চোখের জলের লাগল জোয়ার

সাভার ধ্বংসযজ্ঞকে কেন্দ্র করে কটা দিন পুরো জাতি চোখের জলে ভেসেছে। মনে পড়ছিল রবীন্দ্রনাথের পঙিক্ত, ‘ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার, দুখের পারাবারে’। সাভারের বাতাস থেকে লাশের গন্ধ মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তবু ইট, পাথর, কংক্রিটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মুখগুলো পিছু ছাড়ে না।

এই বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী হিসেবে পোশাকশিল্পের কিছু অতি লোভী মালিক, কতিপয় দুর্বৃত্তকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু বরাবরের মতো সমস্যার কেবল এই ‘ব্যক্তিকরণের’ ফাঁকিতে আর কতকাল কাটবে আমাদের? সাভারের এই ছোট ছবি থেকে আরও বড় ছবি, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বিগ পিকচার’, তার দিকেও তো চোখ রাখতে হবে। এই যে লোভ, যা শ্রমিকদের ভাঙা দালানের মৃত্যুপুরীতে কাজ করতে পাঠায়, জ্বলন্ত কারখানার ভেতর শ্রমিকদের রেখে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়, তা শুধু ব্যক্তির ভেতর সৃষ্টি হয় না। এর শিকড় রয়েছে আরও গভীরে, রয়েছে সেই ব্যবস্থায়, যা ব্যক্তির লাগামহীন লোভকে অবাধে ছুটে চলবার সুযোগ করে দেয়। মুনাফার জন্য ব্যক্তির এই লোভের জন্ম হওয়ার একটা শাস্ত্র আছে, বিজ্ঞান আছে, ইতিহাস আছে। সমাজবিজ্ঞানীরা ঢাউস বইপত্র লিখে দেখিয়ে গেছেন, কীভাবে পুঁজি যখন লাগামহীন থাকে, তখন অবিরাম মুনাফা অর্জনই হয়ে ওঠে এর মৌলিক ধর্ম। দেখা গেছে, যেসব রাষ্ট্র পুঁজির লাগাম টেনে ধরতে পারে, সেখানে দেখা দেয় পোষ মানা পুঁজি। যেখানে তা পারে না, সেখানে মাথা তোলে বর্বর পুঁজি। বলা বাহুল্য, এ দেশে বহুকাল থেকেই লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে বর্বর ধারার পুঁজি। অথচ আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর প্রাথমিক পর্বে পুঁজির এই অবাধ গতিকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এমনকি মুনাফাকেন্দ্রিক পুঁজির চাকা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেষ্টাও হয়েছে এখানে। কিন্তু সেসব চেষ্টা নানা ষড়যন্ত্র, হত্যা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নস্যাৎ করা হয়েছে।

তারপর ক্রমশ এমন একটা ব্যবস্থার দিকে দেশ গেছে, যেখানে পুঁজির আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তৈরি করা হয়েছে অবাধ এক বাজার, যেখানে যে কেউ যেকোনো উপায়ে নেমে পড়তে পারে শুধু অন্তহীন মুনাফার লড়াইয়ে। এমন একটা ব্যবস্থায় পুঁজি অবধারিত হয়ে পড়ে লুটেরা, বর্বর। এই লুটেরা পুঁজি কী করে আমাদের রাজনীতির সিংহাসনে গিয়ে ক্রমশ বসেছে, আমরা তা দেখেছি। যাঁরা এই অন্তহীন মুনাফা মেশিনের কারিগর, তাঁরাই একে একে হয়েছেন রাজনীতির মূল মাঠের খেলোয়াড়। মুক্ত বাজারের চৌকস ব্যবসায়ীরাই ধীরে ধীরে হয়েছেন দেশের রাজনীতির নিয়ন্তা। বর্বর পুঁজির ফাঁকফোকর দিয়ে যাঁরা অবিরাম লাভবান হন, তাঁদের হাতেই যদি রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণের দায়িত্ব থাকে, তাহলে তাঁরা কোন দুঃখেই বা পুঁজির লাগাম টেনে ধরবেন? ফলে খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই পুঁজি হয়ে উঠবে আরও বন্য, আরও রক্তপিপাসু।

