তাহের ও জিয়ার সম্পর্কের পরিণতি

বিশেষ সামরিক আদালতে কর্নেলতাহেরের মৃত্যুদণ্ডের রায় চ্যালেঞ্জ করে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনাটি ফের আলোচনায় এসেছে। কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের লেখায় এই ঘটনার

প্রধান দুই কুশীলব আবু তাহের ও জিয়াউর রহমানের ভূমিকার ওপর আলো ফেলা হয়েছে। 

সম্প্রতি তাহেরের ফাঁসিকে একটি হত্যাকাণ্ড এবং তাঁর পেছনে জেনারেল জিয়ার সংশ্লিষ্টতার ঘোষণা দিয়ে হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল তাহের ও জিয়ার সম্পর্কের প্রেক্ষাপটটি বর্ণনা করেছি। আজ সেই সম্পর্কের পরিণতির ওপর আলোকপাত করতে চাই। আগেই উল্লেখ করেছি, স্বাধীনতা-উত্তরকালের মুজিব সরকারের প্রকাশ্যে বিরোধিতাকারী শক্তিশালী বামধারার রাজনৈতিক দল জাসদের নানা তৎপরতার ব্যাপারে জিয়া অবহিত হতেন তাহেরের মাধ্যমে, অন্যদিকে গোপনে মুজিব সরকারকে উৎখাতে মোশতাক চক্রের ডানপন্থী ধারার ষড়যন্ত্রের খবর তিনি পেতেন ফারুক, রশীদের মাধ্যমে। সরকারবিরোধী দুটি শক্তিই সম্ভাব্য রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনীর কৌশলগত সহায়তা পেতে অসন্তুষ্ট উপসামরিক প্রধান জিয়াকে তাদের সম্ভাব্য মিত্র বলে বিবেচনা করেছিল। জিয়া দুটি তুরুপের তাসই নিজের হাতে রেখেছিলেন।

বাংলাদেশের রাজনীতির অস্ট্রেলীয় গবেষক ডেনিস রাইটকে উদ্ধৃত করে গতকাল লিখেছিলাম, যখন ফলাফল অস্পষ্ট, তখন খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সব রকম পথ খোলা রাখা জিয়ার স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য। (হাবীব জাফারুল্লাহ সম্পাদিত দ্য জিয়া এপিসোড ইন বাংলাদেশ পলিটিকস, সাউথ এশিয়ান পাবলিশার, ১৯৯৬)। বলা বাহুল্য, ফলাফল স্পষ্ট হয় ১৯৭৫ সালের আগস্টে যখন মোশতাক চক্রের ডানপন্থী ষড়যন্ত্রমূলক শক্তিটি শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে সরকার উৎখাতে সফল হয়। তুরুপের দুটি তাস হাতে রাখার সুফলও পান জিয়া। নতুন সরকারপ্রধান মোশতাক বিদ্যমান সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে সরিয়ে সেনাপ্রধান করেন জিয়াকে। বাংলাদেশের ইতিহাস এরপর এক গভীর নাটকীয়তার দিকে ধাবিত হয়। জুনিয়র অফিসারদের হাতে সংঘটিত এই রক্তাক্ত অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে খালেদ মোশাররফ ২ নভেম্বর মাঝরাতে আরেকটি পাল্টা অভ্যুত্থান করেন এবং জিয়াকে গৃহবন্দী করেন। এই সময় আওয়ামী লীগের ব্যানার নিয়ে খালেদ মোশারফের ভাই ও মায়ের মিছিল, ভারতীয় রেডিও-টিভিতে খালেদের ক্ষমতা দখল নিয়ে উচ্ছ্বসিত সংবাদ ভুলভাবে এই অভ্যুত্থানের পেছনে ভারতীয় মদদ এবং আওয়ামী লীগের ভূমিকা রয়েছে বলে ধারণা তৈরি করে। আওয়ামী সরকারের পুনরুত্থানের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে মোশতাক চক্র গোপনে এ সময় জেলে আওয়ামী লীগের প্রধান চারজন নেতাকে হত্যা করে।   

পরিস্থিতির জটিলতায় বন্দী জিয়া এ সময় নিজেকে পুরো দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে নিজের বেতন-ভাতা ইত্যাদির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু জিয়া এও টের পান যে সেই রক্তাক্ত কাল পর্বে বন্দী অবস্থায় তাঁর জীবনও মোটেই নিরাপদ নয়। তাই শেষরক্ষা হিসেবে তিনি এ সময় তাঁর তুরুপের দ্বিতীয় তাসটি ব্যবহার করেন। তিনি টেলিফোনের মাধ্যমে গোপনে তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করেন তাহেরকে।

আগেই উল্লেখ করেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় সেক্টর কমান্ডারদের দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে তাহেরের সঙ্গে জিয়ার যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ঘটে, তা অব্যাহত ছিল স্বাধীনতার পরও। জিয়াকে যারা সেনাপ্রধান করেছে সেই মোশতাক চক্র সেই মুহূর্তে খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় নিজেদের জীবন রক্ষায় ব্যস্ত। ফলে তাদের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, জিয়া তা জানতেন। জিয়া এও জানতেন যে সে সময়ের বিরোধী রাজনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী ধারা জাসদ এবং ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের গোপন শক্তি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে আছেন তাহের। নিরবলম্ব জিয়া তাই টের পেয়েছিলেন, সেই মৃত্যুকূপ থেকে তাঁকে রক্ষা করার একমাত্র চাবিটি তখন রয়েছে তাহেরের হাতে। সেই ভরসাতেই তাহেরের কাছে জীবন বাঁচানোর আকুতি করেছিলেন তিনি। এবং বাস্তবিক বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমেই ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাহের জিয়াকে মুক্ত করেছিলেন। কেন তাহের তা করলেন, সংক্ষেপে ইতিহাসের সেই মুহূর্তটিকে বুঝে নেওয়া যেতে পারে।  

সে মুহূর্তে ক্যান্টনমেন্টে বিরাজ করছিল চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। কারণ, খালেদের অনুগত, ফারুক, রশীদের অনুগত এবং জিয়ার অনুগত সেনারা তখন পরস্পরের মুখোমুখি। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সিপাহিরা জেনারেলদের ক্ষমতায় লড়াইয়ের গুটি হিসেবে আর ব্যবহূত হতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা তাদের নেতা তাহেরকে অবিলম্বে একটি পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেয়, নইলে তারা নিজেরাই রুখে দাঁড়াবে বলে ঘোষণা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৫ নভেম্বর রাতে জাসদের নেতারা জরুরি বৈঠকে বসেন। জাসদের প্রধান নেতারাসহ হাজার হাজার কর্মী তখন জেলে। ফলে একটা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে দ্বিধান্বিত ছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেই আগ্নেয় পরিস্থিতি থেকে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। একটা ঐতিহাসিক চাপের মুখে তাঁরা তাঁদের বিপ্লব পরিকল্পনা ত্বরান্বিত করেন এবং জাসদের গণবাহিনীসহ বেসামরিক শক্তি ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সামরিক শক্তির সমন্বয়ে ৭ নভেম্বর একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় বাংলাদেশের রাজনীতি চালিত হচ্ছিল ক্যান্টনমেন্ট থেকে। অভ্যুত্থানের অংশ হিসেবে বন্দী জিয়াকে মুক্ত করে আপাতত ক্যান্টনমেন্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের সাংগঠনিকভাবে সংহত করার একটা অন্তর্বর্তীকালীন পরিকল্পনা করেন তাহের।

আগেই উল্লেখ করেছি, তাহের খুব ভালোভাবেই জানতেন যে জিয়া মোটেও তাঁদের আদর্শিক সঙ্গী নন। কিন্তু যে মানুষ বন্দী অবস্থায় আছেন, যিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেছেন, যিনি নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য আবেদন জানিয়েছেন, তেমন একজন নাজুক ব্যক্তিকে মুক্ত করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবেন বলেই ভেবেছিলেন তাহের। বিপ্লবী পরিস্থিতিতে বিপরীত মেরুর মানুষের সঙ্গে কৌশলগত আঁতাত তৈরির বহু নজির পৃথিবীতে আছে। একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ কিউবার বিপ্লব। কিউবার বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটানোর পরও সেই বিপ্লবের কিংবদন্তি নেতা কাস্ত্রো বা চে গুয়েভারা কেউই সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা নেননি। গেরিলা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সদ্য আসা কাস্ত্রো এবং চে নিজেদের গুছিয়ে নিতে অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপ্রধান করেছিলেন মধ্যপন্থী আইনজীবী মানুয়েল আরুটিয়াকে। সেই আরুটিয়া ক্ষমতা পেয়ে প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কাস্ত্রো তাঁকে উৎখাত করতে সক্ষম হন।

