মানব পাচার রোধে জনসচেতনতা

ধর্ম
ধর্ম

সভ্যতাবিবর্জিত জঘন্য অপকর্ম ‘মানব পাচার’ একটি সামাজিক ব্যাধি। যখন কোনো ব্যক্তি ধর্ম-কর্ম ভুলে আরেক ব্যক্তিকে দেশান্তর করে, তাকে স্বাধীনভাবে চলতে না দিয়ে, জবরদস্তি করে শ্রম দিতে বা পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য করে, তার ওপর যৌন নির্যাতন বা শ্লীলতাহানি করে অথবা মারধর, আঘাত বা অন্য কোনো রকম শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করে ক্ষতি সাধন করে, তা-ই হচ্ছে ‘মানব পাচার’। ইসলাম মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যেকোনো রকম মানবতাবিরোধী নির্যাতন প্রতিরোধে সোচ্চার। পাচারকারী চক্র মানুষের বিশ্বাসের চরম অবমাননা ও অবমূল্যায়ন করে থাকে। এ জন্য মানুষের প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাবধানবাণী ঘোষণা করেছেন, ‘এর চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কিছুই নেই যে তুমি এমন ব্যক্তির সঙ্গে মিথ্যার আশ্রয় নেবে, যে তোমাকে বিশ্বাস করে।’ (আবু দাউদ)
ইসলাম যেহেতু মানব পাচারকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে এবং পাচারকারীদের কঠিন শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে, সেহেতু পাচারের মাধ্যমে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের জীবন রক্ষায় আত্মনিয়োগ করা প্রতিটি মুসলমানের ওপর অবশ্যকরণীয়। অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের কী হলো যে তোমরা সংগ্রাম করবে না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য? যারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এই জনপদ, যার অধিবাসী জালিম, তা থেকে আমাদের অন্যত্র নিয়ে যাও; তোমার কাছ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক করো এবং তোমার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের সহায় করো।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৭৫)
অথচ বর্তমান যুগে অর্থ উপার্জনের সহজ মাধ্যম হিসেবে একদল ঘৃণ্য অপরাধী মানব পাচারকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। পাচারের জন্য নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করে তারা নারী ও শিশু পাচারের মতো ইসলাম পরিপন্থী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব অসভ্য লোক তাদের প্রতারণার ফাঁদ বিভিন্ন জায়গায় পেতে রেখেছে। তাদের প্রলোভনে পড়ে অনেক অবৈধ অভিবাসী অথই সাগরে মানবেতর জীবনযাপন করছে এবং তাদের জীবন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। মানব পাচারের পেছনে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই, বরং অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনই পাচারকারীদের মূল লক্ষ্য। তা ন্যায় পথে হচ্ছে কি অন্যায় পথে, সেটিকে তারা বড় করে দেখে না। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) যথার্থই সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘মানবজাতির কাছে এমন একটি সময় আসবে, যখন মানুষ কামাই-রোজগারের ব্যাপারে হালাল-হারামের কোনো বাছ-বিচার করবে না।’ (বুখারি)
যেসব উদ্দেশ্যে নারী ও শিশু পাচার করা হয়, ইসলাম সেসব গর্হিত কাজকে সমর্থন করে না। পাচারের শিকার হওয়া মানুষকে পাচারকারীরা বিদেশে বিভিন্ন অমানবিক কাজে নিয়োগ করছে। যেখানে পাচার করা ব্যক্তির মানবাধিকার বা কোনো স্বাধীনতা থাকে না। পাচারকারীরা নারী ও শিশুদের সাধারণত যেসব অবৈধ কাজে নিয়োজিত করে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শরিয়তসম্মত নয়। পাচারকৃত মানবসন্তানকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করা হয়, নারীদের পতিতাবৃত্তি বা অশ্লীল ছবি তৈরির অসৎ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম, যেমন—উটের জকি, অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, ছিনতাই, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করা হয়।
এসব কাজ ইসলামে অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মানব পাচারকে নারী ও শিশুর জন্য অমানবিক নির্যাতন হিসেবে দেখা হয়। কারণ, তারা যৌনতা, দাসত্ব, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেচাকেনার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং এটি মানুষের সহজাত ইচ্ছার বিরুদ্ধে মারাত্মক জুলুম বটে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে, যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিরুদ্ধাচরণ করে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ৪২)
নারী ও শিশু পাচার একটি মহা অন্যায় ও হারাম কাজ। ইসলাম মানব পাচারসহ মানবাধিকার পরিপন্থী যাবতীয় অনাচার প্রতিরোধকল্পে নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধের আলোকে মানুষকে গড়ে তোলার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। মানব পাচার নীতি-নৈতিকতাবিরোধী হারাম কাজ বিধায় এর মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ-সম্পদও হারাম। পাচার রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মানুষকে সদুপদেশের মাধ্যমে ইহকালীন লাঞ্ছনা ও পরকালীন ভয়াবহ পরিণতির কথা স্মরণ করে সচেতন থাকতে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। মানব পাচারের মতো নিষিদ্ধঘোষিত জঘন্যতম ঘৃণ্যতর অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে সমাজের নিঃস্ব, অনাথ, অসহায় ও হতদরিদ্র লোকেরা আর ঘৃণ্য পাচারের শিকার হবে না।
সামাজিক শৃঙ্খলা বিধানের জন্য মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধ দমনের জন্য প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের যে বিধান রাখা হয়েছে, তা ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। নারী ও শিশুদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য মানব পাচার বন্ধ করতে হবে আর এ জন্য সমাজের সচেতন জনগোষ্ঠীকে পাচারের বিরুদ্ধে দুর্লঙ্ঘ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। মানব পাচার অপরাধ দমনের জন্য এ মুহূর্তে দেশব্যাপী গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং সামাজিক আন্দোলন অত্যন্ত প্রয়োজন। জাতীয় পর্যায়ে সভা, সমাবেশ, সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠানে মসজিদের ইমাম, খতিব, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের জনসচেতনতা সৃষ্টিতে মানব পাচারের মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।