করপোরেশনের গোপন ক্ষমতা দখল

নতুন বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অবশিষ্ট দুনিয়ার মধ্যে মহা তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। এমন চুক্তিকে বলা হয় ‘মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি’। মূলত মার্কিন ও ইউরোপীয় করপোরেটের স্বার্থে এসব চুক্তি প্রণীত হয়, এগুলো আসলে পোষ মানা বাণিজ্য চুক্তি। আজকের দিনে এসব চুক্তিকে সাধারণত ‘অংশীদারি’ আখ্যা দেওয়া হয়, যেমন ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি)। কিন্তু এটা সমকক্ষদের মধ্যকার অংশীদারি নয়, কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সবকিছুর নির্দেশনা দেয়। সৌভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘অংশীদারেরা’ ক্রমেই প্রতিরোধ করা শুরু করেছে।
এটা বোঝা কঠিন কর্ম নয়। এসব চুক্তি নিছক বাণিজ্য, বিনিয়োগজনিত সুশাসন ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এগুলো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি, বিচারিক ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকেও প্রভাবিত করে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মতামত ও তার মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করার বালাই এখানে নেই।
সম্ভবত বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি এই চুক্তির সবচেয়ে বিদ্বেষজনক ও অসৎ দিক। অবশ্যই বিনিয়োগকারীদের দুষ্ট সরকারের কোপানল থেকে বাঁচাতে হবে, যে সরকার তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে চায়। কিন্তু এসব ধারা শুধু এ বিষয়কে কেন্দ্র করেই প্রণীত হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে দখলচ্যুতির ঘটনা তেমন একটা ঘটেনি। আর যে বিনিয়োগকারীরা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে চায়, তারা বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মাল্টিল্যাটেরাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি থেকে বিমা নিতে পারে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরকারও তেমন বিমা দিয়ে থাকে। তথাপি, যুক্তরাষ্ট্র টিপিপিতেও ও রকম ধারা রাখার দাবি করছে, যদিও তার অনেক ‘সহযোগীরই’ সম্পদ সুরক্ষা ও বিচারিক ব্যবস্থা তার নিজের মতোই ভালো।
এসব ধারার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাস্থ্য, পরিবেশ, নিরাপত্তা, এমনকি আর্থিক বিধিবিধানে রাশ টেনে ধরা, যেসব বিধান যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও নাগরিকদের রক্ষা করতে পারে। নিয়ন্ত্রণ আইনে পরিবর্তনের কারণে ক্ষতি হলে কোম্পানিগুলো সংশ্লিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারে।
এটা শুধু তাত্ত্বিক সম্ভাবনা নয়। উরুগুয়ে ও অস্ট্রেলিয়া সিগারেটের মোড়কে সতর্কবার্তা লাগানোর বিধান করায় আমেরিকান সিগারেট কোম্পানি ফিলিপ মরিস দেশ দুটির বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে। হ্যাঁ, স্বীকার করছি দেশ দুটি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সিগারেটের মোড়কে ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাববিষয়ক গ্রাফিক চিত্র যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করেছিল।
এই মোড়কে আচ্ছাদিত করার ব্যাপারটি কাজে লেগেছে। এটা ধূমপান নিরুৎসাহিত করছে। সে কারণে মরিস এখন ক্ষতিপূরণ দাবি করছে।
ভবিষ্যতে, আমরা যদি দেখি যে অন্য কোনো পণ্য স্বাস্থ্য সমস্যা (যেমন অ্যাসবেসটসের কথা ভাবুন) সৃষ্টি করছে, তাহলে সেটা আমাদের ওপর যে মূল্য চাপিয়ে দিচ্ছে, তার জন্য মামলার মুখোমুখি না হয়ে উল্টো তারা মানুষ মারার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের অভিযোগে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। কোনো দেশের সরকার যদি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ওপর আরও শক্ত বিধান আরোপ করে, তাহলেও একই ব্যাপার ঘটতে পারে।
আমি যখন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের কাউন্সিল অব ইকোনমিক অ্যাডভাইজার্সের চেয়ারম্যান ছিলাম, তখন পরিবেশবিরোধীরা একই রকম বিধান প্রণয়নের চেষ্টা করেছিল। যেটার নাম ছিল ‘রেগুলেটরি টেকিংস’ বা আইনি আদায়। তারা জানত, একবার আইন পাস হয়ে গেলে এসব বিধান স্থগিত হয়ে যেত, কারণ সরকারের পক্ষে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব নয়। সৌভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, আমরা এই উদ্যোগ বন্ধ করতে পেরেছি, আদালত ও মার্কিন কংগ্রেস উভয় জায়গাতেই।
