শুভ বাংলাদেশেরপদধ্বনি

বাংলা প্রবাদ বলে, বিপদে বন্ধুর পরিচয়। এ-ও আমরা জানি, বাঙালি এক আবেগপ্রবণ জাতি। কারও বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভ্যাস তার বহুদিনের। সমাজ বরাবর সংঘবদ্ধ ছিল এবং দারিদ্র্যের মধ্যেও মানবতাবোধ কখনো হারায়নি বাঙালি। সাভারে ভবনধসের ঘটনায় সেনাসদস্য, দমকল সদস্য, চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিঃস্বার্থ মানবসেবার অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। স্থানীয় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর সেখানকার চিকিৎসক-ছাত্রদের কথাও না বললেই নয়। তাঁরা প্রত্যেকে অকাতরে সর্বস্ব দিয়ে সেবাকাজে আত্মনিয়োগ করেছেন।

আমরা জানি, এর একটা উল্টো পিঠও আছে। সোহেল রানা ও ভবনের পোশাকশিল্প কারখানার মালিকদের প্রসঙ্গ আসবেই। চরম লোভ তাঁদের সাধারণ বিবেচনা ও মানবতাবোধ হরণ করে নিয়েছিল। সমাজে সোহেল রানারা স্বয়ম্ভু নন, তাঁদের বেড়ে ওঠার অবলম্বন থাকে। বরাবরের মতো এ ক্ষেত্রেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাই তাঁর অবলম্বন ছিল।

আমরা জানি, সমাজে দুর্নীতি আছে, ক্ষমতার অপব্যবহার চলে, বঞ্চনা ও বৈষম্য ব্যাপক, আইন না মানার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। এর বাইরে দারিদ্র্য, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, জঙ্গিপ্রবণতার মতো সমস্যাও আছে। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বেশ খারাপ, বিচারবহির্ভূত খুন ও গুমের ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে, নারীর স্বাধীনতা নানাভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে, সংখ্যালঘুরাও বারবার হামলার শিকার হচ্ছেন। কান পাতলে চারদিকে নানা অশুভ দুঃসংবাদ শুনতে পাই। এত কিছুর মধ্যেও কিন্তু বাংলাদেশ উন্নয়ন ও সামাজিক সূচকে এগিয়ে চলেছে। সম্ভাবনার অন্যতর বারতাও আমরা পাচ্ছি।

এই বছর অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি ঘটনায় যেন শুভ বাংলাদেশের সন্ধান পাওয়া গেল। ফেব্রুয়ারিতে যখন শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের সূচনা হলো, তাতে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে জেগে উঠেছিল। এ ছিল একদল দেশপ্রেমিক তরুণ-তরুণীর দলীয় রাজনীতির বাইরে এসে জাগরণ। বলা যায় বাংলাদেশের নবজাগরণ, যা সূচনা করেছিল নতুন সম্ভাবনার।

আমাদের ক্ষমতার রাজনীতির দুই শরিক বড় রাজনৈতিক দল এ সম্ভাবনাকে দুভাবে দেখল। তবে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রদর্শনের কঠিন পরীক্ষা দুই দলের মধ্যে বিএনপির জন্য ছিল বেশি। বিএনপি নেতৃত্ব প্রথম দিকে এ জাগরণের প্রতি কিছুটা আগ্রহ প্রদর্শন করেছিল। কিন্তু ভরসা করতে পারেনি। আর খালেদা জিয়া গতানুগতিকতার বাইরে এ জাগরণের অন্যতর যে ব্যঞ্জনা ও সম্ভাবনা, তা ধরতে পারেননি। ফলে এটিকে আওয়ামী লীগের একটি চাল হিসেবে ধরে নিয়ে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। এ অবস্থান কেবল গণজাগরণ মঞ্চের মহত্তর উদ্দেশ্য ও সম্ভাবনাকে বিতর্কিত করে তুলল তা নয়, তাঁর নিজের দলকেও ঠেলে দিল জামায়াত ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে ঐক্যের দিকে। আমরা দেখছি, সেই ঐক্য এখন রাজনৈতিক কৌশল ছাপিয়ে আদর্শিক বন্ধনে রূপ নিয়ে বেশ জোরদার ও কার্যকর হয়েছে। বিএনপি এখন জামায়াতের মতোই পুরোদস্তুর গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিপক্ষ।

এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে মাঠে নেমেছে হেফাজতে ইসলাম। মূলত কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এ সংগঠন ইসলামি সমাজব্যবস্থা কায়েমের নামে খোলাখুলি সরকারের বিরুদ্ধে নেমে পড়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গী হিসেবে জামায়াত ও বিএনপি এদের মদদ দিচ্ছে। ফলে এখন প্রায় অস্তিত্বের প্রশ্নেই গণজাগরণ মঞ্চকেও আওয়ামী লীগের সহযোগিতা নিতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগও যেন এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এ হলো আমাদের গতানুগতিক রাজনীতির গৎবাঁধা পথ। কিন্তু আবারও বলব, গণজাগরণ মঞ্চ অন্য সম্ভাবনা নিয়ে তৈরি হয়েছিল। বড় দুই দলের গৎবাঁধা রাজনীতি তার সে সম্ভাবনা ক্ষুণ্ন করেছে। 

এ পরিণতি দেশের জন্য ভালো হলো না। দুঃখের সঙ্গে কেবল বলতে হবে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে বেরোনোর যে সুযোগ গণজাগরণ মঞ্চকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল, তা আপাতত স্তিমিত হয়ে এল।

কিন্তু বাংলাদেশ তো আর মরবে না, ব্যর্থ রাষ্ট্র হবে না। অন্য কোনো উপলক্ষে অন্য কোনো পরিস্থিতিতে শুভ বাংলাদেশের জাগরণ আবারও ঘটবে। আর দেখতে দেখতে তা ঘটে গেল সাভারে ভবন বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে। আমরা দেখেছি, এ মানবিক ট্র্যাজেডির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তরুণ-তরুণীসহ সর্বস্তরের মানুষ আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। অসংখ্য মানবিক কাহিনির জন্ম দিয়েছে এ ঘটনা, আর তাতে দেশের সর্বস্তরের মানুষের যোগ ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিকতায়। আবারও আমরা শুভ বাংলাদেশের জাগরণ দেখলাম, তাকে কেন্দ্র করে মানুষের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকাও দেখলাম।

একটা বিষয় পরিষ্কার বোঝা যায়, নানা ব্যর্থতা আর দুর্নীতি-দারিদ্র্যের কেচ্ছার জঞ্জাল ডিঙিয়ে বাংলাদেশের মানুষ আজ মহৎ কিছু করতে চায়। মহৎ কাজে শরিক হতে চায়। ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা, লোভ, প্রতারণা, নিষ্ঠুরতার যে বৃত্ত, তা ভেঙে দিতে চায় তারা। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে কেন্দ্র করেই কিন্তু এসব নেতিবাচক প্রবণতা টিকে আছে। তাদের মধ্যকার আদর্শিক বিরোধের সুযোগে এবং তাদের সংঘাতের উপলক্ষে সমাজে নানা নেতিবাচক প্রবণতা বাড়ছে দিনে দিনে।

এ দুই দলকে কেন্দ্র করে দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, সংঘাতের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, এতকালের এ গতানুগতিক ক্ষমতার রাজনীতি নিয়ে বিরক্ত। এ থেকে ভালো কিছু তারা আশা করছে না। যারা আদর্শের প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এগোতে চায়, তারা দুই প্রধান রাজনৈতিক বিকল্পের মধ্যে হয়তো আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় কিংবা এ সরল দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতিতে তার ভূমিকা আদর্শিক বিচারে আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়। কিন্তু সেও আদতে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকেন্দ্রিক দূষিত দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা করে না। আমার ধারণা, গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের যে আন্দোলন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির দোটানায় আজ আওয়ামীপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, তাকেও আদতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ-সমর্থক বলে মনে করার কোনো কারণ নেই, এমনকি তাদের মনে বর্তমান আওয়ামী লীগ আর সে কাজে সক্ষম কি না, সে প্রশ্নও গভীর হওয়ার কথা।

