সিলর অপসারণ প্রসঙ্গে ১৩-এর (ক) ও (খ) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তিসংগত কারণ ব্যতিরেকে সিটি করপোরেশনে পর পর তিনটি মাসিক সভায় অনুপস্থিত থাকলে কাউন্সিলর পদ থেকে অপসারণযোগ্য হবেন। এ ছাড়া নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হলেও তিনি অপসারণযোগ্য হবেন।
নূর হোসেন রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থ ও র্যা বের কর্মকর্তাদের দিয়ে কী নৃশংসভাবে সাতজন মানুষকে খুন করেছেন, তা দেশের মানুষ ভুলে যায়নি। নারায়ণগঞ্জ গেলে সেই সাত পরিবারের সদস্যদের আহাজারি এখনো শোনা যায়। সাত খুনের পর এই নূর হোসেনকে ধরিয়ে দিতে সরকার এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। দ্রুততম সময়ে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। কিন্তু গত এক বছরেও তাঁকে দেশে আনার কার্যকর উদ্যোগ নেই। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আইনি জটিলতার কথা বলেছেন। আসামের উলফা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যদি সরকার সব আইনকানুন উপেক্ষা করে ফেরত দিতে পারে, নূর হোসেনের মতো দাগি ও দণ্ডিত আসামিকে কেন ফেরত আনতে পারবে না? নূর হোসেনের বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন। দুটি মামলায় তাঁর শাস্তিও হয়েছে। তার পরও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশনের কাছে নূর হোসেনের সম্পর্কে তথ্য জানতে চায়। নূর হোসেনকে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহায়তাকারী প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই এখন কলকাঠি নেড়ে তাঁর কাউন্সিলর পদ রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। তাঁর অপরাধের খতিয়ান যে সিটি করপোরেশনের কাছে নয়, পুলিশের কাছে থাকে, এটাও নিশ্চয়ই মন্ত্রণালয়ের জানার কথা।
ইতিমধ্যে পুলিশ সাত খুনের মামলার চার্জশিট দিয়েছে এবং তাতে নূর হোসেনসহ ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। র্যা বের তিন কর্মকর্তা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, কীভাবে নূর হোসেন এই খুনের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে তাঁদের ব্যবহার করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২২টি মামলা ও দুটি জিডি রয়েছে। এর মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলায় তিন বছর, অবৈধভাবে বন্য প্রাণী রাখার দায়ে এক বছর কারাদণ্ড হয়েছে। কাউন্সিলর শাহজালাল বাদলের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা রয়েছে। সাত খুনের পরে গত মে মাসে জেলা প্রশাসন নূর হোসেন, শাহজালাল বাদল ও তাঁদের সহযোগীদের ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে।
যেসব অভিযোগে রাজশাহী ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে, এর চেয়ে অনেক গুরুতর অভিযোগ নূর হোসের বিরুদ্ধে থাকা সত্ত্বেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া রহস্যজনক। একযাত্রায় ভিন্ন ফল কেন? অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিএনপি-জামায়াত জোট পরিচালিত আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ মারা, বাস-ট্রাক জ্বালিয়ে দেওয়া, ট্রেনে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসব ঘৃণ্য অপরাধ যারা সংঘটিত করেছে, তাদের কজনকে পুলিশ ধরে বিচারের মুখোমুখি করেছে? হাতে গোনা কয়েকজন। বেশির ভাগ মামলায় বিএনপি নেতা-নেত্রীকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। কিন্তু যাদের সেই হুকুমটা তাঁরা দিলেন, পুলিশ-র্যা ব তাদের খুঁজে বের করতে পারল না। মূল আসামিকে অজ্ঞাত রেখে হুকুমদাতাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলে সরকারের রাজনৈতিক ফায়দা হতে পারে, অপরাধের বিচার হবে না, প্রকৃত অপরাধীও শাস্তি পাবে না।