কাস্ত্রো পারলেও তাহের তাঁর আপাতমিত্রের প্রতিবিপ্লবী তৎপরতাকে উৎখাত করতে পারেননি। লক্ষণীয়, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের দুটি মাত্রা ছিল। একটি সামরিক, অন্যটি বেসামরিক। তাহেরের নেতৃত্বে সামরিক মাত্রাটি সফল হলেও, জনতাকে সংগঠিত করার বেসামরিক মাত্রাটি ব্যর্থ হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান প্রমুখ। ফলে অভ্যুত্থানের ভরকেন্দ্রটি জনতার ভেতর না এসে রয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টে। কথা ছিল বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে জিয়া ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এসে তাহেরের সঙ্গে যৌথভাবে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় বসবেন। কিন্তু জিয়া তাঁর জীবন রক্ষার জন্য তাহেরকে ধন্যবাদ জানালেও প্রতিশ্রুত সাক্ষাতের জন্য ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আসেননি বরং অন্যান্য সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে অতিদ্রুত পুরো পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে খালেদ মোশাররফসহ আরও কয়েকজন সেনাকর্তা সৈনিকদের হাতে নিহত হন। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে দ্বিতীয় জীবন পেয়ে জিয়া দ্রুত সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং ক্যান্টনমেন্টে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ক্ষমতা নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে তিনি একে একে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তার হন তাহেরও এবং একপর্যায়ে গোপন সেই অবৈধ বিচারের মাধ্যমে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করেন। তাহের বিচারের সময় তাঁর জবানবন্দিতে জিয়াকে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

তাহের ও জিয়ার সম্পর্কের এই পরিণতিকে আমাদের বুঝতে হবে সে সময়ের বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে। তখন  পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের জোর ঠান্ডা লড়াইয়ের কাল। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ দেশে প্রথমবারের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক ধারার শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতার অত্যন্ত নিকটবর্তী হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন তাহের। দেশের ভেতর ক্রিয়াশীল মার্কিনপন্থী, পাকিস্তানপন্থী, ধর্মীয় মৌলবাদী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যাবতীয় সামরিক, বেসামরিক শক্তির প্রয়োজন ছিল যেকোনো মূল্যে এই সমাজতান্ত্রিক স্রোতটিকে ঠেকানো। তারা সামনে পেয়েছিল অনিশ্চিত সাঁতারু কিন্তু ক্ষমতায় আগ্রহী জিয়াকে। এই পুরো শক্তিটি তাই জিয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিবিপ্লবী এই শক্তি বিপ্লবী শক্তির মূলকেন্দ্র তাহেরকে হত্যা করে তাই সমাজতন্ত্রের ধারাটিকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। জিয়া কর্তৃক তাহেরের ফাঁসির এই আয়োজনকে তাই নেহাত ব্যক্তিগত আক্রোশের বিষয় ভাবার কারণ নেই। এটি দুটি বিপরীতমুখী আদর্শ ও শক্তির সংঘাতের অনিবার্য পরিণতি। জিয়া ও তাহের ছিলেন দুটি ভিন্ন শক্তির প্রতিভূ, যাঁরা পরস্পরকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন। ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তের ভুলভ্রান্তির মিথস্ক্রিয়ায় পরাজয় ঘটেছিল তাহেরের, জয়ী হয়েছিলেন জিয়া। ফলে স্বভাবতই আমরা তাহেরের প্রত্যাশিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সমাজতান্ত্রিক ধারার কোনো বাংলাদেশকে পাইনি বরং জিয়ার হাত ধরে পরবর্তীকালে এখানে বিকশিত হতে দেখেছি মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের, ধর্মীয় মৌলবাদীদের এবং মুক্তবাজারের লুটেরা পুঁজির ধারকদের। কিন্তু ইতিহাসের গতি পাল্টায়, তাহের নিশ্চিহ্ন হননি, ফিরে এসেছেন। এখন দেখার বিষয় তাহেরের আদর্শটি ফিরে আসে কি না। (শেষ)

শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।