প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিন

অঙ্কন: তুলি
অঙ্কন: তুলি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরটি ফলপ্রসূ ও অর্থবহ হয়েছে এমনটা বলা যায়। এই সফরকালে দীর্ঘ ৬৮ বছরের অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় কাজটির আইনি দিক চূড়ান্ত হয়। এতে ছিটমহলগুলোর অধিবাসী প্রায় ৫০ হাজার লোকসহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর একটি যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায়ের অবসান ঘটল। বস্তুত, এটা ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বাস্তবায়ন। এর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে কাটল ৪১ বছর। চুক্তিটি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সে বছরই অনুসমর্থন করে। কিন্তু তা করতে ভারতের দীর্ঘকাল কেটে যায়। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে আটঘাট বেঁধে নামেন। তিনি সক্ষম হন এর পক্ষে ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সর্বসম্মত সমর্থন পেতে। সুতরাং এই কৃতিত্ব অনেকাংশে তাঁর। এর সাফল্য তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে। সদা সচেষ্ট তৎপরতার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহকর্মীরা।
বাংলাদেশ আশা করেছিল, নরেন্দ্র মোদির সফরকালে উভয় দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমঝোতা হবে। একটি হয়েছে, অপরটি হয়নি। তা হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। উভয় দেশ ২০১১ সালে সেই চুক্তির একটি সম্মত খসড়া তৈরি করেছিল। শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় তা হয়নি। এবার তা আনুষ্ঠানিক আলোচনায়ও আসেনি। তবে নেপথ্যে হয়তো কিছু আলোচনা হয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সে রকমই বলেছেন। পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন বিষয়টির ন্যায্য সমাধান হবে।’ সম্ভবত এ জন্য তাঁকে আরও ‘হোমওয়ার্ক’ করতে হবে। তবে এক বছরের শাসনকালে আমরা নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একটি নিষ্ঠার ভাব দেখতে পাই। তিনি যেটা করতে চান সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেন। প্রায় ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছেন তিনি। ভারত–বাংলাদেশের যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টন স্পর্শকাতর ও জটিল প্রক্রিয়া হলেও অসম্ভব নয়। এর ন্যায্য সমাধান সবাই চায়। বিশেষ করে তিস্তা চুক্তিটি তো হতে হতে শেষ মুহূর্তে ঠেকে গেছে ২০১১ সালেই। এবারও হলো না। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান অনুভূতি সম্পর্কে ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস-এর সম্পাদকীয়র শিরোনাম ‘যে নদী বাংলাদেশের মন পোড়ায়’। এতে অনেক কথার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চলতি সফরের নানা সাফল্যের মাঝেও চোরাস্রোত হিসেবে রয়ে যাচ্ছে তিস্তা।’
বলতে হয়, মোদির এই সফর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে আরও গভীরতায় নিয়ে যেতে অবদান রাখবে। সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলোর কোনো কোনোটির যৌক্তিকতা সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে বটে। সেই বিতর্ক দীর্ঘ এবং এই নিবন্ধের বিবেচ্যও নয়। আলোচ্য সফরে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়টি নিষ্পত্তি না হলেও এর ন্যায্য সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এটাকেও আমরা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা অর্জন বলে ধরে নিতে পারি। সেই প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতায় কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকলে একসময় সাফল্যের মুখ দেখতে পারে। তবে সেটা কবে আর কত ক্ষতির পর, এটা এখনই অনুমান করা দুষ্কর।
ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ২২ মার্চ বাংলাদেশ তিস্তার ২৩২ কিউসেক পানি পেয়েছে। এটা ইতিহাসে সর্বনিম্ন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। গত চার বছরে শুষ্ক মৌসুমের চূড়ান্ত পর্যায়ে (মার্চের শেষ ১০ দিন) তিস্তায় বাংলাদেশ অংশে পানি প্রাপ্তি ছিল ২০১৫, ২০১৪, ২০১৩ ও ২০১২ সালে গড়ে যথাক্রমে ৩১৫, ৫৫০, ২৯৫০ ও ৩৫০৬ কিউসেক। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৫ সময়কালে গজলডোবা বাঁধ চালু করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ অংশে এর গড় প্রবাহ ছিল ৬৭১০ কিউসেক। ওই ইংরেজি দৈনিকটির ভাষ্য অনুসারে, ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে ২০১১ সালের তিস্তা চুক্তি খসড়া তৈরি করার পরপরই এর প্রবাহ শোচনীয়ভাবে কমতে থাকে। তিস্তায় পানিপ্রবাহের অস্বাভাবিক হ্রাসে বিশাল অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশ পাল্টে যাচ্ছে। ফসল ফলছে না। ‘নদীতে’ নৌকার পরিবর্তে চলে গরুর গাড়ি। মাছ ও জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন। কৃষক, নৌকার মাঝি আর জেলে সবাই সংকটের মুখে।