মুনাফাকেন্দ্রিক পুঁজি নিয়ন্ত্রণের কথা এখন কেবল শোনা যায় বাম রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে। কিন্তু বামগণ তাঁদের ভেতরকার মত ও পথের সূক্ষ্ম তর্কে-বিতর্কে, দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে ছিন্নভিন্ন। নিপীড়িত মানুষের কল্যাণের প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হওয়া সত্ত্বেও নানা ব্যর্থতায় তাঁদের নাম জুটেছে নাস্তিক হিসেবে। তাঁরা কখনো রাজনীতির মধ্যমাঠের খেলোয়াড় হবেন কি না, তা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে সাভারে যে বাণিজ্য-সন্ত্রাস আমরা দেখলাম, এর নিষ্পত্তির জন্য আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোর সেই বড় ছবিটার দিকে তাকাতেই হবে। আমরা জানি, ইতিহাসে পুঁজির পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে সমাজতান্ত্রিক ধারার সমাজ গড়ার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু বিপর্যয় নেমেছে সেখানে। ভাবা হয়েছিল, সমাজতান্ত্রিক ধারার পতনের পর বুঝি মুক্তবাজার অর্থনীতিই স্বর্গরাজ্য তৈরি করবে পৃথিবীতে, কিন্তু বিপর্যয় নেমেছে সেখানেও। পুঁজিবাদী বিশ্ব ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে এখন। দুই ধারার সাফল্য, ব্যর্থতা মিলিয়ে পুঁজিকে বাগে আনার নানা রকম চেষ্টা চলছে পৃথিবীর দেশে দেশে। কারণ, ইতিমধ্যে এই শিক্ষা হয়েছে সবার যে পুঁজিকে বাগে না আনলে তা এমন বর্বর হয়ে ওঠে, যা ব্যাপক ধস নামায় অর্থনীতিতে।

