দিনাজপুরে টেন্ডারবাজি নেই!

মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার দিনাজপুরবাসী
মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার দিনাজপুরবাসী

বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, ঘটনা সত্য। দিনাজপুরে এখন আর টেন্ডারবাজি নেই। সর্বশেষ গ্যাঞ্জাম হয়েছিল ২০০৯ সালে; গণপূর্ত বিভাগের কাজ নিয়ে। টেন্ডারে ঝামেলা হয়। এর পর থেকে বন্ধ। আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন সরকারি অফিসের টেন্ডার ভাগাভাগি ছিল। কোন টেন্ডার কার কাছে যাবে, সব আগে থেকে ঠিক করা থাকত। পরে বিএনপি আমলেও টেন্ডারবাজি হয়েছে। দলীয় লোক ছাড়া কেউ কাছে ঘেঁষতে পারত না। এখন টেন্ডারবাজি শূন্যের কোঠায়।
তবে এর মধ্যে কথা আছে। কারও কারও মতে, বাইরে দেখা না গেলেও ভেতরে ভেতরে টেন্ডারবাজি ঠিকই চলছে। শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়।
সদর আসনের সাংসদ ইকবালুর রহিম বললেন, অসম্ভব। সবার জন্য উন্মুক্ত টেন্ডার, দরপত্র কেনা ও জমা দেওয়ায় কোনো বাধা নেই। লটারি করে টেন্ডার দেওয়া হয়। যদি ভাগাভাগি থাকত, তাহলে সেতাবগঞ্জ সড়কের সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার কাজ, হাউসিংয়ের ১৪ কোটি টাকার কাজ বিএনপিদলীয় ঠিকাদারেরা পান কীভাবে?
সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি ও রাবার ড্যামের বেশ কয়েকটি প্রকল্পে ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে গত কয়েক বছরে। কোনো সমস্যা নেই। সাংবাদিক চিত্ত ঘোষকে জিজ্ঞেস করলাম, রহস্যটা কী? তিনি বললেন, সরকারি ক্রয়নীতি অনুযায়ী দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সামান্য কমবেশি দরে সবাই টেন্ডার জমা দেন। সেখানে দলবল নিয়ে মহড়া দেওয়ার সুযোগ নেই। যেহেতু প্রায় সবাই একই দর দেন, তাই লটারি করে কাজ দেওয়া হয়।
ছাত্রলীগ জেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সৈকত পালকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার, টেন্ডারে যুবলীগ-ছাত্রলীগের উৎপাত দেখছি না, এটা কীভাবে সম্ভব? তিনি জানালেন, টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে তাঁরা নীতিগত অবস্থান নিয়েছেন।
এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা আর কী হতে পারে? দিনাজপুরের পথ ধরলে সারা দেশের টেন্ডার জগতে বিপ্লব ঘটে যেতে পারে।
দিনাজপুরে রাজনীতি বলা যায় নিস্তরঙ্গ। নেই তেমন কোনো সহিংসতা। মোটামুটি শান্ত। চিত্ত ঘোষ বলেন, দিনাজপুরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায় হয়ই না। নদীভাঙন নেই। ঝড়-তুফান যদি বা হয়, ক্ষয়ক্ষতি সামান্য। প্রকৃতিগত কারণেই দিনাজপুরের সমাজ ও রাজনীতি বেশ শান্ত!