কিন্তু এখন আবার সেই একই গোষ্ঠী বাণিজ্য বিলে এমন ধারা ঢুকিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করছে, যার বিষয়বস্তু মূলত লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা হয়েছে (করপোরেশনের চোখের আড়ালে নয়, তারা এটা ঢোকানোর জন্য তৎপরতা চালিয়েই যাচ্ছে)। আমরা এসব জানতে পারছি ফাঁসের কারণে, আর সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে। সরকারি কর্মকর্তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অধিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
মার্কিন সরকারব্যবস্থার মৌলিক দিক হচ্ছে এর নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, এই আইনি মানদণ্ড বহু বছর ধরে গড়ে উঠেছে। এর ভিত্তি হচ্ছে স্বচ্ছতা, নজির ও প্রতিকূল রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ। এসব কিছুই ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ, নতুন চুক্তিতে ব্যক্তিগত, অস্বচ্ছ ও খুবই ব্যয়বহুল সালিসির কথা বলা হয়েছে। তার পরও এই ব্যবস্থাপনার মধ্যে বিবদমান স্বার্থের ব্যাপার রয়েছে, যেমন মধ্যস্থতাকারী এক মামলায় বিচারক আবার আরেক মামলায় আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে পারেন।
এই বিচার-প্রক্রিয়া এতই ব্যয়বহুল যে উরুগুয়েকে ফিলিপ মরিসের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায় মাইকেল ব্লুমবার্গ ও অন্য ধনী মার্কিনদের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আর করপোরেশন মামলা করতে পারবে, কিন্তু অন্যরা তা করতে পারবে না। যেমন, শ্রম ও পরিবেশগত মানদণ্ডের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হলেও নাগরিক, ইউনিয়ন, সুশীল সমাজের প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ নেই।
যদি মৌলিক নীতি ভঙ্গকারী একপক্ষীয় বিরোধ নিষ্পত্তিকারী ব্যবস্থা থাকে, তাহলে এটাই হচ্ছে সেটা। সে কারণেই আমি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড, ইয়েল, বার্কলে প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ আইনি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে চিঠি লিখতে চাই, এসব চুক্তি আমাদের বিচারিক ব্যবস্থার জন্য কতটা হানিকর।
যুক্তরাষ্ট্রে এ চুক্তির যারা সমর্থক, তারা দেখাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা হলেও যুক্তরাষ্ট্র একটিতেও হারেনি। যদিও করপোরেশনগুলো কেবল শিখতে শুরু করেছে, কীভাবে এই চুক্তি নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করা যায়।
আর নিম্ন বেতনভুক্ত সরকারি আইনজীবীরা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানের উচ্চ বেতনভুক্ত আইনজীবীদের সমকক্ষ হতে পারে না। আরও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, উন্নত দেশগুলোর করপোরেশনগুলো সদস্যদেশগুলোতে সাবসিডিয়ারি তৈরি করতে পারে, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের দেশে ফের বিনিয়োগ করতে পারে। এরপর তারা মামলাও করতে পারে, এর মাধ্যমে তারা বিধিবিধান রুদ্ধ করে দিতে পারে।
সম্পত্তি সুরক্ষার আরও ভালো ব্যবস্থার প্রয়োজন হলে আর এই বেসরকারি ও ব্যয়বহুল সালিসি ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় বিচারিক ব্যবস্থার চেয়ে উন্নত হয়, তাহলে শুধু ধনী করপোরেশনগুলোর জন্য আইন পরিবর্তন করলে চলবে না, জনগণ ও ছোট ব্যবসার জন্যও তা করতে হবে।
মানুষের সমাজ ও অর্থনীতি নির্ধারণ করে বিধিবিধান। এসব বিধিবিধান দর–কষাকষির আপেক্ষিক ক্ষমতা হ্রাস করে, অর্থাৎ অসমতার ঝান্ডা উড়তেই থাকে, বিশ্বজুড়েই। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি ধনী করপোরেশনগুলোকে তথাকথিত বাণিজ্য চুক্তির গোপন ধারাগুলো ব্যবহার করতে দেব, যার মাধ্যমে ২১ শতকে আমরা কীভাবে বসবাস করব, তার দিকনির্দেশনা দেবে তারা। আমি আশা করি, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষ এই প্রশ্নের জবাবে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বলবেন, ‘না’।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ: নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ।