চত্বর এবং আন্দোলন

বিশ্বরাজনীতিতে একটা নতুন প্রবণতা দেখছি আমরা সাম্প্রতিক কালে। পৃথিবীর নানা শহরের প্রধান চত্বরকে ঘিরে গড়ে উঠছে উত্তাল আন্দোলন। মিসরের তাহরির চত্বর, তিউনিসিয়ার হাবিব বারগুইবা চত্বর, তুরস্কের তাকসিম চত্বর, বাহরাইনে পার্ল চত্বর, নিউইয়র্কের যুকোতি পার্ক চত্বর কিংবা আমাদের দেশে শাহবাগ চত্বরে জেগে ওঠা গণসমাবেশ রাজনীতিতে তৈরি করেছে নতুন মাত্রা। এসব চত্বরভিত্তিক আন্দোলনের কতগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যাচ্ছে। নগর স্থাপত্যের দিক থেকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এসব চত্বর সেই শহরগুলোর প্রধান চত্বর হলেও তা সেসব দেশের প্রচলিত জনপ্রিয় রাজনৈতিক চত্বর নয়। আরও লক্ষ করার ব্যাপার হচ্ছে, এসব চত্বরভিত্তিক আন্দোলনগুলো কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে বিক্ষুব্ধ, আপাতভাবে অসংগঠিত জনগোষ্ঠী, বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় না থেকে ব্যাপক এক গণজাগরণের জন্ম দিচ্ছে। এই গণজাগরণগুলো অনেকটাই অপ্রত্যাশিতভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে এবং স্থায়িত্ব খুব দীর্ঘ না হলেও সেসব দেশের রাজনীতিতে নানামুখী ও গভীর প্রভাব ফেলছে।
আমরা যদি আন্তর্জাতিক ইতিহাসের দিকে চোখ রাখি তাহলে দেখব, এ ধরনের আন্দোলন একটা যুগসন্ধির ইঙ্গিত বহন করে। এ ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণের সার্বিক প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা না গেলেও এর ভেতর সুপ্ত থাকে রাজনীতির একটা নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত। ১৯৬৮ সালের মে মাসে প্যারিসের ছাত্ররা নানা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থান নিয়ে যে ব্যাপক স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণের সূচনা করেছিল, তার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র সপ্তাহ দুয়েক কিন্তু এর প্রভাব ফ্রান্স তথা পুরো ইউরোপের জন্য ছিল সুদূরপ্রসারী। পরবর্তী সত্তর দশকে ইউরোপের রাজনীতিতে, সমাজজীবনে এমনকি চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রেও এই মে আন্দোলন এক ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এই ক্ষণস্থায়ী আন্দোলন শক্তিশালী দ্যাগল সরকারকে নাজুক করে দিয়ে ফ্রান্সের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়েছিল, এই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে। সার্ত্রে ইউরোপের চিন্তাজগতে এই আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে লিখেছেন। তেমনি চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ১৯৮৯ সালে ছাত্ররা সংগঠনবিহীনভাবে যে বিশাল গণজমায়েত করেছিল, তারও স্থায়িত্ব খুব বেশি দিন ছিল না কিন্তু এই আন্দোলনই ইঙ্গিত দিয়েছে পরবর্তী নব্বই দশকে সমাজতান্ত্রিক বলয়ের ব্যাপক ভাঙন এবং বিশ্বরাজনীতির আমূল পরিবর্তনের। বলা যায়, ফিল্মের নেগেটিভে যেমন মূল ছবিটা আবছা থাকে এবং নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তা স্পষ্ট হয়; এসব স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনি অনাগত ভবিষ্যতের একটা আবছা ছবি সুপ্ত থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তের চত্বরভিত্তিক যে আন্দোলনগুলো আমরা দেখছি, তাতেও এমন একটা যুগ পরিবর্তনের ইশারা দেখা যাচ্ছে। আমরা জানি, নব্বইয়ের দশকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতনের পর বিশ্বশক্তির ভারসাম্যের ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন আসে। বিশ্বব্যাপী এককভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারা এবং ধারণা করা হয়, এই ধারাতেই পৃথিবীর কাঙ্ক্ষিত মুক্তি আসবে। কিন্তু দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও এই বিশ্বব্যবস্থা পৃথিবীর জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনেনি, বরং নানা দেশে শক্তিশালী হয়েছে স্বৈরশাসকেরা, মানুষে মানুষে বেড়েছে বৈষম্য। এতে করে প্রচলিত বাম বা ডান উভয় ধারার রাজনীতির ওপরই আস্থা হারিয়েছে মানুষ। একটা কোনো সৃজনশীল নতুন ধারার রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী। বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক দলই এই বিপুলসংখ্যক অসন্তুষ্ট মানুষের কণ্ঠস্বরকে ধারণ করতে পারছে না। বলা যায়, সেই সূত্র ধরেই সংগঠনবিহীন লাখো লাখো মানুষ পৃথিবীর নানা শহরের চত্বরে এসে জড়ো হচ্ছে তাদের কণ্ঠস্বরটি শোনানোর জন্য। এ ধরনের গণজাগরণ প্রচলিত সংগঠনভিত্তিক রাজনীতির প্রতি অনাস্থারই প্রতিফলন। এ ধরনের আন্দোলনের ফলে কোথাও ধস নামছে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসকের, কোথাও জন্ম হচ্ছে রক্তপাতের, কোথাও একে বলপ্রয়োগে দমন করা হচ্ছে, কোথাও তা ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের আন্দোলনের কোনো একরৈখিক ফলাফল না থাকলেও দেখা যাচ্ছে, প্রচলিত ধারার রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে একটা নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা এখন মূর্ত হয়ে উঠছে পৃথিবীর নানা চত্বরে।
বাংলাদেশের শাহবাগ চত্বরে যে আকস্মিক, স্বতঃস্ফূর্ত গণজমায়েতটা ঘটেছিল, সেটাও বড় কোনো প্রচলিত রাজনৈতিক দলকে প্রতিনিধিত্ব করেনি। দলনির্বিশেষে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে একটা নৈতিক অবস্থান থেকে বিপুল মানুষ জমায়েত হয়েছিল শাহবাগ চত্বরে। এই গণজমায়েতকে যেমন অনেকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন, তেমনি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তরুণদের বিরুদ্ধে অগণিত কুৎসা রটানো হয়েছে, তাদের ফ্যাসিস্ট বলা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কলম ধরে অনেক বুদ্ধিজীবী, লেখক প্রবন্ধ-গল্প রচনা করেছেন। ইতিহাসের এ ধরনের পূর্ববর্তী আন্দোলনের মতোই শাহবাগের ওই গণজমায়েতের স্থায়িত্ব খুব দীর্ঘ হয়নি। অসংগঠিত এই জনগোষ্ঠীকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে আনার জন্য সক্রিয় হয়েছে সংগঠিত নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক দল। আন্দোলনের সংগঠকদের ভেতরও তৈরি হয়েছে মতবিরোধ। ঠিক একই রকম ব্যাপার ঘটেছিল উল্লিখিত ১৯৬৮ প্যারিস ্আন্দোলন বা ১৯৮৯-এর তিয়েনআনমেন স্কয়ারের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও। কিন্তু স্থায়িত্ব যাই হোক ইতিহাসে একটা অমোচনীয় দাগ রেখে গেছে এসব জমায়েত, ইতিহাসের বাঁক ফিরিয়েছে। বাংলাদেশে গত ৪০ বছরের ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন যা করতে পারেনি, শাহবাগ তা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করার দীর্ঘদিনের নানা তৎপরতাকে ঠেকিয়ে দিয়েছে তারা, দীর্ঘদিন ধরে দেশের মানুষের ভেতর সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক যে চেতনাগত বিভাজন তৈরি হয়েছে তাকে স্পষ্ট করেছে, বিভিন্ন দলের, ব্যক্তিবিশেষের মুখোশ উন্মোচন করেছে, সর্বোপরি এই আন্দোলনের সুবাদেই একটা আইনি ত্রুটি সংশোধন করে একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর সঠিক বিচার নিশ্চিত করা গেছে।