দিনাজপুরের রাজনৈতিক এই পরিবেশ একটু ব্যতিক্রমী মনে হলো। সন্ধ্যায় কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা বললাম। সমাজ নিয়ে ভাবে, স্পষ্ট কথা বলে, ন্যায়-অন্যায় বোঝে, স্বাধীন মতামত দেয়—এমন কিছু তরুণের সঙ্গে আমি কথা বলতে চেয়েছিলাম। প্রথম আলোর দিনাজপুর প্রতিনিধি আসাদুল্লাহ্ সরকার আমাকে শিল্পকলা একাডেমী এলাকায় নিয়ে গেলেন। পাশেই প্রেসক্লাব। সেখানে বসে কথা হলো ইমতিয়াজ উদ্দিন বুলবুল, নায়িম সরকার, কায়েস সরকার, রায়ান ঋদ্ধ, হামিদ শাহরিয়ার, সজীব, কে এস মনিরুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন তরুণের সঙ্গে। প্রায় সবাই ছাত্র। তারা রাজনীতি নিয়ে খুব বেশি ভাবে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার অভাব দেশের জন্য বড় দুর্যোগ ডেকে আনছে বলে মনে করে। একটা সমঝোতা হোক। নির্বাচনটা ভালোভাবে হোক, এটা তারা চায়।
তরুণদের সবাই একবাক্যে বলল, দুই বড় দলে পাল্টাপাল্টি থাকলেও দিনাজপুরে যে দলীয় রাজনীতিতে সহিংসতা নেই, এটা তাদের স্বস্তি দেয়। একজন বলল, জামায়াত-শিবির মাঝেমধ্যে ঝটিকা মিছিল করে। পুলিশ ও প্রশাসনের ভয়ে দলের নেতা-কর্মীরা তটস্থ থাকেন। জামায়াত-শিবিরের প্রতি সমর্থন সম্প্রতি কমে গেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার মানুষ সমর্থন করে।
দিনাজপুরে মানুষ কি গরিব হচ্ছে, নাকি তাদের সংসারে কিছুটা হাসি ফুটছে? এ প্রশ্নে একটু ভেবে একজন তরুণ বলল, মানুষের অভাব কমেছে, কিন্তু চাহিদা ও প্রত্যাশা বেড়েছে। কী রকম? তার উত্তরে একজন বলল, এই যেমন ধরা যাক, আগে একটি পরিবারে দুবেলা ভালোভাবে খাওয়া সম্ভব হতো না। এখন অন্তত সেটা হয়। কারও বাসায় সাদা-কালো টেলিভিশন ছিল। পাশের বাসায় রঙিন টিভি এসেছে। এখন সে ভাবছে, তারও রঙিন টিভি চাই!
শহরে ভিক্ষুক কমেছে। কাজের লোক পাওয়া যায় না। অর্থাৎ, কর্মসংস্থান বেড়েছে। কোথায় কাজ করে তারা? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সবাই সমস্বরে বলে উঠল, গার্মেন্টসে চাকরি করে। ওরা ঢাকায় যায়। একজন তরুণ একেবারে পাক্কা হিসাব দিয়ে বলল, দিনাজপুরের প্রতিটি গ্রামের প্রতি পরিবারের অন্তত একজন ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করে। তাদের বেশির ভাগই মেয়ে। চাকরির শুরুতে গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারে না। কিন্তু বছর দুয়েক পর থেকেই টাকা পাঠানো শুরু হয়। বছরে অন্তত দুই ঈদে তারা গ্রামের বাড়ি আসে।
সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় দিনাজপুর সদর, ফুলবাড়ী, বিরলসহ কয়েকটি উপজেলার বেশ কয়েকজন পোশাকশ্রমিক আহত হয়েছেন। বীরগঞ্জের একজন মারা গেছেন। বিস্ময়কন্যা রেশমা দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের মেয়ে। তিনি রানা প্লাজা ধসে কংক্রিটের নিচে আটকে পড়ে ছিলেন ১৭ দিন। তাঁকে উদ্ধারের পর দেশে ও বিদেশে সাড়া পড়ে যায়। এখন ঢাকার ওয়েস্টিনে তিনি চাকরি পেয়েছেন।
এ ছাড়া আছে অনেক এনজিও। সেখানে গ্রামের মেয়েদের চাকরি হয়। আজ ভোরে সার্কিট হাউসের সামনের রাস্তা দিয়ে একজন তরুণীকে মোটরসাইকেল চালিয়ে কাজে যেতে দেখেছি। ঢাকায়ও এ রকম দৃশ্য চোখে পড়ে না। তরুণদের একজন বলল, ওরা শুনেছে, সরকার নাকি ৫০ লাখ বেকার যুবককে বিদেশে চাকরির ব্যবস্থা করবে। সরকারি ওয়েবসাইটে এ খবর দেওয়া হয়েছে। সে নিজে দেখেছে। জনপ্রতি ২৪৬ টাকা দিয়ে পৌরসভায় রেজিস্ট্রেশন করতে বলা হয়েছে। সে ভুরু নাচিয়ে বলল, ৫০ লাখ লোক, মাথাপিছু ২৪৬ টাকা! এ টাকায় দুটি পদ্মা সেতু হতে পারে! তার হিসাবে ভুল আছে বটে। কিন্তু সে যে পদ্মা সেতু নির্মাণের আশা-নিরাশার সঙ্গে এই চাকরিপ্রাপ্তির প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তির আশঙ্কার একটা তুলনামূলক বিচার করেছে, সেটা লক্ষণীয়।
