লিমনের অন্তহীন সংগ্রাম

যে পৃথিবীতে পা হারানো মানুষও এভারেস্ট জয় করছে, সেই পৃথিবীর এক দুর্ভাগা তরুণ লিমনকে বাকি এক পায়ে লড়াই করতে হয় প্রতাপশালী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। র‌্যাবের গুলিতে হারানো পা কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না; কিন্তু মানুষের ভালোবাসায় তিনি ফিরে পেতে চেয়েছিলেন ভয়হীন একটা জীবন। দুই বছর পার হলেও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হুমকি এখনো তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়। পা হারানো লিমন আমাদের পঙ্গু মানবাধিকারের এক মর্মান্তিক প্রতীক।

যে কথিত সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দারের লোক বলে র‌্যাব লিমনকে ফাঁসাতে চাইছে, পরিহাস হচ্ছে ঘটনার দুই বছর পরও সেই সন্ত্রাসীকে বা তাদের বাহিনীর কাউকে র‌্যাব গ্রেপ্তার দেখাতে পারেনি। অথচ গুলিতে পা চলে গেল সে সময়ের ১৬ বছর বয়সী কিশোর লিমনের। লিমনের মায়ের করা মামলার অপমৃত্যুর ব্যবস্থা করেছে পুলিশ। ঘটনার পরপরই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপদেষ্টারা লিমনকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে অভিযুক্ত করে বক্তব্য দেন। র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, লিমন ও তাঁর বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই সন্ত্রাসী। লিমনদের মতো দরিদ্র অসহায় নিরীহ পরিবারটি যদি সন্ত্রাসী হয়, তাহলে বাংলাদেশের সব মানুষকেই সন্ত্রাসী বলতে হবে।

একটি অপরাধ ঢাকতে এভাবে সমগ্র রাষ্ট্রশক্তি লিমনের বিরুদ্ধে, ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে, আইন ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে ‘অপরাধ’ করে চলছে। পঙ্গু লিমন ও তাঁর পরিবারকে মামলার পর মামলায় নাজেহাল করা হচ্ছে, আবার সেই পঙ্গু দেহ নিয়েই লিমন চালিয়ে যাচ্ছেন পড়ালেখার সংগ্রাম। প্রতি মাসে ২০ মাইল দূরে ঝালকাঠি আদালতে হাজিরা দিতে যেতে হয় লিমনকে। পাশাপাশি সামলাতে হচ্ছে র‌্যাবের সোর্স ও মাস্তানদের হুমকি। গত ঈদের আগে র‌্যাবের ‘সোর্সদের’ হামলায় তাঁর একটি কানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরীক্ষার আগে আগে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় ২০১১ সালে এইএসএসসি পরীক্ষা আর দিতে পারেননি। এবারে তিনি পরীক্ষা দিয়েও বিপন্ন।

লিমন যেন এক সংশপ্তক, যিনি অঙ্গহারা হয়েও এক পায়েই চালাচ্ছেন জীবন ও অধিকারের সংগ্রাম। লিমনের এই সংগ্রাম এক পায়ে এভারেস্ট জয়ের থেকেও কঠিন। র‌্যাব-পুলিশের মামলা চলছে তাঁর বিরুদ্ধে, তাঁর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে রাষ্ট্র-প্রশাসন। লিমন যেন বিপন্ন বাংলাদেশের মুমূর্ষু মানবতা। লিমন জিতলে মানবতা জিতবে, লিমন হারলে হারবে বাংলাদেশ।