ভারত সরকারের সদিচ্ছাও হার মানছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জেদের কাছে। তারা আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই রাজি নয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন সংগ্রামী নেতা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তিনি আজ এই অবস্থানে। লক্ষণীয় যে তিনি পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সম্ভ্রম নিশ্চিত করে তাদের কাছে প্রশংসিত ও আস্থাভাজন হয়েছেন। তিস্তার পানি বণ্টন প্রশ্নে তাঁর রাজ্যবাসীর স্বার্থকে তিনি সামনে রাখতে উদ্যোগী হবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে নদীটি যৌথ এবং পানি যে ভাটির দেশেরও পাওনা আছে, এমনটা কীভাবে তিনি বিস্মৃত হতে পারেন তা বিস্ময়কর। দুই দিন পর বর্ষা নামলে তো সেই নদীর পানি আমাদের দেশের ওপর দিয়েই যাবে। কখনো বা বাড়িঘর, ফসল নষ্ট করে ঘটাবে বিপর্যয়। তিস্তার পানির ন্যায্য বণ্টন হলে তিনি তাঁর রাজ্যের জনগণকে বোঝাতে পারবেন না এমনটা মনে করার কারণ নেই। যার যেটুকু প্রাপ্য, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে সাধারণ মানুষও। বরং তাদের মধ্যে অযৌক্তিক আশাবাদ জাগিয়ে তুললে ক্ষতিই হয়।
আমরা আরও বেদনার সঙ্গে লক্ষ করি আত্রাই নদে আমাদের একটি রাবার ড্যাম নির্মাণকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাম্প্রতিক ভূমিকা। এ রাবার ড্যাম হওয়ায় পশ্চিম দিনাজপুরের মানুষ সেচের পানি পাচ্ছে না—এমন অভিযোগ তারা করছে ভারত সরকারের কাছে। ড্যামটি উচ্চতায় চার মিটার এবং দৈর্ঘ্যে ১৩৫ মিটার। সেচের আওতাধীন জমি পাঁচ হাজার হেক্টর। আর গজলডোবায় পরিকল্পিত সেচের আওতাধীন জমি নয় লাখ হেক্টর। অবকাঠামো নির্মাণ অসম্পূর্ণ থাকলেও এর এক-চতুর্থাংশ ইতিমধ্যে সেচের আওতায় এসেছে। আত্রাই তিস্তার একটি শাখা নদ। এটি ভারত থেকে বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে। একপর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে কিছুটা গিয়ে আবার বাংলাদেশমুখী হয়েছে। উজানের দেশ ভারত গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে আত্রাইয়েও। ভাটির দেশ বাংলাদেশ রাবার ড্যাম দিয়ে আত্রাইয়ে অতি সামান্য পানির ব্যবস্থা করল। এতেই নালিশ, আলাপ-আলোচনা না করে বাঁধ দেওয়ার। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার নিম্নোক্ত চরণ দুটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক—
কহিলাম তবে, ‘আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব—
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।’
অবশ্য নীরবে আমরা এ অধিকার ছাড়িনি। প্রতিবাদ করে যাচ্ছি। আর সেটা চলবেও।
নরেন্দ্র মোদি বাস্তববাদী মানুষ। তিনি বিশাল দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী। দেশটি আঞ্চলিক পরাশক্তির বটে। পরাশক্তির বিকাশে নিকট প্রতিবেশীদের সঙ্গে সহযোগিতা ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্ববহ একটি উপাদান। সম্ভবত তাই সূচনাতেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন মোদি। দক্ষিণ এশিয়ার বাইরেও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য যেখানেই গেছেন, সেখানেই তিনি রাখতে সক্ষম হয়েছেন সাফল্যের ছাপ। সবাই তাঁকে আজ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিচ্ছে। আমাদের দুটি দেশের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন প্রশ্নেও তিনি একটি মূল্যবান কথা বলেছেন। তা হচ্ছে, ‘আমাদের নদীগুলো দুই দেশের বিরোধের কারণ নয়, বরং সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণ হওয়া উচিত।’ আমরা ভারতকে সড়ক, রেল ও নৌপথে চলাচলে সুযোগ করে দিচ্ছি। পানি না থাকলে সেই নৌপথও থাকবে না। তাই আমাদের নদীর পানিও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ইতিবাচক অবদানই রাখতে পারে। মোদির ক্যারিশমা আজ সর্বোচ্চ আলোচিত। দীর্ঘ সংগ্রাম করে তিনি এই অবস্থানে পৌঁছেছেন। তাই আমরা আস্থা রাখতে চাই তিনি দ্রুততার সঙ্গে পানি বণ্টনসংক্রান্ত তাঁর আশ্বাস বাস্তবায়ন করবেন।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]