শিশুশ্রম প্রতিরোধে গণজাগরণ

ধর্ম
ধর্ম

প্রতিটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ইসলামে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। অথচ সমাজে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে শিশুদের কাজ করতে দেখা যায় না। শিশুশ্রমের ফলে শিশুদের মননশীলতা ও দৈহিক ক্ষতি হয় এবং মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। অন্যদিকে, শিশুরা আয়ের লক্ষ্যে তাদের বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী বিপদ, ঝুঁকি, শোষণ, বঞ্চনা ও আইনগত জটিলতার সম্মুখীন হয়ে নিজেকে নিয়োজিত করে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়ে। চরম দারিদ্র্য ও দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে নৈতিক আদর্শের বৈশিষ্ট্য এর মুখ্য কারণ। হতদরিদ্র পরিবার সংসারের ব্যয় নির্বাহে অসমর্থ হয়ে বা অভিভাবকদের কর্মহীনতার কারণে মা-বাবার স্থলে শিশুরা অর্থ উপার্জনে অগ্রসর হয়। তাই শিশুশ্রম বন্ধ করতে না পারলে যতটা সম্ভব শিশুর কর্মস্থল ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ করা প্রয়োজন। ইসলামের শ্রমনীতিমালা অনুসারে কাউকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব প্রদান করা সমীচীন নয়। সামর্থ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান কোনো সময় বড় ধরনের জুলুমের পর্যায়ে চলে যায়। তাই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ কারও ওপর এমন কোনো কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না, যা তার সাধ্যাতীত।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৮৬)
অথচ দেশে কঠিন দারিদ্র্যের কারণে অসংখ্য শিশু ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় ও কায়িক শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে। শিশুরা অস্বাস্থ্যকর ও প্রাণসংকটাপন্ন পরিবেশে কাজ করায় তাদের ওপর নির্যাতন বাড়ছে এবং তারা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম, যেমন উটের জকি, অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করা হয়। এ ধরনের প্রতিটি কাজ ইসলামে অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সামগ্রিকভাবে শিশুদের নিপীড়নমূলক এসব কাজ থেকে মুক্তি দিতে ধর্মীয় সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারিভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামে কাউকে সামর্থ্যের বাইরে কোনো দায়িত্বের নির্দেশ প্রদান করা হয়নি। যে শিশুদের প্রতি দয়া-স্নেহ করে না, সে মুসলমানদের মধ্যে গণ্য নয়। তাই নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তাদের সামর্থ্যের অধিক কাজ করাতে চাইলে তাদের সহযোগিতার হাত প্রসারিত করো এবং তাদের ওপর শক্তির অধিক কাজ চাপিয়ে দিয়ো না।’ (বুখারি)
শিশুশ্রম প্রতিরোধ বিষয়ে সর্বমহলে চিন্তাভাবনা চলছে। কারণ, আজ যারা শিশু, আগামী দিনে তারাই যুবক। শিশুরাই সুশোভিত ও গৌরবময় আগামীর পথনির্দেশক। উন্নত ও ধনী দেশে শিশুরা সব ধরনের অধিকার পেলেও দরিদ্র দেশে তারা মানবাধিকারবঞ্চিত থেকে যায়। শহরে বা গ্রামে প্রায়ই শিশুশ্রমিকদের অঙ্গহানি এমনকি মৃত্যুমুখেও পতিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। দেশে বিপুলসংখ্যক শিশু শ্রমে নিযুক্ত থাকায় একদিকে যেমন তারা সুন্দর ও নিরাপদ শৈশব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। শিশুরা যখন তাদের সোনালি জগতের বাইরে অন্য জগতে প্রবেশ করে, বেঁচে থাকার রসদ জোগান দেয়, তখন তাদের শারীরিক, মানসিক, আবেগিক, সামাজিক ও নৈতিকতার অবনতি ঘটতে থাকে। বিভিন্ন দৈহিক সমস্যা তাদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। মানসিক বুদ্ধি লোপ পায়, ইচ্ছার বিপর্যয় ঘটে এবং ইচ্ছাশক্তি অবদমিত হয়ে যায়, উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস পায়। অথচ আজকের শিশুর মাঝেই লুকিয়ে আছে আগামী দিনের সুন্দর পৃথিবী। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা।’ (সূরা আল-কাহ্ফ, আয়াত: ৪৬)