আজ যারা সাভার ট্র্যাজেডিতে মানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তারাই মূলত শুভ বাংলাদেশের দূত। তারা বিএনপি নয়, জামায়াত নয়, আওয়ামী লীগও নয়। শুভ বাংলাদেশের দূতেরা একটি বারতাই সবার কাছে পৌঁছাতে চাইছে, আর তা হলো, গতানুগতিক ধারার ক্ষমতার রাজনীতির দিন শেষ। এ দিয়ে দেশের মানুষের বা গণতন্ত্রের আর কোনো সেবা করা সম্ভব নয়। আজ নতুন দিনে নতুন রাজনীতির এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজন। তারা বারবার সেই বারতা আমাদের দিতে চাইছে।

দুই দলের দখলদারির যে রাজনীতি চলছে, তা কাউকে নিজ দখলে সম্পূর্ণ না পাওয়া পর্যন্ত স্বস্তিবোধ করে না। এ রাজনীতি বশ্যতা-আনুগত্য-দাসত্বের রাজনীতি, এ রাজনীতি জানে না বিশ্বাস ও বন্ধুতা, স্বপ্ন ও সৌহার্দ্য, প্রেম ও মৈত্রীর মতো ইতিবাচক গুণাবলি। এ রাজনীতি লোভ ও দাপটের মতো দানবের কাছে বন্দী। এ রাজনীতি মানবকে হয় দানব বানায়, নয়তো বামন বানিয়ে ছাড়িয়ে দেয়।

এ রাজনীতি যে বন্ধ্যা, আমাদের সব সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে, মানুষের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, সেটা তরুণসমাজ বুঝতে পারে। তারা আজ জেগে উঠেছে। হয়তো শাহবাগ ঘিরে সৃষ্ট প্রাথমিক উন্মাদনায় ভাটা পড়েছে। কারণ, সমাজের বাস্তবতায় এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের সেই স্পৃহা, সেই আবেগ, সেই স্বপ্নে একটুও ভাটা পড়েনি। তারা জেগে আছে, সক্রিয় আছে, যেখানে প্রয়োজন সেখানে যুক্তির আয়ুধ নিয়ে হাজির হচ্ছে।

বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত সুস্পষ্টভাবে নিজেদের জন্য তামাদি হয়ে যাওয়া রাজনীতি আঁকড়ে ধরেছে। আওয়ামী লীগের চলমান রাজনীতিও তামাদি হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আদর্শিক অঙ্গীকারকে কেবল মুখের বুলিতে বা শুধুই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সীমাবদ্ধ না রেখে দৈনন্দিন দলীয় রাজনীতিতে যদি প্রয়োগ করতে পারে, তবে হয়তো শেষরক্ষা হতে পারে। অতীতে বঙ্গবন্ধু পরিস্থিতি ও বাস্তবতার দাবি বুঝে রাজনীতিতে সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে পেরেছেন, দলের আদর্শকে ক্রমেই প্রতিক্রিয়া থেকে প্রগতির পথে নিয়ে এসেছিলেন। আজকের নেতৃত্বের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো, তামাদি হয়ে যাওয়া রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে আগুয়ান শুভ বাংলাদেশের যাত্রায় শামিল হয়ে দিনবদলের প্রকৃত কাজটি করা।

একটা আশা জাগে, যখন দেখি প্রাথমিক পর্যায়ে গতানুগতিক প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য ব্যক্ত করার পরে প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতির গভীরতা অনুধাবন করে উদ্ধারকাজ ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পেরেছেন। এ সরকারের প্রথম পর্যায়ে বিডিআর বিদ্রোহ যেমন, তেমনি শেষ পর্যায়ে সাভার ট্র্যাজেডি বিরাট ঝুঁকি ও বিপর্যয় হিসেবে এলেও শেখ হাসিনা যথেষ্ট প্রজ্ঞার সঙ্গেই দুবারই পরিস্থিতি সামলেছেন। তিনি কি জনগণের, বিশেষত তরুণসমাজের ইশারা বুঝতে পারছেন? আমরা আশা করতে চাই।

নয়তো বাংলাদেশে নতুন দিনের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের কথা ভাবতে শুরু করবে তরুণসমাজ।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ওসাংবাদিক।