সার্বভৌম ঋণের ক্ষেত্রে আইনের শাসন

সরকারকে মাঝেমধ্যে ঋণ পুনর্গঠন করতে হয়। তা না হলে একটি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। কিন্তু সার্বভৌম ঋণের সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন না থাকায় তা পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বিশ্বকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়। আর ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, সার্বভৌম ঋণের বাজারের কার্যক্রম ভালোভাবে চলছে না। সেই বাজারে আবার নানা বিবাদ দেখা যায়, সেখানে সমস্যা সৃষ্টি হলে তা আমলে নিতে এত দেরি হয় যে এই বিলম্বের মাশুলও দিতে হয় অনেক।
বারবার এ ব্যাপার আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়। আর্জেন্টিনায় আমরা দেখলাম, ‘স্বল্পসংখ্যক’ বিনিয়োগকারীর সঙ্গে সরকারের লড়ালড়ির কারণে ঋণ পুনর্গঠনের পুরো কার্যক্রমই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে ব্যাপারে দেশটির বেশির ভাগ ঋণদাতাই বিনা শর্তে রাজি হয়েছিলেন। গ্রিসের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, সাময়িক ‘সহায়তা’ কর্মসূচির ‘পুনরুদ্ধার তহবিলের’ সিংহভাগই ঋণ পরিশোধে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এরপর দেশটি কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করলে তার মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ২৫ শতাংশ কমে যায়। এ কারণে দেশটির জনগণ চরম দুর্দশায় পড়ে। আবার ইউক্রেনে সার্বভৌম ঋণজনিত দুর্দশার ভার জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেটা হলে তার পরিণতি হবে মারাত্মক।
ফলে সার্বভৌম ঋণ পুনর্গঠন কীভাবে করা হবে, তার একটি পদ্ধতি বের করার জরুরত আগের চেয়ে বেশি করেই অনুভূত হচ্ছে। অর্থাৎ, ঋণকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা। বর্তমান ব্যবস্থা বাজারের ‘গুণাগুণের’ ওপর অতিরিক্ত আস্থা স্থাপন করেছে। বিধিবিধানের ভিত্তিতে বিরোধ মেটানো হচ্ছে না, যার মাধ্যমে ন্যায্য সমাধান করা যেতে পারে। এর সমাধান হচ্ছে অসমদের মধ্যকার দর-কষাকষির মাধ্যমে, যেখানে ধনী ও শক্তিশালীরা অন্যদের ওপর নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিচ্ছে। এতে যে ফলাফল আসছে, তা তো ন্যায়সংগত নয়ই, বরং সেটা অকার্যকর।
অনেকেই আবার দাবি করে, এই ব্যবস্থা ভালোভাবেই চলছে। তারা মনে করে, দুর্বল দেশ তো সাধারণত নতি স্বীকার করেই থাকে। কিন্তু সেটার জন্য তাদের জনগণকে কী মূল্য দিতে হয়? তাদের এই পুনর্গঠনের কাজ কীভাবে চলছে? দেশটি কি ঋণের ক্ষেত্রে টেকসই পথে আছে? বিরাজমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতীরা এসব প্রশ্ন করে না বিধায় প্রায়ই একটির পর আরেকটি ঋণ-সংকট সৃষ্টি হয়।
২০১২ সালে গ্রিসের ঋণ পুনর্গঠন ঋণ-সংকটের ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত। দেশটি অর্থবাজারের ‘নিয়ম’ অনুসারে কাজ করেছে, ফলে তারা বেশ তাড়াতাড়িই এই পুনর্গঠন সম্পন্ন করতে পেরেছিল। কিন্তু এই চুক্তি তেমন ভালো ছিল না, এতে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি। ফলে তিন বছর পর দেখা যাচ্ছে, দেশটিতে আবারও ঋণ পুনর্গঠনের একরকম মরিয়া প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
বিপর্যস্ত ঋণগ্রহীতাদের নতুন করে শুরু করতে হবে। অতিরিক্ত দণ্ডের কারণে দেখা যায় যোগফল ঋণাত্মক, যেখান থেকে ঋণগ্রহীতারা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারে না। আর তার জন্য যে বড় অঙ্কের টাকা পরিশোধের সক্ষমতার প্রয়োজন হয়, সেখান থেকেও ঋণদাতারা লাভবান হয় না।

>সার্বভৌম ঋণ-সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক আইনের শাসন না থাকলে যে চরম মূল্য দিতে হয়, ইউরোপের সংকট তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। এই মূল্য ঋণদাতা ও গ্রহীতা সবাইকেই দিতে হয়। এমন সংকট সৃষ্টি হতেই থাকবে

ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আইন না থাকায় নতুন করে শুরু করতেও দেরি হয়, আবার সে কারণে বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হতে পারে। সে কারণে কোনো সরকারই দেশীয় ঋণ পুনর্গঠনের ব্যাপারটা বাজারের হাতে ছেড়ে দেয় না। সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ‘চুক্তিভিত্তিক সমাধান’ যথেষ্ট নয়। এর বদলে তারা দেউলিয়াত্ব আইন করে ঋণদাতা ও গ্রহীতার মধ্যকার দর-কষাকষির মৌলনীতি প্রণয়ন করে। এর মাধ্যমে তারা দর-কষাকষির বাজারে দক্ষতা ও ন্যায্যতার ব্যাপারটি প্রবর্তন করে।
দেশের ভেতরের দেউলিয়াত্ব থেকে সার্বভৌম ঋণের পুনর্গঠন আরও বেশি জটিল। এতে নানা রকম আইনি জটিলতা আছে, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দাবিদার আছে। অস্বচ্ছভাবে নির্ধারিত সম্পদের ব্যাপার আছে, দাবিদারেরা যার মালিকানা দাবি করতে পারে। সে কারণেই দেখা যায়, মার্কিন রাজস্ব বিভাগসহ অনেকেই দাবি করে, ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের শাসনের প্রয়োজন নেই, এটা অসম্ভব ব্যাপার।
এটা ঠিক, পূর্ণাঙ্গভাবে আন্তর্জাতিক দেউলিয়াত্ব আইন করা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়। যেমন ঋণ পুনর্গঠনের সময় মামলা হলে তাতে স্থগিতাদেশ দেওয়ার শর্তযুক্ত একটি কাঠামো প্রণয়ন করা যেতে পারে। এতে ভালচার ফান্ডের ব্যাহতকারী ভূমিকা হ্রাস করা সম্ভব।
এই কাঠামোর মধ্যে লেন্ডিং ইনটু এরিয়ারের শর্ত রাখতে হবে: যেসব দেশে ঋণ পুনর্গঠন চলছে, ঋণদাতারা সেসব দেশকে ঋণ দিতে আগ্রহী হলে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে। যেসব দেশের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেসব দেশকে নতুন করে ঋণ দিলে ঋণদাতাদের প্রণোদনা দেওয়া হবে।
কোনো দেশ অন্য দেশের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারবে না—এই মর্মে ঐকমত্য থাকতে হবে। সার্বভৌম ঋণের যে দায়মুক্তি আছে, সেটা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ত্যাগ করা যাবে না। ঠিক যেমন কোনো ব্যক্তি নিজেকে দাস হিসেবে বিক্রি করতে পারে না। আর একটি গণতান্ত্রিক সরকার তার পরবর্তী সরকারের কাঁধে কী পরিমাণ ঋণ চাপিয়ে দেবে, তারও একটা সীমা থাকা উচিত।
এটা বিশেষ করে এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে অর্থবাজারের একটা প্রবণতা আছে, তারা অদূরদর্শী রাজনীতিকদের বাজেট-সংক্রান্ত চাপ কমাতে রাজি করিয়ে ফেলে। আবার ইউক্রেনের ইয়ানুকোভিচের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারকে ঋণ দেওয়ার মতো কাজও তারা করে, যার ভার বহন করতে হয় পরবর্তী প্রজন্মকে। এসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে সার্বভৌম ঋণের বাজারের কার্যক্রম উন্নত হবে, ঋণের ক্ষেত্রে আরও যেসব প্রয়োজনীয় নিয়মকানুনের দরকার আছে, সেগুলো প্রতিপালন করা সম্ভব হবে।
এসব বৈশিষ্ট্যযুক্ত এমন একটি ‘নরম আইনের’ কাঠামো পর্যবেক্ষক কমিশনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হলে তারা ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে বর্তমানে যেসব অদক্ষতা ও অন্যায্যতা আছে, সেগুলোর কিছু কিছু দূর করা যাবে। কিন্তু এই কাঠামো ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রণয়ন করতে হলে বাজারের কোনো অংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত আছে এমন সংস্থার মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা যাবে না।
অর্থাৎ সার্বভৌম ঋণ পুনর্গঠনের নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এরা ঋণদাতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত (আবার তারা নিজেরাও ঋণদাতা)। বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে স্বার্থের সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে হলে এই কাঠামো জাতিসংঘের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। জাতিসংঘ অধিক প্রতিনিধিত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠান, তারা ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অথবা নতুন কোনো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও সেটা করা যেতে পারে, ২০০৯ সালে স্টিগলিৎজ আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কারবিষয়ক প্রতিবেদনে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
সার্বভৌম ঋণ-সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক আইনের শাসন না থাকলে যে চরম মূল্য দিতে হয়, ইউরোপের সংকট তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। এই মূল্য ঋণদাতা ও গ্রহীতা সবাইকেই দিতে হয়। এমন সংকট সৃষ্টি হতেই থাকবে। বিশ্বায়ন যদি সব দেশের জন্য কার্যকর করতে হয়, তাহলে সার্বভৌম ঋণের নিয়ম অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। আমরা যে সীমিত সংস্কারের কথা বললাম, শুরু করার জন্য এটাই সঠিক ক্ষেত্র।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ: নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ।
মার্টিন গুজম্যান: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো।