আকবর আলি খানের সংস্কার প্যাকেজ

.
.

সাড়ে চার শ বছর আগের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী স্যার টমাস গ্রেশাম, রানি এলিজাবেথ স্বয়ং যাঁর অতিথি হয়েছিলেন দুবার, তাঁর দেওয়া এই তত্ত্বটি অনেকেরই জানা যে খারাপ টাকা ভালো টাকাকে বাজার থেকে তাড়িয়ে দেয়। এটা আংশিক সত্য। পুরো সত্য হলো, খারাপ টাকা ভালো টাকাকে তাড়ায় তখনই, যখন দুইয়ের বিনিময়মূল্য একই হয়।
এখন ৪৭ বছরের গবেষণা আর ২৯ বছর ধরে লেখা সাবেক উপদেষ্টা ও মন্ত্রিসভার সচিব আকবর আলি খান তাঁর সদ্য ইউপিএল প্রকাশিত বইয়ের নামকরণ করেছেন গ্রেশাম’স ল সিনড্রোম অ্যান্ড বিয়ন্ড, এন অ্যানালাইসিস অব দ্য বাংলাদেশ ব্যুরোক্রেসি।
বাস্তবে আমরা গ্রেশামতত্ত্বের প্রায় দুই হাজার বছর আগের এথেন্সে ফিরে গেছি। কারণ, তখনই সক্রেটিসীয় চিন্তায় প্রভাবিত গ্রিক হাস্যরসাত্মক নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনস তাঁর ব্যঙ্গ নাটকে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় গ্রেশামতত্ত্ব দেখিয়েছিলেন। সেই নাটকের নির্যাস ছিল, এথেন্সে আর যোগ্য লোকের কদর নেই, সর্বত্র অযোগ্য লোকে ভরে গেছে।
এটা ঘটে যে সমাজে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন ব্যর্থ হয়।
ড. খানের সুচিন্তিত মত হলো, ‘রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের হাতেই এখন জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ও বদলি বলি হচ্ছে। সিভিল সার্ভেন্টদের নিরপেক্ষতা ধ্বংসপ্রাপ্ত, উৎকৃষ্ট জনসেবা দিতে তারা আর কার্যকর নয়। নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা আর নিরপেক্ষ আম্পায়ার হিসেবে বিশ্বস্ত নয়।’ আমাদের সন্দেহ যে গ্রেশাম জিন্দাবাদ আরও অনেক বছর ধ্বনিত হলে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলেও প্রশাসন আর আগের মতো আদৌ নিরপেক্ষ আম্পায়ার হতে পারবে কি না। সচিব, ডিসি, এসপি বদল কাজ দেবে না। আর তা দিলেও নির্বাচিত ব্যক্তিরা সুশাসন দিতে পারবেন না।
ড. খানের গবেষণা নিশ্চিত করেছে যে দ্রুত অবাধ নির্বাচন হোক বা না হোক, মানুষকে সামাজিক সুবিচার দিতে হলে কতিপয় প্রতিষ্ঠানকে আর বর্তমান অবয়বে রাখা যাবে না। কতিপয় প্রতিষ্ঠানের ডিজাইনে পরিবর্তন আনতে হবে।
বিএনপি রাজনৈতিক বিবেচনায় ১ হাজার ৪০২ জন কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে ২ হাজার ৩৭৯ জনকে, আওয়ামী লীগ গত আমলের প্রথম দুই বছরেই ৬৪১ জনকে ডিঙিয়ে ৬৭১ জনকে পদোন্নতি দিয়েছিল। রাজনীতিবিমুখরা ওএসডি বা গুরুত্বহীন পদে বছরের পর বছর পচনের শিকার। সচিব মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত সচিব দ্বারা হেনস্তা হন। অতিরিক্ত সচিব কোনো নীতিনির্ধারণী স্তর নয়, সচিবকে সহায়তা দিতে মাত্র কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল। অথচ পদোন্নতির সুনামির কারণে অতিরিক্ত সচিবের ২৩টি পদ এখন ২৯৫-এ উন্নীত হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ধাপ বাড়ায় বিলম্ব ঘটছে। উদ্বৃত্ত উপসচিব ও যুগ্ম সচিবরাও গতিরোধক!