চাকরি আছে, আবার নেইও। চাকরি থাকলেও আছে সংসারে টানাটানি। আছে মানসিক চাপ। এই পরিস্থিতিতে দিনাজপুরে ঘটছে মাদকের বিস্তার। প্রধানত ফেনসিডিল। এ সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে। তরুণেরা জানায়, মাদকের বিরুদ্ধে প্রশাসনের তৎপরতা দুর্বল।
অবশ্য কয়েক দিন আগে কোতোয়ালি পুলিশ ৫০০ বোতল ফেনসিডিল আটক করেছে। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীকে ধরা যায়নি। চিত্ত ঘোষ বললেন, সব সময়ই এটা দেখা গেছে। মাদকের চালান ধরা পড়ে, কিন্তু মূল ব্যবসায়ী নাকি আগে থেকে টের পেয়ে পালিয়ে যান। অপরাধীদের ধরা যায় না। প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, যশোর থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত বিস্তৃত সীমান্তজুড়ে ভারতীয় অংশে ফেনসিডিল তৈরির অন্তত ৩৯৬টি কারখানা রয়েছে। এটা উদ্বেগের বিষয়।
শহরের চাউলপট্টি, সুইহারি ডিগ্রি কলেজের আশপাশে, গুড়গোলা, মেডিকেল কলেজ এলাকা—এসব জায়গায় ফেনসিডিলের খালি বোতল কুড়িয়ে পাওয়া যায়। সাধারণত একটু সচ্ছল ঘরের তরুণেরাই মাদকে আকৃষ্ট হচ্ছে। ছোট এক বোতল ফেনসিডিলের দাম ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। এই টাকা জোগাড়ের জন্য ছিঁচকে চুরি বেড়েছে, এমন অভিযোগ করছেন অনেকে। তবে বড় ধরনের অপরাধ ঘটে না। ইভ টিজিং আগে ছিল, এখন প্রায় নেই।
মাদকে আক্রান্তদের বাঁচানোর জন্য কয়েকজন তরুণ কাজ করছে। এ রকম খুব কমই দেখা যায়। মাদকাসক্ত কয়েকজন তরুণ নিজেদের চেষ্টা ও চিকিৎসায় ভালো হয়ে এ উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা ‘অশ্রু’ নামের একটি মাদক নিরাময়কেন্দ্র পরিচালনা করছে। সন্ধ্যায় আমি সেখানে যাই। একটা ছোট সুন্দর বাসা। সেখানে রয়েছে প্রায় ৩০ জন মাদকাসক্ত তরুণ। তাদের চিকিৎসা চলছে। তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা হয়। মর্যাদা দেওয়া হয়। স্নেহ-মমতার পরিবেশে তারা সুস্থ হয়ে ওঠে।
অশ্রুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাফর উল্লাহ আহমেদের সঙ্গে কথা বলে বেশ উৎসাহিত হলাম। জাফর সাহেব নিজে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। পরে চিকিৎসায় রোগমুক্ত হন। সুস্থ হয়ে ওঠা এ রকম তিনজন মিলে মাদক নিরাময়কেন্দ্র অশ্রুর দায়িত্ব নেন।
মাদকের বিস্তারের জন্য এর সহজলভ্যতাকে দায়ী করেন কাজী জাফর উল্লাহ। তা ছাড়া রয়েছে পরিবারে মূল্যবোধের অভাব। সমাজে অবৈধ উপার্জনের একটা অশুভ প্রতিযোগিতা চলছে। অনেকে বিনা পরিশ্রমে অর্থ উপার্জন করতে চায়। কিশোর-তরুণদের সুস্থ বিকাশের সুযোগও কমে আসছে। নেই খেলার মাঠ। এ কারণে সহজে অনেকে মাদকের দিকে ঝুঁকছে।
জাফর উল্লাহ বললেন, তাঁদের অশ্রু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে। কিন্তু সরকারি সহযোগিতা বলতে তেমন কিছু নেই। এসব স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে সরকারের সহযোগিতা খুব দরকার।
সরকার যদি এগিয়ে আসে আর রাজনীতি যদি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে তরুণেরা দিনাজপুরকে উন্নয়নের সামনের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। প্রশ্ন হলো, আগামী দিনের অনিশ্চিত পরিস্থিতি সে সুযোগ কি দেবে?
দিনাজপুর থেকে
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail