সভা-সমাবেশ বন্ধ করা যায়, কিন্তু হরতাল?

উল্লেখ্য, সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হয়ে জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদানের অধিকার নাগরিকদের রয়েছে। জনশৃঙ্খলার স্বার্থে সে বাধানিষেধ আরোপের ক্ষমতা ফৌজদারি কার্যবিধি ও মহানগর পুলিশ আইনসমূহে রয়েছে। সময়ে সময়ে তার প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগও হয়। বাধানিষেধের অপপ্রয়োগ যদি জনজীবনে অধিক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, তার দায়িত্ব আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় কেউ নেয় না। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষ দিতে থাকে। আর বারবার এ ধরনের পরিস্থিতি ঘটে চলেছে। এর মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।

এটা দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করা যায় যে হরতাল দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের কাছে একটি অগ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও যখন যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন, তাঁরা সময়ে সময়ে হরতাল ডাকেন; কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে। এতে ক্ষয়ক্ষতি ও ভোগান্তির শিকার হয় সাধারণ মানুষ। তবে বরাবর সব সরকারই নির্বিকার থাকে। আর বিরোধী দলও তাদের সিদ্ধান্তে রয়ে যায় অবিচল। এখন উভয় পক্ষের মধ্যে আগামী নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে একটি সংলাপের প্রচেষ্টা চলছে। এ অবস্থায় হরতালটি সে উদ্যোগে প্রতিকূলতা সৃষ্টিতেই ভূমিকা রাখার কথা। আর হরতাল ডাকার যত যুক্তিই থাক; বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেগুলো অগ্রহণযোগ্য। তবে বিস্ময়করভাবে এখানে প্ররোচনা দিয়ে চলেছে সরকারের এ-জাতীয় সিদ্ধান্ত। ক্রিয়ার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া হবে—এটাই বিজ্ঞানের সূত্র। সমাজবিজ্ঞানও প্রায় ক্ষেত্রেই সে সূত্র অনুসরণ করছে। এমনটাই আমরা দেখছি।

এসব সমাবেশ ক্ষেত্রবিশেষে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় গড়ায়। অবনতি ঘটায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। তবে বিষয়টি কিন্তু অভিনব নয়। এখন যাঁরা সরকারি দলে আছেন, তাঁরাও বিরোধী দলে ছিলেন। তখনো কি সভা-সমাবেশে একই উপসর্গ দেখা দিত না? অবশ্য তখনো এগুলোতে বাধাদানের ঘটনা ঘটেছে হরহামেশাই। এসবই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। বেদনাদায়ক হলেও বিষয়টি সত্য।

তবে এবার একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। সরকার ঢাকায় সভা-সমাবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকের ২০ মে ২০১৩-এর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘ব্যান অর নো ব্যান?’ এতে চারজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, নৈরাজ্য ঠেকাতে ঢাকায় সভা-সমাবেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী যিনি ক্ষমতাসীন দলটির মহাসচিবও বটে, তিনি বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় মহাসেন-পরবর্তী ত্রাণতৎপরতা সুচারুভাবে পরিচালনা করতে সারা দেশে এক মাসের জন্য রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বন্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রসচিব বললেন, এ বিষয়ে কোনো সরকারি পরিপত্র জারি হয়নি। আবার পুলিশের মহাপরিদর্শক জানালেন, তিনি এসবের কিছুই জানেন না। বিষয়টি নিয়ে একটি গোলকধাঁধার সৃষ্টি হয়েছে। এটা কোন আইনের ভিত্তিতে কীভাবে করা হলো, তা দেশবাসীর কাছে অস্পষ্ট। তা স্পষ্ট করার উদ্যোগও কেউ নেয়নি। তবে কার্যত দেখা গেল, রাজধানী ঢাকায় কোনো সভা-সমাবেশ হতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি রাজনৈতিক দলের মিলাদ মাহফিলেও পুলিশ বাধা দিচ্ছে।

কোনো বৈধ রাজনৈতিক দলের সমাবেশ করার অধিকার বন্ধ করতে যুক্তিসংগত কারণ থাকতে হবে। এমনিতেই যখন যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন, তাঁরা সুযোগ পেলেই হরতাল-অবরোধ ডেকে বসেন। আর সভা-সমাবেশ বন্ধ করার সিদ্ধান্তটি নিয়ে তাঁদের হরতাল ডাকার অজুহাত সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে। হরতালেও সহিংসতা ও নৈরাজ্যের আশঙ্কা সমাবেশ-শোভাযাত্রার চেয়ে কিছু অংশে কম নয়; বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেশি। আর হরতালটি ডাকা হয়েছে দেশজুড়ে। এমনিতেই গত নভেম্বর থেকে হরতাল অনেকটা প্রাত্যহিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অন্য সব কাজ উপেক্ষা করে হরতালের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দায় পড়ে স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর। আর সেটা শুধু হরতালের দিনই নয়। এর আগের দিন থেকে হরতাল শেষ হওয়ার পরও কয়েক ঘণ্টা। এভাবে দিনের পর দিন চাপের মুখে থাকলে তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

যাঁরা সরকারে থাকেন তাঁরা প্রায়ই বলতে চান, হরতাল চলাকালে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক আছে আর অর্থনীতির চাকাও সঠিকভাবে ঘুরছে। সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগে পিকেটিং সমাবেশ হয়তো বন্ধ করা যায়। কিন্তু অন্য সব উপসর্গ? এটি সত্যি কথা, ঘন ঘন হরতালে অতিষ্ঠ জনগণ এখন সুযোগ পেলেই হরতালকে উপেক্ষা করে। কিন্তু কতটুকু করা যায়? ঢাকা শহরে সরকারি-বেসরকারি কিছু বাস ছাড়াও জীবিকার তাগিদে ট্যাক্সি ক্যাব, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ইত্যাদি চলে। তবে বড় বিপণিবিতানগুলো খোলে বেলা দুইটার পর। কেননা, খুলে বসে থাকলেই তো হবে না; ক্রেতাও তো আসতে হবে। ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগের ভয়ে প্রাইভেট কার বের করার ঝুঁকি নেন খুব কম লোক। আর মহাসড়কগুলো কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায়। ফলে পণ্য পরিবহনব্যবস্থা অচল হয়ে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এমনটাই দাবি করছেন দেশের সব দলমতের শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীরা। তাঁরা এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে নেতাদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু বিষয়টি সুরাহা না হয়ে বরং আবার উল্টো পথেই যাত্রা করল।

সভা-শোভাযাত্রার নামে যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাবি করে, তাদের বিরুদ্ধে তো হামেশাই মামলা ঠুকে দেওয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তার হয়ে কারাবাস করতে হচ্ছে অনেককেই। রিমান্ডের প্রয়োগ আর ডান্ডাবেড়ির ব্যবহারও তো আমরা দেখলাম। অবশ্য এখানে উল্লেখ করা যথার্থ হবে যে, রাজনৈতিক নেতাদের রিমান্ডে নেওয়া ও নির্যাতনের সংস্কৃতি চালু হয় গত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে। এগুলো আদৌ ঠিক হয়নি, এমনটা কি এখন তাঁরা ভাবেন? ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে এসব কোনো অবস্থাতেই করা হবে না—এমন আলাপ-আলোচনাও কি তাঁদের মাঝে হয়? এ ধরনের শুভবুদ্ধির উদয় সহজে ঘটবে—এমনটা ভাবতে ইচ্ছা করে কিন্তু ভরসা হয় না। মনে হয়, প্রত্যেকেই মারমুখী হয়ে আছেন। আর যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরাও তো চিরদিন সেখানে থাকবেন না। কেউ থাকেননি। তখন একই সংস্কৃতি চালু থাকলে তাঁদেরও এরূপ হেনস্তা হতে হবে, এটা ভেবেও তো প্রতিপক্ষের প্রতি কিছুটা সহনশীল হতে পারেন। জরাজীর্ণ অতীতকে ভুলে তাঁরাও তো নতুনভাবে পথ চলতে শুরু করতে পারেন। সৃষ্টি করতে পারেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য সত্ত্বেও পারস্পরিক সম্মানবোধ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বীকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। মূল সমস্যাটা এখানেই। অথচ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কথা বলেন তাঁরাই। আর সেটা চাইলে যা করার দরকার, করছেন তার উল্টোটা। বারবার আমাদের বিশ্বাসের ভিতে তাঁরা ফাটল সৃষ্টি করে চলেছেন।

এক-দুটি সভা-সমাবেশে কিছু নৈরাজ্য হলে ক্ষতি হয় বটে। তবে সে ক্ষতি যাতে যথেষ্ট কম হয়, তার সক্ষমতা তো আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর রয়েছে। অন্তত ঢাকা মহানগরে তা আছে পর্যাপ্ত মাত্রায়। কিন্তু দেশব্যাপী একটি হরতালে যে ক্ষতি হয়, জনজীবনে যে দুর্ভোগ নেমে আসে, তা বন্ধ করার সুযোগ কিন্তু তেমন নেই। আদেশ দিয়ে সভা-সমাবেশ ঠিকই বন্ধ করা হয়েছে, কিন্তু হরতাল বন্ধ করা যায়নি। যাবেও না। তাহলে ভুক্তভোগী জনগণ প্রশ্ন রাখতে পারে—ক্ষতি কোনটাতে বেশি হলো? অবশ্য আমাদের দেশটিতে একটি সুবিধা আছে। তা হলো এ ধরনের সিদ্ধান্তের পরিণামের দায়দায়িত্ব কখনো কাউকে নিতে হয়নি।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।