মানুষের অপকর্মে পরিবেশ বিপর্যয়

ধর্ম
ধর্ম

আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সুব্যবস্থা রেখেছেন। আল্লাহর সৃষ্টি পশু-পাখি, গাছপালা, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত, বনজঙ্গল, আগুন, পানি ও বায়ু—এ সবই মানুষের উপকারী ও পরিবেশবান্ধব। এদের মহান সৃষ্টিকর্তা যথাস্থানে স্থাপন করে রেখেছেন। মানুষের চারপাশে পরিবেশের যেসব উপায় উপকরণ রয়েছে যেমন গাছ, মাটি, পানি, বাতাস, নদ-নদী, পথঘাট-মাঠ, আকাশ-মহাকাশ, গ্রহ-নক্ষত্র—সবই মনোরম প্রকৃতির অজস্র নিয়ামতের নিদর্শন। সৃষ্টিকর্তার এসব নিয়ামতরাজির যথাযথ ব্যবহারবিধি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ প্রদত্ত জীবিকা থেকে তোমরা পানাহার করো এবং দুষ্কৃতকারীরূপে পৃথিবীতে অনর্থক বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়াবে না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৬০)
কিন্তু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এসব নিয়ামতের অপব্যবহার ও অবাঞ্ছিত পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ সীমা লঙ্ঘন করে প্রতিনিয়ত পরিবেশকে দূষিত করে চলেছে। মনুষ্য সৃষ্ট পরিবেশদূষণের কারণের মধ্যে পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, বৃক্ষনিধন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস অন্যতম প্রধান। এসব প্রাকৃতিক পরিবেশগত বিষয়ে ইসলামি নীতিমালা জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষেরই অনুসরণ করা দরকার। ইসলামি জীবনব্যবস্থায় মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়নের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে।
যুগ যুগ ধরে মানুষ নিজের ব্যক্তিস্বার্থে মজে ও জীবনের উন্নয়নের জন্য পরিবেশের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে। মানুষের অপতৎপরতা, বিশেষ করে বিজ্ঞানের উন্নতির পর থেকে দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ অজস্র ছোট-বড় প্রাণী, গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশ সাধন করেছে। এসবের অবশ্যম্ভাবী ক্ষতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। কারণ, আল্লাহ তাআলা ভূপৃষ্ঠে পরিমিতরূপে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন আর এতে রেখেছেন প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার মানদণ্ড। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে পরিমিত করেছেন যথাযথ অনুপাতে।’ (সূরা আল-ফুরকান, আয়াত : ০২)
মানুষ যখন সৃষ্টিগুলোকে তাদের কার্যকর স্থান থেকে লোভের বশবর্তী হয়ে অন্যায়ভাবে স্থানচ্যুত করে বা কোনো অপকর্মে ব্যবহার করে, তখনই পৃথিবীতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসে। এর প্রমাণ বর্তমানে পৃথিবীর তাপমাত্রা অধিক পরিমাণে বাড়ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবীর সব অঞ্চলেই খরা, বন্যা ও পশু-পাখির বিলুপ্তি ঘটছে। একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য নির্বিচারে বনজঙ্গলের কাঠ কেটে বিক্রি করছে এবং পাহাড় কেটে ধ্বংস করছে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করছে এবং এতে জনগণ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে; এমনকি পরিবেশ বিপর্যয়ে শত শত লোক মৃত্যুবরণ করছে। মানুষকে যেহেতু পরিবেশে বাস করতেই হবে, সেহেতু তাদের উচিত নিজেদের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবেশের মৌলিক উপাদানগুলো যথাযথ সংরক্ষণ করা।
পরিবেশ বিপর্যয় রোধে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রোগ নিরাময়ে বনায়নের ভূমিকা অনন্য। যদি জানা যায় যে আগামীকাল কিয়ামত, তথাপিও আজ যদি কারও হাতে কোনো বীজ বা চারা গাছ থাকে, তবে তা বপন করে দিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ আমাদের বনখেকো বন কর্মকর্তারা যে কী পরিমাণে বনভূমি উজাড় করেছেন, তার হিসাব করলে উদ্বিগ্ন হতে হয়। এখনো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বনাঞ্চল ধ্বংস করে চলেছেন। অথচ অনর্থক গাছ কাটা ও বন উজাড় করাকে ইসলামে শরিয়ত গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাস্তাঘাটে বা মাঠে-ময়দানে যেসব বৃক্ষমালা ছায়া দেয়, যেখানে মানুষ বা পশু বিশ্রাম নেয়, এমন গাছকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেটে ফেলা অত্যন্ত জঘন্য অপকর্ম। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে তার কোনো ফায়দা ছাড়া গাছ নিধন করেছে, যার নিচে পথিক ও পশু আশ্রয় নেয়, তার শাস্তি সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে অকারণে একটি কুলগাছও কেটেছে, তাকে আল্লাহ মাথা নিচু করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ)
কিন্তু মানবসভ্যতার উন্নয়ন, প্রগতি ও উৎকর্ষের নামে মানুষ নানা কালে নানা কারণে পরিবেশকে বিপর্যস্ত করেছে। মানুষের সঙ্গে পরিবেশের যে আন্তসম্পর্ক ইসলাম স্থাপন করেছিল, তা-ও চরমভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে। সে জন্যই পরিবেশ-সংকটে মানব সৃষ্ট কারণগুলোকে আজ ব্যাপকভাবে দায়ী করা হচ্ছে। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, মানুষের নৈতিক অধঃপতনই পরিবেশ-সংকটের বড় কারণ। পৃথিবীতে যত প্রকারের দুর্যোগ পতিত হচ্ছে, এসবেরই হোতা মানুষ। মানুষই অর্জন করে সব ধরনের বিপর্যয়। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে মানুষের অপকর্মের কারণেই। তাই পবিত্র কোরআনে সতর্ক করা হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন সমুদ্রে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, ফলে তাদেরকে তাদের কোনো কোনো অপকর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সূরা আর-রুম, আয়াত: ৪১)
পরিবেশ নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা জাতির সম্পদ নয়, পরিবেশ সবার সম্পদ এবং এর বিপর্যয় নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং মানবজাতির বিপর্যয় হিসেবে গণ্য হয়। তাই পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। তা না হলে মানুষকে হাশরের ময়দানে আল্লাহর দরবারে আসামির কাঠগড়ায় জবাবদিহির জন্য দাঁড়াতে হবে। আগামী প্রজন্মের জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ গঠনে বিশ্বব্যাপী পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প থেকে বাঁচতে হলে প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বনায়ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ধরিত্রী সম্মেলনে গৃহীত পদক্ষেপের যথাযথ বাস্তবায়ন পৃথিবীকে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই দেশের মানুষের উচিত যে কাজে জাতির ক্ষতি হয়, দেশের সর্বনাশ হয়, তা থেকে অবশ্যই বিরত থাকা। মানুষের অন্যায় অপকর্ম থেকে ফিরে এসে পৃথিবীকে বিপদমুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]