শিগগিরই নির্বাচনের নতুন ফর্মুলা আসবে

>বিশেষ সাক্ষাৎকার: ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের নেতৃত্বে সহস্র নাগরিক কমিটি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে আদর্শ ঢাকা আন্দোলন কমিটি গঠিত হয়। কমিটি দুটি দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষে সক্রিয় ছিল। এখানে দুই কমিটির দুই নেতা সিটি নির্বাচন ও নির্বাচনোত্তর রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
এমাজউদ্দীন আহমদ
এমাজউদ্দীন আহমদ

প্রথম আলো : আপনি বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনিবার্য অংশ হচ্ছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। একটা বিরাট আশাবাদ জাগিয়ে আপনারা নির্বাচনে গেলেন। কিন্তু যা ঘটে গেল, তা কতটা আপনি আশা করেছিলেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : নির্বাচন কমিশন যে নিজেই একটি নির্বাচন এভাবে নষ্ট করতে পারে, সেটা আমি আশা করিনি। আশা করেছিলাম, আমরা একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে যাব। একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছাব। কিন্তু সিটি নির্বাচনে যে ব্যাপক কারচুপি হলো, বিশেষ করে ইসি যেভাবে তা সমর্থন করল, তা একেবারেই আশা করিনি। আমি খুবই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।
প্রথম আলো : এই নির্বাচন কমিশনের কাছে কেন আপনি ভালো কিছু আশা করেছিলেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ভদ্রলোক (সিইসি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার থেকে তিনি প্রায় নয় বছরের কনিষ্ঠ। তাঁকে বলেছিলাম, আমরা বেশি কিছু চাই না, দুটো জিনিস চাই। প্রথমত, প্রত্যেক ভোটার যাতে তাঁদের মনমতো প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক প্রার্থী যেন ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে পারেন। বললাম, এটুকু না পারলে এখানে আপনারা আছেন কেন? পরে দেখা গেল তাঁর অফিসের পাশে বসেই লোকজন সিল মারছে। পরে বলেছেন, নিয়মমাফিক হয়েছে। এই বয়সের মানুষ যদি এটা বলতে পারেন, তাহলে আমরা কোথায় যাব?
প্রথম আলো : বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সাধারণ নির্বাচন করার যে অবস্থান আপনি নিয়েছিলেন, তাতে কি চিড় ধরল? নাকি আপনি অটল থাকবেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : না, আর অটল থাকতে পারছি না। যখন আমি ওই কথাটা বলেছিলাম, তখনো কতগুলো শর্তসাপেক্ষে বলেছিলাম। সেগুলো ছিল ইসিকে সর্বতোভাবে শক্তিশালী করা। রিটার্নিং অফিসারসহ যাঁরা নির্বাচনী ব্যবস্থাটা চালু রাখবেন, তাঁদের নিরপেক্ষ হতে হবে; দলীয় লোক যাতে না থাকে। যেমন, একটা নির্বাচন ব্রিটেনে দেখলাম। ভারতেও তা-ই চলছে। ভারতে পাঁচজন কমিশনার নেই, একজন সিইসি সুষ্ঠু নির্বাচন করছেন।

প্রথম আলো : তার মানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখে আর নির্বাচন নয়?

এমাজউদ্দীন আহমদ : না, শর্তগুলো তো মানাই হলো না। আমি তো এর আগে ওদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিছু লোকের সঙ্গে কিছু কথা হয়েছিল। আমি চাই, সারা বিশ্বে যেটা চলছে, প্রধানমন্ত্রীকে রেখে নির্বাচন করতে। ২০৩টি রাষ্ট্রের মধ্যে প্রায় ১৬৬টি রাষ্ট্রে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু কোথাও সংসদ অক্ষত রেখে নির্বাচন হয় না। আমাদের সংবিধানে ১২৩ ক অনুচ্ছেদে যেভাবে পুরোনো সংসদ রেখে নতুন সংসদ করার বিধান আছে, এমনটা কোথাও নেই।

প্রথম আলো : সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে নির্বাচন করার যে ধারা ছিল, সেটা তো আমরা শেষ করেছি। বিএনপিও মনে হয় এই বিধানের পুনরুজ্জীবন চাইছে না। তাহলে একটি বিকল্প রূপরেখা জাতির সামনে উপস্থাপন করা আপনাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কি না? 

এমাজউদ্দীন আহমদ : পড়ে। একজন নির্ভরযোগ্য মানুষের নেতৃত্ব দরকার। 

প্রথম আলো : এই নির্ভরযোগ্য কে কীভাবে হবেন, সেটা বিএনপির তরফ থেকে নির্দিষ্টভাবে না বলার কারণে রাজনীতিতে একটা বিভ্রান্তি চলছে। সরকারি দল নাকচ করতে পারে কিন্তু একটা ফর্মুলা তো চাই।

এমাজউদ্দীন আহমদ : হ্যাঁ, আমি কিন্তু এখন সেই ফর্মুলাটা প্রস্তুত করার চেষ্টা করছি। আসলে এই ফর্মুলা প্রস্তুত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই আমি খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে আসতে রাজি করিয়েছিলাম।

প্রথম আলো : কবে নাগাদ এই ফর্মুলা জাতির সামনে পেশ করা সম্ভব হতে পারে?