জাপানি ব্যতিক্রমী সমাজবিজ্ঞানী হিরোসি তাসাকার একটা লেকচার ক্লাসের ইউটিউবে দেখছিলাম, ক্লাসে এসে ঘরের সব বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে তিনি রূপকথার গল্প বলছেন ছাত্রদের। গল্পটা দীর্ঘ হলেও তার নির্যাসটা এ রকম: অনেক অনেক দিন আগের কথা। গ্লোবারিয়া নামের এক রাজ্যে ছিল ছোট্ট এক গ্রাম, যার নাম জাপোনিয়া। সে গ্রামে থাকত কেনজি আর চিকো নামের দুই ভাইবোন। গ্লোবারিয়া রাজ্যে ছিল আমারিয়া, ইউরোয়া, রুসুয়া, চীনুয়া, এসিওয়া, আফ্রিয়া এমনি আরও অনেক গ্রাম। গ্লোবারিয়ার অধিবাসীরা বিশ্বাস করত, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চলে টাকার শক্তিতে। তারা শুধু টাকার পেছনে ছুটত। তাদের সমাজ যে নিয়মে চলত, তার নাম ছিল বর্বর পুঁজিবাদ। তারপর একদিন আমারিয়া গ্রামের এক বড়লোক ব্যবসায়ী এসে সব গ্রামে গ্রামে কী এক ভুয়া জিনিস ফেরি করে গেলেন। সেই আমারিয়া গ্রামের ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হতে থাকল গ্লোবারিয়ার গ্রামের পর গ্রাম। জাপোনিয়া গ্রামের কেনজি আর চিকোর মা-বাবাও সর্বস্ব হারালেন। কেনজি আর চিকো গ্রামের মোড়লের কাছে গিয়ে জানতে চাইল, কী করে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। মোড়ল ভেবে বললেন, এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে আমাদের এই বর্বর পুঁজিবাদ ভেঙে বিজ্ঞ পুঁজিবাদ গড়তে হবে। কী করে পুঁজিবাদকে বিজ্ঞ করা যাবে—জানতে চাইল কেনজি। মোড়ল বললেন, সে কথা তোমাদের হয়তো বলতে পারবেন কোনো অর্থনীতিবিদ। কেনজি ও চিকো তখন গেল বিখ্যাত সব অর্থনীতিবিদের কাছে। এক অর্থনীতিবিদ বললেন, পুঁজিকে আরও নিয়ন্ত্রণ করলেই তা হয়ে উঠবে বিজ্ঞ। আবার অন্যজন বললেন, পুঁজিকে বিজ্ঞ হতে হলে নিয়ন্ত্রণ নয়, তাকে মুক্ত করে দিতে হবে। চিকো আর কেনজি পড়ে গেল ধাঁধায়। তারা আবার গেল মোড়লের কাছে। মোড়ল বললেন, তোমরা বরং জঙ্গলে যে সন্ন্যাসী আছেন, তাঁকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো। চিকো আর কেনজি এবার সেই সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি আমাদের জানাবেন, বিজ্ঞ পুঁজিবাদ কাকে বলে? সন্ন্যাসী বললেন, বিজ্ঞ পুঁজিবাদ কাকে বলে জানতে হলে তোমাদের জানতে হবে বিজ্ঞ মন কাকে বলে। কাকে বলে বিজ্ঞ মন—জিজ্ঞাসা করে কেনজি আর চিকো। সন্ন্যাসী বললেন, বিজ্ঞ মন অদৃশ্য মূল্যকে দেখতে পায়। সাধারণ মানুষের প্রজ্ঞা, নিজস্ব জনপদের সদ্গুণ, পারস্পরিক সহমর্মিতা—এসবই হচ্ছে অদৃশ্য মূল্য। বিজ্ঞ মন যখন সেসব অদৃশ্য মূল্য দেখতে পায়, তখন বিজ্ঞ পুঁজিবাদ সেসব অদৃশ্য পুঁজিকে মূল্য দিতে শুরু করে। চিকো তখন খুশি হয়ে কেনজিকে বলে, তাহলে চলো, আমরা গ্রামের সবাইকে এই অদৃশ্য পুঁজির কথা জানাই, সবাইকে মিলে গড়ে তুলি এক নতুন অদৃশ্য পুঁজিবাদ। সন্ন্যাসী বলেন, দাঁড়াও। তোমরা গ্রামে ফিরে গিয়ে যে মাটির ওপর দাঁড়াবে, সেটার দিকে ভালো করে তাকাবে। কেন? জানতে চায় কেনজি আর চিকো। সন্ন্যাসী তখন বললেন, কারণ, তোমাদের জাপোনিয়া গ্রামের মাটিতে ওই সব অদৃশ্য পুঁজি অঢেল ছড়িয়ে আছে। নিজের মাটির সেসব অদৃশ্য পুঁজি সংগ্রহ করেই তোমরা গড়ে তুলতে পারো তোমাদের নিজস্ব জোপানিয়ান বিজ্ঞ অদৃশ্য পুঁজিবাদ।

আমারিয়া গ্রামের ভণ্ড ফেরিওয়ালার খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হওয়ার আগে আমাদের নিজেদের অদৃশ্য পুঁজিগুলো খুঁজে নেওয়া দরকার। সাধারণ মানুষের প্রজ্ঞা, নিজস্ব জনপদের সদ্গুণ আর পারস্পরিক সহমর্মিতার অদৃশ্য পুঁজির অঢেল ছড়াছড়ি আমরা দেখেছি এই সাভারের চরাচরেই। ভাবতে হবে, দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অদৃশ্য পুঁজিগুলো কুড়িয়ে আগামী বাংলাদেশকে কোন পথে নিয়ে যাব আমরা—বিজ্ঞ পুিঁজবাদের পথে, নাকি বিজ্ঞ নতুন কোনো সমাজতন্ত্রের পথে? জীবনানন্দের একটা কবিতার বক্তব্য এ রকম, ‘একটা পৃথিবী নষ্ট হয়েছে আমাদের আগে, আরেকটা পৃথিবী গড়বার জন্য লাগে, সকালের আকাশের মতো বয়স’। যাদের এখন সকালের আকাশের মতো বয়স, তাদের সাভারের মতো টুকরো ছবির সূত্র ধরে দেশের সেই বড় ছবিটা নিয়ে ভাবতে হবে। তা না হলে সীমাহীন লোভের যে ঘূর্ণিঝড় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দেশের চারদিকে, তাতে এভাবেই আরও অগণিত ফাটল ধরবে দেয়ালে দেয়ালে। এই দুঃখের পারাবারে আরও অগণিতবার নামবে চোখের জলের জোয়ার।

শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।