রাজশাহীর মেয়র বুলবুলের বিরুদ্ধে যেসব মামলার চার্জশিট দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে পুলিশ হত্যা, পুলিশকে গুলি করে আহত করা এবং বাস পোড়ানোর মামলাও রয়েছে। বিএনপির নেতা হিসেবে এসব ঘটনায় তাঁর নৈতিক দায় থাকলেও আইনি দায় প্রমাণ করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার অকাট্য প্রমাণ হাজির করে। সরকার আগুন-সন্ত্রাসীদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে কেউ কিছু বলবে না, বরং স্বাগত জানাবে। কিন্তু এসব অঘটনকে যদি তারা বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের হাতিয়ার করে, তাহলে স্থানীয় সরকার বলে কিছু থাকবে না, সেটি সরকারের দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। সম্প্রতি যাত্রাবাড়ীতে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারার ঘটনায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও আসামি করা হয়েছে।
২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজশাহী মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর নভেম্বর মাসেই সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। বিএনপিসহ বিরোধী জোটের টানা অবরোধের মধ্যে গত ২৩ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে নগরের মতিহার থানার কাপাশিয়া এলাকায় ঢাকাগামী গাড়িবহরে পেট্রলবোমা হামলা হয়। এর আগে ২২ জানুয়ারি দুপুরে নগরের কাদিরগঞ্জে ট্রাকের বহরে হামলা এবং ১৯ জানুয়ারি নগরের ভদ্রা এলাকায় যাত্রীবাহী একটি বাসে পেট্রলবোমা হামলার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় মেয়রকে আসামি করা হয়। এর পর থেকে মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন আত্মগোপনে চলে যান। সিটি করপোরেশনে নিজ কার্যালয়েও আসেননি। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ চন্দ্র সরকারকে হত্যা, পুলিশের ওপর হামলাসহ ১১টি মামলা আছে এবং পাঁচটিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যার সম্পূরক চার্জশিটভুক্ত আসামি এবং ঘটনাটি ১১ বছর আগের। আওয়ামী লীগ তখন বিরোধী দলে ছিল। অন্যান্য মামলার মতো এ মামলাটিরও সুষ্ঠু তদন্ত করেনি বিএনপি। সেই ব্যর্থতার দায় তাদের নিতে হবে। তাই বলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সংঘটিত সব সহিংসতা ও নাশকতার দায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ওপর চাপানোর যুক্তি কী? একজন নির্বাচিত মেয়র কি বাসে আগুন দিয়েছেন? পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছেন?
আইন যে সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে চলে না, তার আরও কিছু উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি। ঘাটাইল উপজেলার চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খানকেও টাঙ্গাইল আদালত এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন গত ১১ মার্চ বন দখল ও ধ্বংসের দায়ে। একই দিন তাঁকে জামিন দেওয়া হয়, যাতে তিনি হাইকোর্টে আপিল করতে পারেন। তিনি এখনো উপজেলার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। টাঙ্গাইল সদর পৌরসভার চেয়ারম্যান শহিদুর রহমান খান স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ফারুক আহমদ হত্যার আসামি। সেখানেও দুই আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তাঁর নাম বলেছেন। গত নভেম্বর থেকে তিনি পলাতক থাকলেও দুই দফায় যথাক্রমে তিন মাস ও ৪৫ দিনের ছুটির আবেদন করেছেন। গত ৮ এপ্রিল তাঁর ছুটির মেয়াদ শেষ হলেও আর আবেদন করেননি। আইন অনুযায়ী, একজন পৌর চেয়ারম্যান বছরে তিন মাস ছুটি ভোগ করতে পারেন। ডেইলি স্টার খবর দিয়েছে, এক বছরের বেশি সময়ে বিরোধী দলের সমর্থক স্থানীয় সরকারে বিভিন্ন পর্যায়ের ২৫ জন প্রতিনিধিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সরকার–সমর্থক জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ঝালকাঠি পৌর মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার নামে চাঁদাবাজির মামলা থাকলেও নেপথ্যে কাজ করেছে স্থানীয় প্রভাবশালী দুই আওয়ামী লীগ নেতার দ্বৈরথ। তিনি যে নির্বাচনে মেয়র হয়েছেন, সেই নির্বাচনটিও ছিল বিতর্কিত। আদালত ফলাফল পুনঃগণনান নির্দেশ দিলেও সেটি মানেননি।
যেখানে আইন দ্বারা ক্ষমতা চালিত হওয়ার কথা সেখানে এখন ক্ষমতা দ্বারাই আইন চালিত হচ্ছে। এ কারণেই তিনটি বড় সিটি করপোরেশনের মেয়র বরখাস্ত হলেও বহাল থাকেন নূর হোসেনের মতো কুখ্যাত ব্যক্তি, সরকার নিজেই যাকে ধরার জন্য এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০[email protected]