এমাজউদ্দীন আহমদ : এটা খুব বেশি দিন নয়। দিন সাত-আটেক। 

প্রথম আলো : সাত দিনের মধ্যে?

এমাজউদ্দীন আহমদ : না, সময়-সুযোগ বুঝে। পরিস্থিতিটা একটু অনুকূল হোক।

প্রথম আলো : আগামী ৯০ দিনের মধ্যে?

এমাজউদ্দীন আহমদ : তা নিশ্চয় হতে পারে। একটা সম্ভাবনা থাকবে। আগে আমি একটি খসড়া তৈরি করব, এরপর আলোচনা করব। এ জন্য একটি সংবাদ সম্মেলন করব।   

প্রথম আলো : কিন্তু নির্বাচন ছাড়া বিএনপির মুখে শাসনগত সংস্কারের বিষয়ে কথা নেই। আপনার ভাবনা কী?

এমাজউদ্দীন আহমদ : সুশাসন প্রশ্নে আমি নিজের লেখায়ও বলেছি যে বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনীতি চলছে, তাকে ব্রিটেনের সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট নামকরণ করেছে যে টক্সিক পলিটিক্স বা বিষাক্ত রাজনীতি। আর এই বিষাক্ত রাজনীতির কারণে যেসব রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকে, সেগুলো তখন অকার্যকর হয়ে পড়ে। সেগুলো আর স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না, বিকৃত হয়ে যায়। সিটি নির্বাচনে আমরা তারই নমুনা দেখলাম। এখন চ্যালেঞ্জ হলো বিষাক্ত রাজনীতিকে ঝেড়ে ফেলা। সবকিছু দলীয়করণ হওয়া ঠিক নয়।

প্রথম আলো : আপনি কি তাবিথ আউয়াল বা মির্জা আব্বাসকে নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করার সুপারিশ করছেন? মানুষকে ট্রাইব্যুনালের রায় মূল্যায়ন করার সুযোগ দেবেন না?

এমাজউদ্দীন আহমদ : এখনো ভাবিনি। তবে ভাবব। এটা দাখিল করার পরে এ দেশের কিছু জ্যেষ্ঠ নাগরিককে নিয়েও আমি কথা বলব।

প্রথম আলো : বর্জন সত্ত্বেও বিএনপি যে এত ভোট পেল, সেটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

এমাজউদ্দীন আহমদ : এটা জনমতকে বিভ্রান্ত করার একটা কৌশল হতে পারে। ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরে এত ভোট পাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। ভোট বর্জনের পরে ইচ্ছা করে কিছু বেশি ভোট দেখিয়ে এ দেশের মানুষ ও বিদেশিদের সন্তুষ্ট করতে চেয়েছে।

প্রথম আলো : কেমব্রিজ থেকে সদ্য প্রকাশিত একটি বইয়ে ‘জামায়াত বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে আখ্যায়িত মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মাহমুদ হাসান বলেছেন, ‘বিএনপি যখন দুর্বল হবে, তখন জামায়াত সাফল্যের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে সংগঠিত করতে পারবে। দীর্ঘ মেয়াদে এটা প্রকৃত সম্ভাবনা। কারণ, খালেদা জিয়ার পরে বিএনপি ভেঙে যাবে।’ আপনার মন্তব্য?

এমাজউদ্দীন আহমদ : আমি এ কথার সঙ্গে একমত নই। তার কারণ হলো, বিএনপি এমন একটি দল, যার তৃণমূল পর্যন্ত সমর্থন ও ভিত্তি রয়েছে। এবং কোথাও কোথাও একটু শিথিল হচ্ছে বটে কিন্তু এখন পর্যন্ত দলটি এই পর্যায়ে যায়নি যে খালেদা জিয়ার পরে দলটি ভেঙে যাবে।

প্রথম আলো : সিটি নির্বাচন থেকে জামায়াতের প্রাপ্তি কী? প্রশ্নটি এ কারণে যে আপনাদের বর্জন সত্ত্বেও তারা কিছু জায়গায় জিতেছে?

এমাজউদ্দীন আহমদ : জিতেছে, তবে আমি বলব ২০-দলীয় জোটভুক্ত দল হিসেবে এর ফলে তাদের দিক থেকে একটা অনৈতিক কাজও হয়েছে। কারণ, সবাই যখন বর্জন করছে, তারা তাদের প্রার্থী রেখে দিয়েছে। এটা ঠিক হয়নি।

প্রথম আলো : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এমাজউদ্দীন আহমদ : ধন্যবাদ।