মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যা ও নিরাপদ মাতৃত্ব

ধর্ম
ধর্ম

মাতৃত্ব অর্জন নারীসত্তাকে নিরাপদ জীবনের পরিপূর্ণতায় পৌঁছে দেয়। এ জন্য সন্তান গর্ভে এলে নারীকে ধর্মীয় অনুশাসন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হয়, তা না হলে মা ও শিশু উভয়েরই মৃত্যুর আশঙ্কা হতে পারে। একজন পরিপক্ব সুস্থ মা-ই একজন সুস্থ শিশু জন্ম দিতে পারেন। সুস্থ শিশুর জন্য নিশ্চিত করা দরকার নিরাপদ মাতৃত্ব। এ জন্য গর্ভবতী মায়ের প্রয়োজনীয় বিশ্রাম, যত্ন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন নারী নিরাপদে মা হবেন, এ দায়িত্ব সবার, প্রকৃতপক্ষে নিরাপদ মাতৃত্ব প্রত্যেক গর্ভবতী নারীরই ন্যায্য প্রাপ্য বা ন্যায়সংগত অধিকার। এর সঙ্গে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই মা ও নবজাতক শিশুর ভরণপোষণ সম্পর্কে বাবার করণীয় সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘জনকের কর্তব্য যথাবিধি তাদের ভরণপোষণ করা।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৩)
অথচ সমাজে অধিকাংশ সন্তানসম্ভবা নারী সুষম খাদ্যের অভাবে নানা ধরনের অপুষ্টির শিকার। ফলে তাদের নবজাত সন্তানও হয় পুষ্টিহীন। ভবিষ্যতে কন্যাশিশুটি একদিন পরিবারে মায়ের অবস্থানে যায়। সাধারণত পরিবারে স্বামী বা অন্য সদস্যদের খাদ্য পরিবেশনের পর স্ত্রী নিজের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার রাখেন না। তাই স্ত্রী বা সন্তানের মা যাতে যথাযথ পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণে যত্নবান হন, সেদিকে স্বামীর সতর্ক দৃষ্টি রাখা অত্যাবশ্যক। সন্তান পেটে এলে গর্ভবতী নারীর বিভিন্ন পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য প্রয়োজন। কেননা, তার খাবারে একটি নয়, মা ও শিশু দুটি প্রাণ বাঁচে। বিশেষ করে গর্ভকালীন এবং শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান বা দুধদানকালে খাদ্যের ব্যাপারে বেশি সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। এ জন্য গর্ভবতী স্ত্রীর খাবারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা (স্বামীরা) যা খাবে, তাদের (নারীদের) তা-ই খেতে দেবে।’
একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তুলতে প্রয়োজন মায়েদের সুস্থ রাখা। একজন সুস্থ মা-ই সুস্থ জাতি উপহার দিতে পারেন। তাই গর্ভবতী মায়ের যত্ন মূলত শিশুর যত্ন। সন্তান যে মুহূর্তে মাতৃগর্ভে আসে, ঠিক তখন থেকেই শিশুর যত্নের সঙ্গে মায়ের যত্ন নিতে হয়। সন্তান গর্ভে এলে মায়ের শরীরে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য ও পুষ্টির দরকার হয়। এ সময় মায়ের নিজের ও গর্ভের শিশুর দুজনের খাদ্য প্রয়োজন। তাই গর্ভবতী মাকে বেশি করে পুষ্টিকর ও পরিমিত সুষম খাবার খেতে হবে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের আমি যেসব পবিত্র বস্তু দিয়েছি, তা থেকে আহার করো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭২)
মহান সৃষ্টিকর্তা নারীকে প্রদান করেছেন নিরাপদ মাতৃত্বের অধিকার তথা গর্ভধারণের ক্ষমতা। যদিও নারীর গর্ভধারণ ও শিশু জন্মদানের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সন্তান জন্মদান-সংক্রান্ত জটিলতা ও অনিরাপদ প্রসবজনিত কারণে কেউ অকালে মারা যান, কেউ আজীবন রোগাক্রান্ত জীবনযাপন করেন। এভাবে পারিবারিক অসচেতনতা, মাতৃস্বাস্থ্যসেবার নিম্নমুখী মান, ভুল চিকিৎসা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, সর্বোপরি স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলার কারণে গর্ভবতী নারীরা যথাযথ প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গর্ভধারণের সময় স্ত্রীর শারীরিক-মানসিক সুস্থতার জন্য সর্বাগ্রে চিকিৎসা প্রয়োজন। এ জন্য নবী করিম (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা রোগ ও দাওয়া (ওষুধ) দুটোই পাঠিয়েছেন এবং প্রতিটি রোগের ওষুধ পাঠিয়েছেন, সুতরাং তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো।’ (মিশকাত ও আবু দাউদ)