দরিদ্র দেশগুলোতে শিশুশ্রম চালু হওয়ার প্রধান কারণ দুটি। পেটের তাগিদে তাদের কোথাও কাজ করতে হয় অথবা শ্রমের বিনিময়ে তারা অন্নের সংস্থান করে। অন্যদিকে, শিশুশ্রমিকদের তুলনামূলকভাবে অনেক কম মজুরি দিয়ে কাজ করানো যায়। এ জন্য নিয়োগকারীরা শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগায় এবং বেশি করে খাটায়। এসব কাজই কোমলমতি শিশুদের দেহ-মনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। শিশুশ্রমিকেরা অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে, যার নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমাও নেই। তাদের বেশির ভাগই ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা কাজ করে। বিশ্রাম বা বিনোদনেরও কোনো অবকাশ নেই। কাজেই একেবারে বিশ্রামহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে শিশুদের বাধ্য করা যাবে না। একসঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাজ করার পর অনুরূপ নিরবচ্ছিন্নভাবে কিছুক্ষণ তাকে অবসর তথা আরাম-আয়েশ ও বিশ্রামের সুযোগ দিতে হবে। প্রয়োজনীয় অবকাশ দিতে হবে—এটিও শিশুর মৌলিক মানবাধিকারের পর্যায়ে গণ্য। তাই মহানবী (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘লোকদের সহজাত দাও, কঠোরতার মধ্যে নিক্ষেপ করো না।’
ইসলামের নৈতিক শিক্ষা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও ধর্মীয় পরিবেশ না পেলে শিশুর যথার্থ বিকাশ সাধিত হয় না। নবী করিম (সা.) অবহেলিত শিশুদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ও বিনোদনের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ধর্মে-কর্মে যথার্থ মানুষ হিসেবে গঠন করেছিলেন। তিনি শিশুদের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। যেকোনো শিশুকে তিনি নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন। শিশুদের প্রতি কোমল ব্যবহার নিজে করেছেন এবং অন্যদের সদাচরণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। অথচ আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের যুগেও শিশুশ্রমিকেরা কতই-না অবহেলিত! তাই শিশুদের শারীরিক নির্যাতন না করে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে সুশিক্ষা দানের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা শিশুদের স্নেহ করো, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো এবং সদাচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ (তিরমিজি)
সমাজজীবনে বাস্তবতার নিরিখে শিশুশ্রম পুরোপুরি বন্ধ করা না গেলেও কম ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় তাদের নিয়োগ করা যেতে পারে। পাশাপাশি পড়াশোনার সুযোগও রাখতে হবে। দারিদ্র্যের কারণে শ্রম বিক্রি করতে যাওয়া শিশুদের জানাতে ও বোঝাতে হবে যে তাদের দারিদ্র্য দূর করার মোক্ষম হাতিয়ার হলো শিক্ষা। স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করাটাই তাদের জন্য বেশি জরুরি। ভাগ্যবিড়ম্বিত হাজার হাজার শিশুর জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যেই শিশুশ্রম প্রকল্পটির যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। পর্যায়ক্রমে দেশের সব সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে এ কর্মসূচির আওতায় আনা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো শিশুশ্রম প্রতিরোধমূলক কাজে এগিয়ে আসতে পারে। শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য তাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে, এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের উত্তমরূপে জ্ঞান দান করো, কেননা তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট।’ (মুসলিম)
শরিয়ত পরিপন্থী অভিশপ্ত শিশুশ্রম অকালে কত শিশুর সোনালি জীবন বিনাশ করছে। যে হাতে বই-খাতা-কলম থাকার কথা, সে হাতে তারা হাতুড়ি উঠিয়ে নিচ্ছে, ইট ভাঙছে, শ্রমিক হয়ে কাজ করছে। গরিবের ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুর দ্বারে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। কত অসহায় এতিম শিশুর বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠছে। কত শিশু দেশের বাইরে পাচার হয়ে উটের জকি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, নির্যাতিত হয়ে বাঁচার অধিকার হারাচ্ছে। নিষ্পাপ শিশুকে জোর করে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করিয়ে জীবনে এক ভীতিকর পরিবেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এসব মানবেতর জীবনযাপনকারী শিশুর জন্য মুসলিম বিশ্বকে ভালোবাসার হাত বাড়াতে হবে। বেসরকারি সংস্থা, সরকারি পদক্ষেপ, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলাদেশে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে একটি গণজাগরণ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। তা ছাড়া মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। কেননা, মানুষ যদি নৈতিকতাসম্পন্ন ও মানসিকতায় উৎকৃষ্ট না হয়, তাহলে শুধু আইন করে শিশুশ্রম একবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]