ইসরায়েলি অ্যাটম বোমার কী হবে?

১৯৬৯: ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোলডা মেইর ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন, পাশে কিসিঞ্জার
১৯৬৯: ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোলডা মেইর ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন, পাশে কিসিঞ্জার

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন—এই খবরে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আমেরিকাকে নতুন করে উসকানি দিতে শুরু করেছেন। গত মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তিনি বলেছেন, ইরান পারমাণবিক মিসাইল তৈরির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে ইরান এমন পারমাণবিক মিসাইল তৈরি করে ফেলবে, যা তেহরান থেকে সোজা নিউইয়র্ক শহরে নিক্ষেপ করা যাবে। পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত ইরানকে ‘৫০টি উত্তর কোরিয়া’র সঙ্গে তুলনা করে নেতানিয়াহু ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে বলেছেন, হাসান রুহানি ‘ভেড়ার পোশাকে একটা নেকড়ে’। এই নেকড়ে ভেড়ার চামড়া গায়ে জড়িয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখে ধুলা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
দু-তিন বছর ধরেই ইসরায়েল ইরানের ওপর সামরিক আঘাত হানার পক্ষে নানা অজুহাত দাঁড় করানোর চেষ্টা করে আসছে। তার সঙ্গে গোপনে তাল দিয়েছে সৌদি আরব। তাদের আপত্তি ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে; ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা জোরেশোরে চালাচ্ছে। একাধিক সুরক্ষিত প্রকল্পে তারা ইউরেনিয়াম পরিশোধনের মাত্রা এতটাই বাড়াতে সক্ষম হয়েছে, যা দিয়ে পারমাণবিক বোমা ও ওয়ারহেড তৈরি করা সম্ভব। অবশ্য ইরান দাবি করে আসছে যে তাদের পরমাণু কর্মসূচির লক্ষ্য সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। কোনো ধরনের অস্ত্র উৎপাদন নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন আর চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই তারা ইউরেনিয়াম পরিশোধনের প্রকল্পগুলো পরিচালনা করছে। কিন্তু ইরানের এই দাবি অকপট নয়, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাও সন্দেহ করে যে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করে চলেছে। সেই সক্ষমতা তারা কতটা অর্জন করতে পেরেছে, সে সম্পর্কে বাইরের কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তবে আমেরিকান গোয়েন্দাদের সার্বক্ষণিক সুতীক্ষ নজরদারির ফলে মার্কিন প্রশাসনের হাতে এমন গোয়েন্দা তথ্য জমে উঠেছে যে, ইরান শিগগিরই পরমাণু অস্ত্রের মালিক হয়ে উঠতে পারছে না। বস্তুত সে কারণেই ইরানের সঙ্গে আমেরিকা সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
কিন্তু ইসরায়েলের জন্য সেটা হয়ে উঠেছে বিরাট মাথাব্যথার বিষয়। রুহানির সঙ্গে ওবামার টেলিফোন সংলাপের পর নেতানিয়াহুর পিত্তি জ্বলতে শুরু করেছে; হরেক রকমের আবোলতাবোল বকতে বকতে তিনি এমন কথাও বলে ফেলেছেন যে, ইরানকে শায়েস্তা করার জন্য কেউই যদি ইসরায়েলের পাশে না থাকে, তাহলে ইসরায়েল একাই সেটা করবে। অবশ্য ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরোধিতায় ইসরায়েল একা নয়। মধ্যপ্রাচ্যেই আছে ইরানের আরেক জানে দুশমন। মুসলিম দুনিয়ায় ইরানের এক নম্বর শত্রু সে: সৌদি আরব। যদিও সৌদি শাসকেরা রুহানি-ওবামার টেলিফোন সংলাপের ব্যাপারে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি, কিন্তু এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে সৌদি শাসকদেরও পিত্তি কম জ্বলছে না। সৌদি বাদশাহ মনে করেন, ইরান হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ভয়ংকর কালনাগিনী। এর বিষাক্ত ফণা কেটে ফেলার জন্য রিয়াদে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে কতভাবেই না প্ররোচিত করেছেন সৌদি বাদশাহ। ইরানের ওপর মিসাইল হামলা চালিয়ে তাদের সবগুলো পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য সৌদি বাদশাহ ও গোয়েন্দাপ্রধান একাধিকবার হোয়াইট হাউসের নেতাদের অনুরোধ করেছেন, এমন প্রামাণ্য দলিল ফাঁস করে দিয়েছে উইকিলিকস। আর কদিন আগে মার্কিন সংবাদপত্র দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তথ্যপ্রমাণসহ দাবি করেছে যে, সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধে ইসরায়েল আর সৌদি আরব মিলে বিদ্রোহী ও জঙ্গিদের অর্থ, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করছে। বিদ্রোহী-জঙ্গিদের প্রতি ইসরায়েল-সৌদি আরবের মদদের কারণেই সিরিয়ার রক্তপাতের অবসান হচ্ছে না—এমন কথা বলেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভও। সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া মুসলমানের দেশ ইরানের বিরুদ্ধে সুন্নি মুসলমান সৌদি শাসকদের ঘৃণা-বিদ্বেষ এতটাই প্রবল যে ইরানকে ধ্বংস করতে ইসরায়েলের ইহুদি শাসকদের সঙ্গে হাত মেলাতেও সৌদি শাসকেরা কুণ্ঠিত নন।
ইরানের পরমাণু প্রকল্প সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ—এ কথা আবারও বলেছেন ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট; উদ্দেশ্য স্পষ্টতই আমেরিকা ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করা যে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে না। আমেরিকা ও তার মিত্ররা পুরোপুরি আশ্বস্ত হবে না, তাদের সন্দেহ সক্রিয়ই থেকে যাবে। চলতে থাকবে গোয়েন্দা নজরদারি ও চোরাগোপ্তা সাইবার আক্রমণ। তবে সম্পর্ক উন্নত হলে আমেরিকার সুবিধা হবে এই যে, ইরানের পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে সক্ষমতা অর্জন আরও বিলম্বিত হবে। কিন্তু কত দিন ধরে কত দূর পর্যন্ত ইরানকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে, তা বলা কঠিন। কখনো না কখনো ইরান পরমাণু অস্ত্রের মালিক হবেই; এটা তার অস্তিত্বের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়ানো।
সারা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ ও তার নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্য, যারা কেউ হাজার হাজার, কেউ শত শত পরমাণু অস্ত্রের মালিক বনে বসে আছে, তারাও বিরুদ্ধে। গোপনে পরমাণু অস্ত্রের মালিক হয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে যে দুই জানে দুশমন—ভারত ও পাকিস্তান, তারাও চায় না পৃথিবীতে আরও কোনো দেশ পরমাণু অস্ত্রের মালিক হোক। কিন্তু তাদের এই চাওয়া, এই দাবি আর সব রাষ্ট্রকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি থেকে জোর করে বিরত রাখার সম্মিলিত প্রচেষ্টার নৈতিক ভিত্তিটা কী? ইরান কিংবা পরমাণু অস্ত্রের মালিক হওয়ার অভিলাষী আরও কোনো দেশ যদি পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত দেশগুলোকে প্রশ্ন করে, তোমরা বানিয়েছ, আমরা কেন বানাতে পারব না? তোমাদের আছে, আমাদের থাকলে সমস্যা কী? তাহলে তারা কী উত্তর দেবে?
ইরানের পক্ষে এমন প্রশ্ন উচ্চারণই করা সম্ভব হয়নি। কারণ কিন্তু পৃথিবীর জবরদস্ত শাসকেরা কিছু নিয়মকানুন তৈরি করেছেন, যার বাইরে দুর্বলেরা প্রকাশ্যে যেতে পারে না। ইরানকে তাই মিথ্যা বলতে হচ্ছে: আমরা অ্যাটম বোমা বানাচ্ছি না। কিন্তু ইরানের অবশ্যই প্রশ্ন তোলা উচিত: ইসরায়েলের অ্যাটম বোমার কী হবে? ইসরায়েল বানিয়েছে, আমরা বানালে দোষ কী?
না, ইসরায়েল স্বীকার করে না যে তারা পরমাণু অস্ত্র বানিয়েছে। কিন্তু এ কথা সবাই জানে, আমেরিকার শাসকেরা অনেক আগে থেকেই
বেশ ভালো করে জানেন ইসরায়েলের কতগুলো পরমাণু অস্ত্র আছে। শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েল তার পরমাণু কর্মসূচি শুরু করেছিল ১৯৫৮ সালে—এ তথ্যও আমেরিকান গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন ১৯৬০ সালে। ১৯৬৯ সাল নাগাদ তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছে—এ তথ্য সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে জানিয়েছিলেন সে সময়ের সিআইএ-প্রধান রিচার্ড হেলমস।
ইসরায়েলি গবেষক-অধ্যাপক অ্যাভনার কোহেনের লেখা ইসরায়েল অ্যান্ড দ্য বোম (১৯৯৮) শিরোনামের এক বইতে এ সম্পর্কে বিশদ তথ্য ও বিশ্লেষণ রয়েছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার গোপনীয় নথিপত্র অনুযায়ী, সিআইএ-প্রধান প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ইসরায়েলের পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা সম্পর্কে তথ্য জানানোর পর নিক্সন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইসরায়েলকে বাধা দেওয়ার পক্ষে কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিক্সন সেসব মত অগ্রাহ্য করে বলেন, অঘোষিতভাবে পরমাণু বোমার মালিক ইসরায়েলের সঙ্গে আমেরিকা দিব্যি চলতে পারবে। নিক্সন প্রশাসনের ভেতরে ইসরায়েলের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরুদ্ধবাদীরা সুবিধা করতে পারেননি প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও কিসিঞ্জারের কারণে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার সুযোগ এখানে নেই। শুধু এটুকু বলা প্রয়োজন যে, আমেরিকার সহযোগিতায় না হলেও প্রশ্রয়ে ইসরায়েল গত শতকের ষাটের দশকেই পরমাণু অস্ত্রের মালিক হয়েছে। এখন তাদের কাছে ৭৫ থেকে ২০০টি পর্যন্ত পারমাণবিক ওয়ারহেড আছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। এ সংখ্যা ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি (ভারতের প্রায় ১০০টি, পাকিস্তানের ৯০-১১০টি)। কিন্তু ইসরায়েল কখনোই স্বীকার করেনি যে তাদের পরমাণু অস্ত্র আছে। তারা আমেরিকানদের শুধু এই আশ্বাস দিয়ে রেখেছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার ঘটলে তারাই প্রথমে সেটা ঘটাবে না।
ইসরায়েলই একমাত্র দেশ, যার পরমাণু অস্ত্র আছে, কিন্তু সেটা সে স্বীকার করে না। দেশটি পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেনি। এই ইসরায়েল যখন পরমাণু অস্ত্রহীন ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ চালানোর জন্য আমেরিকাকে ক্রমাগত প্ররোচিত করতে থাকে, তখন কেউ প্রশ্ন তোলে না, ইসরায়েলের পরমাণু অস্ত্রগুলোর কী হবে?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।