আহ্লান সাহ্লান মাহে রমজান

ধর্ম
ধর্ম

খোশ আমদেদ মাহে রমজান। হিজরি সালের নবম মাস পবিত্র মাহে রমজান উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য আল্লাহর অপার সন্তুষ্টি ও তাঁর প্রতিশ্রুত বেহেশত লাভের সওগাত। ‘রামাদান’ শব্দটি আরবি ‘রাম্দ’ ধাতু থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দহন, প্রজ্বলন, জ্বালানো বা পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলা। রমজান মাসে সিয়াম সাধনা তথা রোজা পালনের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মানুষ নিজের সমুদয় জাগতিক কামনা-বাসনা পরিহার করে আত্মসংযম ও কৃচ্ছ্রপূর্ণ শান্তিময় জীবনযাপন করে এবং ষড়্রিপুকে দমন করে আল্লাহর একনিষ্ঠ অনুগত বান্দা হওয়ার সামর্থ্য অর্জন করে। মাহে রমজান মানুষের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় অহংকার, কুপ্রবৃত্তি, নফসের দাসত্ব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বলে এ মহিমান্বিত মাসের আরবি নাম ‘রামাদান’। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা সাবধান হয়ে চলতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হচ্ছে রোজা। নামাজের পরেই মুসলমানদের প্রতি আল্লাহ তাআলা যে ইবাদত ফরজ করেছেন তা হচ্ছে মাহে রমজানের রোজা। দ্বিতীয় হিজরি সালে উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়। তবে এই রোজা অন্যান্য জাতির ওপরও ফরজ ছিল। অসাধারণ ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণ মাহে রমজানে সমগ্র বিশ্বে মুসলমানদের ইমানি চেতনা সুদৃঢ় হয়, তাকওয়া বা আল্লাহভীতির নিদর্শন প্রকাশ পায় এবং অত্যন্ত গভীরভাবে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি সঞ্চারিত হয়।
ইসলামের অন্যান্য বহু আদেশ-নির্দেশের মতো রোজাও ক্রমিক নিয়মে ফরজ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কেবল মাহে রমজানে রোজা নির্দিষ্ট ও এতেই সীমাবদ্ধ করে দেননি, বরং শরিয়তসম্মত কোনো অনিবার্য কারণবশত কেউ রমজান মাসে রোজা পালন করতে না পারলে এরপর অন্য যেকোনো সময় রোজার কাজা আদায় করার পথও উন্মুক্ত রেখেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে সিয়াম পালন করে। এবং কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করতে হবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর তা চান না, এ জন্য যে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের সৎ পথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা কীর্তন করবে, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
মুমিনের জীবনে বছরের মধ্যে রমজান মাসটিই এক দুর্লভ সুযোগ এনে দেয়, তাই এ পুণ্যময় মাসের গুরুত্ব এত বেশি। একদা নবী করিম (সা.) মাহে রমজানের প্রাক্কালে খোশ আমদেদ জানিয়ে বলেন, ‘রমজান মাস আগত প্রায়, এ মাস বড়ই বরকতের মাস, আল্লাহ তাআলা বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেন এবং খাস রহমত বর্ষণ করেন, গুনাহ মাফ করেন এবং দোয়া কবুল করেন।’ এ মাসে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে, তাই মাহে রমজানের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত অপরিসীম। রমজান মাসের সম্মানজনক মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যখন রমজান মাস আগত হয় তখন আকাশ বা বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, সারা রমজান মাসে তা বন্ধ করা হয় না, আর দোজখের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, সারা রমজান মাসে তা খোলা হয় না, আর শয়তানকে জিঞ্জিরে বন্দী করা হয়।’ (তিরমিজি, নাসাঈ, ইবনে মাজা)
আত্মিক উৎকর্ষ ও পরকালীন কল্যাণ লাভের এক বেহেশতি সওগাত এই রমজান মাস। আল্লাহ তাআলা তাঁর রহমত ও নিয়ামতের অফুরন্ত ভান্ডারের দরজা রমজান মাসে রোজা পালনকারীর জন্য উন্মুক্ত করে দেন। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে যে তাৎপর্যপূর্ণ ও ফজিলতময় পবিত্র মাহে রমজানে রোজা পালনকারী ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তাআলা পুরস্কারের ভান্ডার নির্ধারণ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন: আদম সন্তানের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, তবে রোজা ব্যতীত, কেননা রোজা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব।’ (বুখারি ও মুসলিম) রমজান এমনই এক বরকতময় মাস, যার আগমনে পুলকিত হয়ে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কিরামদের মোবারকবাদ পেশ করতেন। নবী করিম (সা.) সাহাবিদের এই মর্মে সুসংবাদ প্রদান করেছেন, ‘তোমাদের সামনে রমজানের পবিত্র মাস এসেছে, যে মাসে আল্লাহ তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করেছেন।’ (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আগে থেকেই রমজান মাসের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতেন এবং রজব মাসের চাঁদ দেখে মাহে রমজান প্রাপ্তির আশায় বিভোর থাকতেন। মহানবী (সা.) আবেগভরে পরম করুণাময়ের দরবারে প্রার্থনা করতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি রজব ও শাবানের মধ্যে আমাদের জন্য বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’ (মুসনাদে আহমাদ) রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘যখন রমজান মাসের প্রথম রাত আসে তখন একজন আহ্বানকারী আহ্বান করেন, ‘হে কল্যাণকামী এগিয়ে যাও! হে মন্দান্বেষী স্তব্ধ হও!।’ (তিরমিজি) এ জন্য মাহে রমজানের অসীম কল্যাণ ও বরকত লাভের প্রত্যাশার জন্য আগে থেকে সবার দৈহিক ও মানসিকভাবে ইবাদতের প্রস্তুতি গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রমজান মাস মুসলমানদের নিয়মতান্ত্রিক পানাহার, চলাফেরা, ঘুমসহ নানা ইবাদত-বন্দেগিতে আধ্যাত্মিক জীবনে নবজাগরণ সৃষ্টি করে। মুমিন বান্দাগণ এ মাসে আল্লাহর রহমত লাভের জন্য সদা তৎপর থাকেন। প্রকৃতপক্ষে মাহে রমজান মুসলমানদের জন্য একটি বার্ষিক প্রশিক্ষণ কোর্স, যার মাধ্যমে রোজাদারদের জীবন প্রভাবিত হয়। তাই মাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার্থে মাসব্যাপী ইবাদত-বন্দেগি তথা সেহ্রি, ইফতার, তারাবি, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, ইতিকাফ, তাহাজ্জুদ, দান-সাদকা, তওবা-ইস্তেগফার প্রভৃতি আদায়ের সামগ্রিক প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]