সচিবালয়ের রাজনৈতিক উদ্বাস্তুরা (উদ্বৃত্ত লোকবল) বছরে ৫০ কোটি টাকা খাচ্ছে। তুঘলকি কায়দায় ১ হাজার ৪২০টি
পদ সৃষ্টির পরেও তার বিপরীতে ১ হাজার ৭৬৮ জনের পদোন্নতি ঘটেছে, এতেই বছরে অপচয় ৬৪ কোটি টাকা। নিম্ন স্তরে
সৃষ্টি করা কৃত্রিম শূন্য পদে নতুন নিয়োগে অপচয় ১০০ কোটি টাকা ছাড়াবে।
কিন্তু নীতিনির্ধারণে বাড়তি স্তর সৃষ্টির কারণে ব্যয় যে অনেক বাড়বে, তা ড. খান নির্দেশ করেছেন, এখন এর পরিমাণটা জানতে টিআইবিকে একটি সমীক্ষা চালাতে অনুরোধ জানাই। জাতীয় মাথাপিছু শাসন ব্যয় ও শাসন অপচয়টাও জানা জরুরি।
ড. আকবর আলি খান বলেছেন, ‘এখনো একটি ভারসাম্য টিকে থাকছে। কারণ প্রথমত, সংবিধান ও বিধিবিধান যেখানে যা কিছু আছে তা সবই নির্দলীয় নিরপেক্ষ জনপ্রশাসনের পক্ষে আছে। দ্বিতীয়ত, নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্বাচন হচ্ছে। তাই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সরকারে এসে বিদায়ী আমলের ভুক্তভোগীদের কড়ায়-গন্ডায় (বিএনপি দ্বারাÿ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা চাকরিসহ মাথাপিছু ৪৫ লাখ টাকা পেয়েছেন) পুষিয়ে দিচ্ছে।’ এটা রাজনীতিবাজ কর্মকর্তা তৈরিতে উৎসাহ বটিকা হিসেবে কাজ করছে। ‘মেয়াদ’ শেষে সরকার বদলের সম্ভাবনা কমে যাওয়ায় ওই ভারসাম্যও আর থাকছে না। আমলাদের মধ্যে আইনকানুন তোয়াক্কা না করার প্রবণতা বাড়ছে। আমলা ও নেতার ফারাক লোপ পাচ্ছে।
ড. খানের মতে, বিশেষ করে চারটি ক্ষেত্র—বিচার বিভাগ, পুলিশ, ভূমি রেকর্ড ও আমলাতন্ত্র ‘আইসোমরফিক মিমিক্রি’-এর শিকার। এ কথার সরল অর্থ হলো, এই চারটি ক্ষেত্রে ধস নেমেছে, একে শোধরাতে বড় ধরনের সংস্কার লাগবে।
ধরে নিই ‘আইসোমরফিক মিমিক্রি’ একটা সংক্রামক জীবাণুর নাম। এখনো শনাক্ত হয়নি। তবে আগে স্বীকার করতে হবে যে রাষ্ট্রের দেহে ব্যথা বোধ হচ্ছে। এরপর চিকিৎসার প্রশ্ন। কোনো বড় দল নয়, শত নাগরিক নয়, সহস্র নাগরিক নয়, কেউ তো বলছে না কতিপয় প্রতিষ্ঠান অসুস্থ হয়ে গেছে। কতিপয় কোমায় যাই-যাই করছে।
নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও বিএনপিকে তাই বলি, দেশে নির্বাচন নেই, তো এ কাজে সময় ব্যয় করুন। ২৯ বছর ধরে ভেবেচিন্তে ৭১ বছরে দাঁড়িয়ে ড. খান কী লিখলেন, সেই কাজে সময় ব্যয় করুন। সমাজের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে বৃহত্তর বোঝাপড়া, ব্যাপক তর্ক–বিতর্ক আগে। এ ছাড়া কোনো আমূল পরিবর্তন ঘটানো স্বপ্ন হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশ তার চার দশক পার করা প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়েই প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি ধরে রেখেছে, কিন্তু সেটা আজ বড় বেশি ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। ড. খান তাই সংস্কারবিমুখ থেকে উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষমতাসীন দলীয় দর্শন নাকচ করেছেন।
যখন আমরা কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না, আকবর আলি খান তখন একটি শ্বেতপত্র কি সবুজপত্রতুল্য শ্রেষ্ঠ সংস্কারপত্র হাজির করেছেন। কোনো দল বা মহলবিশেষকে বিব্রত করা তাঁর উদ্দেশ্য নয়, সে জন্য তিনি এটিকে স্মৃতিকথা হতে দেননি।
বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র ঐতিহাসিকভাবে সংস্কারবিমুখ। তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া ছাড়া সংস্কার চাইলে তারা কোনো দেবদূতকেও নাস্তানাবুদ করে দিতে পারে। কারণ, আমলাতন্ত্র এখন নিজেই যেন একটি কালোটাকার পাহাড় হয়ে উঠেছে। ওই পাহাড়ে হাতুড়ি-শাবল চালাতে হলে সাচ্চা জনপ্রতিনিধিত্ব লাগবে।
এখন নির্বাচন চান? চাই। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানরাই তো আসবেন? ভয় করে না? করে। তবে তাঁরা ভোট পেলে কী করব? বেশি উন্নয়নের জন্য বেশি দীর্ঘকাল ভোটাভুটি–শূন্যতা আবার দুকুল খোয়াতে পারে।
বিএনপি-জামায়াত জোট ড. খান বর্ণিত গ্রেশাম সিনড্রোম উল্টে দেবে? আলবৎ না। অবস্থা আরও নিকৃষ্ট হতে পারে।
এখন আমাদের মূল কাজ হলো ড. খান বর্ণিত ‘আইসোমরফিক মিমিক্রি’ দশা থেকে মুক্তির কৌশল রপ্ত করা। কতিপয় প্রতিষ্ঠানকে তার বর্তমান অবয়বে রেখে আর ঠিক করা যাবে না। ড. খানের বইটি যদি সমাজে অন্তত এই বিশ্বাসের সলতেটা নতুন প্রজন্মের প্রাণে জ্বালিয়ে দিতে পারে, তাহলে সেটাই হবে আমাদের এই চৌকস পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের কঠিন পরিশ্রমের কিছুটা সার্থকতা।
ইদানীং নাগরিক সমাজের চিন্তা–চেতনায় একটা পরিবর্তন লক্ষ করছি। বেগম খালেদা জিয়ার সুরে (এর আগে বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার) তাদের একটি অংশ সব সময় তথাকথিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং কতিপয় বায়বীয় মতাদর্শগত বিষয় নিয়ে মাতামাতি করেছে। অথচ অবাধ নির্বাচনের অভাবই সুশাসনের প্রতি একমাত্র হুমকি নয়। তাই শামসুল হুদারা যখন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিন্যাস বদলানোর রূপকল্প দিলেন, তা থেকে আশ্বস্ত হয়েছি। সংখ্যানুপাতিক ভোটব্যবস্থা, গণভোট প্রথা চালুসহ ড. খান তাঁর পাঁচ দফা সুপারিশে তা-ই বলেছেন।
দিন-রাত ভোটের জিগির যাঁদের তোলার, তাঁদের তুলতে দিন। আমরা সুপারিশ করি, ড. আকবর আলি খান যেভাবে বলেছেন তা নিয়ে নাগরিক সমাজকে সভা–সেমিনার, বিশেষ করে তাঁর সংস্কার ভাবনা থেকে কয়েকটি বাছাই করে নিয়ে দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিজ নিজ দলের অভ্যন্তরে সংলাপে উৎসাহী করা। ২০১৯ সালের আগে শাসক দল সংলাপ মানে ভোট চায় না। এটা নিশ্চয়ই বিএনপি বুঝবে। তার যদি নাগরিক সমাজ লাগে, তাহলে বিএনপিকে ড. খানের মানে নাগরিক শর্ত মানতে হবে। ভালো নির্বাচন না দিয়েই কেবল নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে বিমুখ থেকেও তারা গণতন্ত্রের ওপর আঘাত হানছে। দাতাদের টাকায় যে সংস্কার চলছে তা অকাজের।
‘আইসোমরফিক মিমিক্রি’ কথাটি আরও খুলে বলি। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে কথাটি জীববিদ্যায় ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। এটা একটি প্রক্রিয়া, যা বিবর্তনমূলক ধারায় কোনো একটি সুবিধা লাভের জন্য একটি অঙ্গ আরেকটি অঙ্গকে অনুকরণ করে। সত্তর ও আশির দশকে সংগঠনগত সমাজবিদ্যায় এর প্রয়োগ দেখা যায়। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর হলো হার্ভার্ড অধ্যাপক ল্যান্ট প্রিচেট, ম্যাট অ্যান্ড্রুজ পাবলিক পলিসি, বিশেষ করে আফ্রিকার জনপ্রশাসন সংস্থার প্রসঙ্গে আইসোমরফিক মিমিক্রি কথাটি অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁরা বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতাদের সহযোগিতায় আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান সংস্কারের ফল অত্যন্ত বেশি ক্ষতিকর হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো জানে না কী করে নতুন চ্যালেঞ্জ রুখতে হবে, তখন তারা নকল করে, যা সর্বদা সুফল দেয় না। আমরা রাষ্ট্র বটে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে আমরা একক ভূমিকা রাখতে পারি না।
হরতাল ও পেট্রলবোমার রাজনীতির আড়ালে বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফএর পরামর্শে সুফলহীন সংস্কার চলে আসছে। ড. খান বলেছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে গড়ে ওঠা মিমিক্রি ভেঙে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন করে প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্য তিনি কার্যত একটি সংস্কার প্যাকেজ দিয়েছেন।
রাজার সবগুলো ঘোড়া হাম্পটি ডাম্পটিকে টেনে তুলতে পারেনি। ড. খানের যুক্তি অকাট্য: ‘একটা ডিম ভেঙে মাটিতে পড়ে গেলে রাজার সবগুলো ঘোড়াও তা পুনরায় একত্র করতে পারবে না।’
ইতিমধ্যেই আমাদের কয়েকটি ডিম ভেঙে গেছে কিংবা আদৌ ভেঙেছে বলে আমরা স্বীকার করি কি না, তা শনাক্ত করতে নিরন্তর নাগরিক সংলাপ চাই। কারণ, এখনো আমরা সংস্কার বলতে যে করে হোক, ব্যক্তি অদলবদল করে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাকেই বুঝতে অভ্যস্ত।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]