আগামী বাংলাদেশের রাজনীতি যে পথেই যাক, এই শাহবাগ চেতনা সেখানে একটা নির্ধারণী শক্তি হিসেবেই সুপ্ত থাকবে। যে চেতনার ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল, যেখানে ছিল একটা অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক দেশের আকাঙ্ক্ষা, যে আকাঙ্ক্ষা পূরণে গত চার দশকে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র, শাহবাগ আন্দোলন প্রমাণ করেছে সেই নৈতিক আকাঙ্ক্ষা মানুষের ভেতর মরে যায়নি, তা সুপ্ত হয়ে আছে একটা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর ভেতর। প্রমাণ করেছে এই আকাঙ্ক্ষার কথা তীব্র, অব্যর্থভাবে জানান দিতে প্রচলিত সংগঠনের প্রয়োজন পড়ে না। পরিস্থিতি তৈরি হলে এই ঘুমিয়ে থাকা বোধ যে আবারও এমন নতুন গণজোয়ার তৈরি করতে পারে, তার প্রমাণ ইতিহাসে আছে। ফলে ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তকমাধারী দল আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় যায় এবং সেই চেতনা পূরণে ব্যর্থ হয় তাহলে তাকে অদৃশ্য ওই শাহবাগ চেতনার জনগোষ্ঠীকেও মোকাবিলা করতে হবে। আর যদি আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী শক্তি জামায়াত, হেফাজত এবং তাদের সমর্থনকারী বিএনপি ক্ষমতায় যায় এবং দেশকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধারায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে তাদেরও বিবেচনায় রাখতে হবে শাহবাগের ওই ঘুমন্ত শক্তিকে।
বলা বাহুল্য, শাহবাগ আন্দোলনকারী তরুণেরা তাদের প্রথমবারের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তখন থাকবে আরও চৌকস এবং আরও প্রস্তুত। আমরা মিসরে দেখেছি, নির্বাচনের পর সরকার রাষ্ট্রকে তাহরির চত্বরের মূল চেতনার বিরোধী খাতে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করলে স্বতঃস্ফূর্ত জনতা আবার নেমেছে তাহরির চত্বরে। নির্বাচিত সরকারকেও চ্যালেঞ্জ করে পতন ঘটিয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, সেখানকার সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, রক্তক্ষয় ইত্যাদি কতটা কাঙ্ক্ষিত, তা ভিন্ন পর্যালোচনার দাবি করে। কিন্তু লক্ষ করার ব্যাপার হচ্ছে, তাহরির চত্বরে একবার যে শক্তি জড়ো হয়েছে, তা বারবার ফিরে আসতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, সমসাময়িক কালে আমরা বাংলাদেশে শাপলা চত্বরেও আরেকটা ভিন্নধর্মী সমাবেশ দেখেছি। যদিও সেটা কোনো সর্বজনীন সমাবেশ ছিল না, ছিল মাদ্রাসাভিত্তিক সাম্প্রদায়িক ভাবধারার একটা বিশেষ গোষ্ঠীর সমাবেশ, যাদের পেছনে শুরু থেকেই প্রকাশ্যে ছিল বিশেষ রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী। ওই শাপলা চত্বরেও উচ্চারিত হয়েছে অত্যন্ত রক্ষণশীল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী একটা বিশেষ গোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর। আগামী বাংলাদেশের রাষ্ট্র যাঁরা পরিচালনা করবেন, তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে শাপলা চত্বরে উচ্চারিত এই সাম্প্রদায়িক চেতনাকে তাঁরা কীভাবে মোকাবিলা করবেন। কথা এই যে বিশ্বব্যাপী নগরে নগরে, নানা চত্বরে চত্বরে যে কণ্ঠস্বরগুলো ধ্বনিত হচ্ছে, তার দিকে কান পেতেই নির্ধারিত হবে আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
[email protected]