ইসলামে মা ও শিশুর জীবন নিরাপদ রাখার জোরালো তাগিদ দেওয়া হয়েছে। নিরাপদ মাতৃত্বের জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ শিশুর জীবন সুরক্ষায় সমানভাবে সহায়ক। শিক্ষার অভাব ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে গ্রামাঞ্চলে মায়েরা ঘন ঘন সন্তান ধারণের কারণে মাতৃস্বাস্থ্যের পরিচর্যা না হওয়ায় পুষ্টিহীন মা ও শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। এভাবে মাতৃত্বকালীন অপুষ্টির কারণে রোগাক্রান্ত মায়েদের স্বাস্থ্যহানি ঘটায় নবজাতকের মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। সাধারণত বাল্যবিবাহ, গর্ভসঞ্চার, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, কিশোরী মায়ের পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতা, গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ, প্রসবজনিত ফিস্টুলা ও সুচিকিৎসার অভাব প্রভৃতি কারণে নারীর নিরাপদে মা হওয়াটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। সুতরাং মাতৃমৃত্যু রোধ করতে হলে গর্ভধারণ থেকেই সন্তানসম্ভবা মায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। গর্ভকালীন ও প্রসব-পরবর্তী প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণও নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্য মুসলিম পরিবারের সবাই গর্ভবতী হওয়া থেকে প্রসব পরবর্তী সময় পর্যন্ত মাকে ধর্মীয় দিকনির্দেশনা, সৎ পরামর্শ ও উৎসাহ দিতে পারেন। আল্লাহর ওপর ভরসার পাশাপাশি ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করাও ইসলামের শিক্ষা। রাসুলুল্লাহ (সা.) চিকিৎসা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা চিকিৎসা করো। কারণ, যিনি রোগ দিয়েছেন, তিনি তার প্রতিকারের জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’ (আবু দাউদ)
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় মাকে খুব সতর্ক থাকতে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গৃহে অদক্ষ ধাইয়ের হাতে বা গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছ থেকে ভুল চিকিৎসা নেওয়ার কারণে অনেক মা অনিরাপদে সন্তান প্রসবকালীন মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। গর্ভকালীন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সুচিকিৎসা না করলে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। গর্ভবতী মা ও শিশুকে বাঁচাতে হলে প্রতিটি গ্রামে জনসচেতনতামূলক প্রজনন স্বাস্থ্যসেবাসহ ইসলামের আলোকে পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। ঘন ঘন সন্তান প্রসব থেকে বিরত রাখার জন্য মাঠপর্যায়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এগিয়ে এসে জনগণকে সজাগ করতে সঠিক পরামর্শ দিতে হবে। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যা সুনিশ্চিত করতে নিরাপদ মাতৃত্বের সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়নে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরিবার পরিকল্পনার যথাযথ পদ্ধতি গ্রহণ ও এর বাস্তবায়ন একান্ত অপরিহার্য। তাই গর্ভবতী নারীর নিরাপদ মাতৃত্বের অধিকার ও মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশের আপামর জনসাধারণের ব্যাপকভাবে গণ-উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]