অযত্ন আর অবহেলায় রংপুরের রেল

রংপুরে প্রয়োজনের তুলনায় রেলসুবিধা খুবই অপ্রতুল। পরিকল্পনাহীনতা আর কিছুটা সদিচ্ছার অভাবে রংপুর রেল সীমিত ব্যবস্থায় যে সেবাটুকু দিতে পারত, তা-ও পারছে না। মহাজোট সরকার রংপুরের উন্নয়নের প্রতি কিছুটা সদয় হলেও রেলসংশ্লিষ্টদের খামখেয়ালিপনার কারণে রংপুর বিভাগের মানুষ রেলসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রেল যোগাযোগের আধুনিকায়ন এবং রেলসেবা গণমানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য মহাজোট সরকার রেল মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু রংপুরের রেল উন্নয়নের জন্য রেল মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য কোনো কাজই দৃষ্টিগোচর হয়নি। রংপুর রেলস্টেশনের একজন প্রবীণ কর্মচারী দুঃখ করে বলছিলেন, কোনো দিন রংপুরে নতুন রেল ইঞ্জিন কিংবা নতুন কোচ দেয়নি সরকার। সরকার মনে করে, রেল মানেই চট্টগ্রাম আর সিলেট। যে ইঞ্জিন-কোচ ওখানে চলে না, সেগুলো রংপুরে দেয়।
সম্প্রতি রংপুর রেলস্টেশনে গিয়েছিলাম রেলের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। স্টেশনে পৌঁছাতেই একটি ট্রেন এসে থামল। ট্রেনটি পার্বতীপুর থেকে এসেছে, যাবে লালমনিরহাট। দেখলাম, ট্রেনের ভেতর দাঁড়ানোর মতো স্থান নেই। ছাদেও অনেক যাত্রী। স্টেশনমাস্টার শেখ আবদুল জব্বারের কাছে জানতে চাইলাম, মাত্র ছয়-সাতটি কোচ কেন? ইঞ্জিনটি কি এর চেয়ে বেশি কোচ টানতে পারে না? স্টেশনমাস্টার জানালেন, ১৬টি কোচ টানতে পারে ট্রেনটি। শুধু কয়েকটি কোচের অভাবে যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ নেই।
ট্রেনটি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় আধা ঘণ্টা বিলম্বে এসেছে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা মোহাম্মদ মাসুম নামের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ট্রেন বিলম্বে আসার প্রতিকার কী হতে পারে? তিনি বললেন, ট্রেন কেন বিলম্বে এসেছে, এর কৈফিয়ত চাওয়া হয় না, বিলম্বের জন্য কোনো শাস্তি হয় না। সে জন্য সংশ্লিষ্টরা ইচ্ছেমতো ট্রেন চালায়।
রংপুর থেকে ঢাকাগামী ট্রেনের সংখ্যা এক। সপ্তাহে ছয় দিন চলে। রোববার বন্ধ। ফলে অফিস খোলা অবস্থায় মাত্র চার দিন চলে এ ট্রেন। প্রায় প্রতিদিনই কয়েক ঘণ্টা বিলম্বে যাওয়া-আসা করে। রংপুর এক্সপ্রেসের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বিকল। ট্রেনটির ১১টি কোচ ছিল। যাত্রীর ভিড় থাকা সত্ত্বেও দুটি কোচ অজ্ঞাত কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ ১৬টি কোচ নিয়ে অনায়াসে চলতে পারত এই ট্রেন। কোচ-সংকট রংপুরের ওপর দিয়ে যাওয়া-আসা করা প্রতিটি ট্রেনেই। যাত্রীর অভাব নেই। কিন্তু কোচের সংখ্যা সাত-আটের বেশি নয়। সামান্য কয়েকটি কোচ দিলেই দ্বিগুণ যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হতো। এই উদাসীনতার দায় রেল মন্ত্রণালয় কি এড়াতে পারবে?
রংপুর বিভাগ থেকে মোট পাঁচটি ট্রেন ঢাকায় যায়। দিনাজপুর থেকে দুটি, নীলফামারীর চিলাহাটি থেকে একটি, লালমনিরহাট থেকে একটি, রংপুর থেকে একটি। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকাগামী কোনো ট্রেন যোগাযোগ নেই। অথচ তিনটি জেলা থেকে সংযোগ ট্রেন দিয়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যেত।
রংপুর থেকে সোজা বগুড়া পর্যন্ত একটি রেললাইন স্থাপন করার অভাবে ঢাকায় যেতে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা সময় বেশি লাগে। সে বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ জরুরি। এ ব্যবস্থা করা গেলে মাত্র ২০০ টাকায় রংপুর থেকে ঢাকায় যাওয়া সম্ভব হবে।
রংপুর থেকে রাজশাহী, যশোর ও খুলনাগামী কোনো ট্রেন নেই। এর অন্যতম কারণ, রংপুর থেকে পার্বতীপুর মাত্র ৪০ কিলোমিটার ব্রডগেজ লাইন না থাকা। পার্বতীপুর পর্যন্ত তৃতীয় লাইন হিসেবে একটি লাইন স্থাপন করা গেলে রংপুর থেকে রাজশাহী-খুলনা-যশোরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যেত। সেই সঙ্গে ব্রডগেজ লাইনে ঢাকায়ও যাওয়া যেত। যত দিন ব্রডগেজ লাইন না হয়, তত দিন সংযোগ ট্রেন রেখেও রাজশাহী-যশোর-খুলনার সঙ্গে রংপুরের রেল যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। তা ছাড়া এই ৪০ কিলোমিটার লাইন ব্রডগেজ করা গেলে তেল পরিবহনে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া যেত। ব্রডগেজ লাইনটুকু না থাকার কারণে খুলনা থেকে তেলবাহী ব্রডগেজ লাইনের ট্রেনগুলো তেল নিয়ে এসে পার্বতীপুর ডিপোতে রাখে। সেখান থেকে রংপুরের ৮৭টি পাম্পে তেল বিক্রি হয়। রংপুর পর্যন্ত এই তেল নিয়ে আসা সম্ভব হলে রেল কর্তৃপক্ষ এবং রংপুরের তেল ব্যবহারকারীরা অনেকটা সুবিধা পেত। চট্টগ্রাম থেকে একবার মিটারগেজ লাইনে তেল পরিবহন করে রংপুর নিয়ে এলে ভাড়া বাবদ রেল বিভাগ পায় প্রায় ১০ লাখ টাকা। মিটারগেজ হওয়ার কারণে খুলনা থেকে রংপুরে তেলবাহী ট্রেন আসে না। ব্রডগেজ লাইন স্থাপনের ব্যয় শুধু তেল পরিবহন থেকে আয়কৃত টাকায় কয়েক মাসে পরিশোধ করা সম্ভব।
রংপুর থেকে লালমনিরহাট-কুড়িগ্রামে যেতে তিস্তা নদীর ওপরের মেয়াদোত্তীর্ণ রেলসেতুটির কাজ পুনরায় করা প্রয়োজন। তা না হলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। এই কাজে মিটারগেজ এবং ব্রডগেজ উভয় ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাহলে রংপুর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ করা গেলে কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট থেকে ছাড়তে পারবে রাজশাহী-যশোর-খুলনাগামী ট্রেনগুলো।
শেখ আবদুল জব্বার জানান, যদি কুড়িগ্রামের চিলমারী থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর দিয়ে একটি ব্রিজ করে ঢাকা-চট্টগ্রামের সঙ্গে রেলপথ করা যেত, তাহলে চার ঘণ্টায় ঢাকায় যাওয়া যেত। যাত্রীর পাশাপাশি উত্তরাঞ্চল থেকে পণ্য পরিবহন করা যেত অনেক সুলভে। এতে করে রেল কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ মানুষ অনেক লাভবান হতো।
রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির সদস্যসচিব খন্দকার আরিফ বলেন, কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার জন্য একটি ট্রেন চললে গরিব মানুষ স্বল্প টাকায় ঢাকা যেতে পারবে। দেশের সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রামের অভাব দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা দীর্ঘদিন ধরে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি ট্রেনের জন্য আন্দোলন করে আসছে।
রংপুর রেলে উন্নয়ন করতে হলে উল্লিখিত সমস্যা সমাধান করা ছাড়াও রংপুরের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগের আধুনিকায়নসহ ডুয়েল গেজ, ডাবল লাইন পদ্ধতি প্রয়োজন। রংপুর বিভাগের সব জেলা থেকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য একটি করে ট্রেনের ব্যবস্থা করা ভীষণ জরুরি। রংপুর বিভাগ উন্নয়ন আন্দোলন পরিষদের আহ্বায়ক ওয়াদুদ আলী বলেন, বাসমালিকেরা কিছুতেই চান না সাধারণ মানুষ স্বল্প ব্যয়ে রেলে যাতায়াত করুক। সে জন্য তাঁরা রেলের উন্নয়নে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করে। বাস ব্যবসায়ীদের চক্রান্তে যেন রেলসেবার সুযোগ নস্যাৎ না হয়, সেদিকেও সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
[email protected]