মধ্য শাবানের পুণ্যময় রজনী

ধর্ম
ধর্ম

আরবি চান্দ্রমাসের মধ্যে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ শাবান মাসের মধ্যভাগে রয়েছে লাইলাতুল বরাতের মতো পুণ্যময় রজনী। হিজরি সালের শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রি হাদিসের পরিভাষায় ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান’ অর্থাৎ ‘শাবানের মধ্যবর্তী রজনী’কে উপমহাদেশে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। প্রতিবছরের মতো শবে বরাত মুসলমানদের কাছে রমজান মাসের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। আসন্ন মাহে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য শাবান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফজিলতময় মাস। রাসুলুল্লাহ (সা.) অধিক হারে এ সময় দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাসে আমাদের ওপর বরকত নাজিল করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন!’ (মুসনাদে আহমাদ)
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে শাবানের মধ্য রজনীটি আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে পুণ্যময় ও মহিমান্বিত বলে বিবেচিত। আল্লাহ তাআলা মানবজাতির জন্য তাঁর অশেষ রহমতের দরজা এ রাতে অবারিত করে দেন। রাত জেগে নফল ইবাদত করে গুনাহখাতা মাফ ও অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তা কবুল করেন এবং অনুতপ্ত বান্দাদের পাপমুক্ত করে দেন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মধ্য শাবানের রাত্রিতে আল্লাহ তাআলা রহমতের ভান্ডার নিয়ে তাঁর সব সৃষ্টির প্রতি এক বিশেষ ভূমিকায় আবির্ভূত হন এবং মুশরিক অথবা হিংসুক ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (তাবারানি) অন্য হাদিসে আছে, ‘আল্লাহ তাআলা ১৫ শাবানের রাতে প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং এ রজনীতে কেবল মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (বায়হাকি, ৩/৩৮০)
আল্লাহ তাআলা মানবসমাজ তথা বিশ্বের সব সৃষ্টির পরবর্তী বছরের ভাগ্য এই রাত্রিতে পুনর্নির্ধারণ করেন। তিনি মুমিন বান্দাদের আকুতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন, ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিদের উত্তরণের পথ দেখান। এ দিন সূর্যাস্তের পর থেকে তিনি মানুষের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এ জন্য মুসলমানদের কাছে শবে বরাতের নফল ইবাদত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রজনী আসে তখন তোমরা রাত জেগে ইবাদত করো এবং পরের দিন রোজা রাখো। কেননা প্রতিটি রাত্রিতে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করব। সুবহে সাদেক পর্যন্ত এ আহ্বান অব্যাহত থাকে।’ (ইবনে মাজা)
নবী করিম (সা.) শাবান মাসে বেশি নফল রোজা রাখতেন এবং সাহাবিদের রোজা পালন করতে বলতেন। হজরত উসামা বিন যায়েদ (রা.) বলেন, ‘একদা নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি তো আপনাকে শাবান মাসের মতো অন্য কোনো মাসে এত অধিক রোজা রাখতে দেখি না।’...উত্তরে তিনি বললেন, ‘শাবান মাসটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী মাস। অনেক মানুষ এ মাসের ফজিলত সম্পর্কে উদাসীন থাকে। অথচ বান্দার আমলসমূহ এ মাসে আল্লাহর সমীপে পেশ করা হয়। এ জন্য আমি চাই যে আমার আমলসমূহ আল্লাহর দরবারে এমতাবস্থায় পেশ করা হোক যে আমি রোজাদার।’ (বায়হাকি)
তাই মাহে রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসের অন্যতম ঐচ্ছিক ইবাদত রোজা পালন হিসেবে ‘নিস্ফে শাবান’ তথা শবে বরাতের আগে সোমবার ও বৃহস্পতিবার মিলিয়ে কমপক্ষে দুটি নফল রোজা পালন করা উচিত। তা ছাড়া, প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে ‘আইয়ামে বিজের’ তিনটি নফল রোজা পালনের জন্য নবী করিম (সা.) অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, ‘যখন তুমি মাসে তিনটি রোজা রাখতে চাও, তখন ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখো।’
পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর কবর জিয়ারত এবং ইসালে সওয়াব শবে বরাতের নেকআমল। একদা মধ্য শাবানের রজনীতে উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে রাসুলে করিম (সা.) নীরবে জান্নাতুল বাকির সমাধিস্থলে গিয়ে মৃত ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করছিলেন। (বায়হাকি) নবী করিম (সা.) কবর জিয়ারতে গিয়ে মানুষকে এ দোয়া করতে শিক্ষা দিয়েছেন, ‘হে কবরবাসী মুমিন ও মুসলিমগণ! তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক! আমরাও ইনশা আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব! আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের এবং তোমাদের জন্য ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি!’ (মুসলিম)
যুগ যুগ ধরে শবে বরাতে মুসলিম সম্প্রদায় যথাসাধ্য রাত্রি জাগরণ করে বাসায় ও মসজিদে ঐচ্ছিক ইবাদত তথা নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, তওবা-ইস্তেগফার ও দোয়া-দরুদে মশগুল থাকেন এবং পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কল্যাণ, দেশ-জাতি তথা মুসলিম উম্মাহর শান্তি, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য আল্লাহর রহমত কামনায় এবং সবার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা ও কল্যাণ কামনায় বিশেষ মোনাজাত করেন। এতে মুমিন বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সক্ষম হন এবং ব্যক্তিজীবনে এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটে।
রোজাদার মুসল্লিরা সাধ্যমতো দান-সাদকা, গরিব-দুস্থদের মধ্যে হালুয়া-রুটি বিতরণ এবং পরলোকগত ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাত কামনায় কবর জিয়ারত করে ফাতিহা পাঠ করেন। এভাবে শবে বরাতের তাৎপর্য অনুধাবন করে ধর্মপ্রাণ মানুষ সর্বক্ষেত্রে অন্যায় পরিহার ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হন। তবে সারা বছর ফরজ ইবাদত না করে শুধু শবে বরাতে রাত্রি জেগে নফল ইবাদত করে সব ধরনের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, এমন চিন্তার কোনো সুযোগ নেই। আতশবাজি বা এ ধরনের কিছুর মাধ্যমে যাতে নফল ইবাদতরত ধর্মপ্রাণ মানুষের আল্লাহর ধ্যানে বিঘ্ন না ঘটে, সেদিকে সবার দৃষ্টি রাখা উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]