বরকতময় সেহ্রি খাওয়ার কল্যাণ

ধর্ম
ধর্ম

রমজান মাসে ইবাদতের নিয়তে রোজা রাখার উদ্দেশ্যে শেষ রাতে উষা উদয়ের আগে যে পানাহার করা হয়, তা সেহ্রি হিসেবে পরিচিত। ‘সেহ্রি’ উর্দু শব্দ, মূল আরবি ‘সুহুর’; এর শাব্দিক অর্থ নিদ্রাভঙ্গ, ঘুম থেকে জেগে ওঠা, রাত্রি জাগরণ প্রভৃতি। সারা দিন উপবাস যাপনের জন্য সুবহে সাদিকের আগে ভোররাতে যা কিছু খাওয়া হয়, একে উর্দুতে ‘সাহ্রি’ আর আরবিতে ‘সুহুর’ বলা হয়। প্রচলিতভাবে সেহ্রি এ-দেশীয় উচ্চারণ। রোজা পালনের জন্য সেহ্রি খাওয়া সুন্নত ও অধিক সওয়াবের কাজ। ক্ষুধা-তৃষ্ণা না থাকলেও শেষ রাতে যে খাবার খাওয়া হয়, তা-ই সেহ্রি। সামান্য একটু পানি পান করাকেও সেহ্রি হিসেবে গণ্য করা হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত অনুগ্রহ করে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা অনেকাংশে লাঘব করার উদ্দেশ্যে এবং তারা যাতে পূর্ণ ৩০ দিন ক্রমাগতভাবে রমজানের রোজা রাখতে সক্ষম হন, এ জন্য ভোররাতে সেহ্রি খাওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। সেহ্রি খাওয়ার সময়সীমা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ রাত্রির কৃষ্ণ রেখা থেকে উষার শুভ্র রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের কাছে প্রতিভাত না হয়। অতঃপর নিশাগম পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭)
সেহ্রি খাওয়ার আসল সময় সূর্যাস্ত থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত যে কয় ঘণ্টা সময় তার ছয় ভাগের শেষ ষষ্ঠ ভাগ। যদি কেউ এর আগে পানাহার করেন; কিন্তু চা বা পানি ইত্যাদি ষষ্ঠাংশে পান করেন, এতেও মুস্তাহাবের সওয়াব পাবেন। যদি শেষ রাতে ঘুম না ভাঙে এবং এ জন্য সেহ্রি খেতে না পারেন, তাহলে সেহ্রি না খেয়ে রোজা রাখবেন। সেহ্রি না খাওয়ার কারণে রোজা ছেড়ে দেওয়া বড়ই গুনাহর কাজ। আর যদি নিদ্রা বা অন্য কোনো কারণবশত কেউ সেহ্রি খেতে না পারেন, তাহলে সেহ্রি না খাওয়ায় রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত সুবহে সাদিক না হয়, অর্থাৎ পূর্ব দিগন্তে সাদা বর্ণ না দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত সেহ্রি খাওয়া দুরস্ত আছে। সুবহে সাদিক হয়ে গেলে তারপর আর কিছু খাওয়াদাওয়ার সুযোগ নেই।
নবী করিম (সা.)-এর মহানুভব হৃদয় তাঁর উম্মতে মুসলিমার প্রতি অনুকম্পা ও সহৃদয়তা প্রকাশের মাধ্যমে সেহ্রি গ্রহণ করেই রোজা পালনের নির্দেশ দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং সেহ্রি খেয়েছেন এবং অনুসারীদের খাওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। সেহ্রি খাওয়ার মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নতের ওপর আমল করা হয়। সেহ্রিতে অফুরন্ত রহমত, বরকত, নিয়ামত ও কল্যাণের বিষয়ে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সেহ্রি খাও, কারণ সেহ্রি খাওয়ার মধ্যে বরকত নিহিত রয়েছে।’ (বুখারি ও মুসলিম) সাহাবায়ে কিরামও সেহ্রি খেয়ে রোজা রাখতেন। এ সম্পর্কে হজরত জায়িদ ইবনে সাবিত (রা.) বলেছেন, ‘আমরা রাসুলে করিম (সা.)-এর সঙ্গে খেয়েছি। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, সেহ্রি ও নামাজের মধ্যে (ফজরের) কী পরিমাণ সময় ছিল? তিনি উত্তরে বললেন, পঞ্চাশ আয়াত তিলাওয়াতের সমান।’
সেহ্রি রোজাদারের মনে সাহস সঞ্চার করে থাকে। সেহ্রি খাওয়ার মাধ্যমে রোজা রাখার শক্তি অর্জিত হয়। এতে রোজার কোনো রকম ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। সেহ্রি খেলে রোজাদার সহজে দুর্বল ও মনোবলহীন হয়ে পড়েন না, দীর্ঘ সময়ে অনাহারে থাকলেও কর্মঠ থাকার প্রাণশক্তি পান এবং সিয়াম পালন সহ্যসীমার মধ্যে থাকে। শেষ রাতে ক্ষুধা না থাকলেও অন্তত দু-একটি খুরমা বা খেজুর অথবা অন্য কোনো জিনিস খাবেন। কিছু না হলে একটু পানি পান করবেন। এতে সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। সেহ্রির সময় যদি কেউ সেহ্রি না খেয়ে মাত্র এক মুঠো চাল পানি দিয়ে খান বা একটি পান খান, এতেও সেহ্রি খাওয়ার সওয়াব হাসিল হয়ে যাবে। পেট ভরে সেহ্রি খাওয়া জরুরি নয়, সামান্য খাবারই যথেষ্ট। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যদি কিছু না জোটে, তবে একটি খেজুর ও এক গ্লাস পানি পান করো।’ হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা সেহ্রি খাও! যদিও তা এক ঢোঁক পানিও হয়।’ অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘তোমরা সেহ্রি খাও! যদিও তা এক লোকমা হয়।’
সেহ্রি যথাসম্ভব দেরি করে খাওয়া ভালো। তবে এত বেশি দেরি করা উচিত নয়, যাতে সুবহে সাদিক হওয়ার আশঙ্কা হয় এবং রোজার মধ্যে সন্দেহ চলে আসে। যদি সেহ্রি খেতে দেরি ¼হয় এবং এ ধারণা হয় যে ভোর হওয়ার পর কিছু পানাহার করেছে, এ অবস্থায় সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার ত্যাগ করা এবং পরে ওই রোজার কাজা আদায় করা ওয়াজিব। যদি কেউ সেহ্রি খুব জলদি খান, কিন্তু এরপর চা, পান, পানি ইত্যাদি অনেকক্ষণ পর্যন্ত খেতে থাকেন এবং সুবহে সাদিক হওয়ার কিছু আগে কুলি করে ফেলেন, তবু দেরি করার সওয়াব পাবেন। সুবহে সাদিকের আগে রাতের শেষ ভাগে সেহ্রি খাওয়া মুস্তাহাব বা পছন্দনীয়। রোজাদার ব্যক্তির যেন সাধ্যাতীত কোনো কষ্ট না হয়, এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) সেহ্রিকে সুন্নত এবং দেরিতে সেহ্রি গ্রহণ করাকে মুস্তাহাব ঘোষণা করেছেন।
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদারদের শারীরিকভাবে দুর্বল করা আল্লাহর ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য নয়, আল্লাহ তাআলা মাহে রমজানে দিনের বেলা পানাহার নিষিদ্ধ করেছেন, সে জন্য রাতের শেষাংশে প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করাই যুক্তিসংগত, রাতে ক্ষুধা না থাকলেও কিছু খাওয়া উচিত। রোজাদার যদি নিয়মিত সেহ্রি না খান, তাহলে অত্যন্ত ক্লান্ত-শ্রান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়বেন। ফলে পরের দিন রোজা রাখার সাহস হারিয়ে ফেলবেন এবং কাহিল হয়ে পড়তে পারেন। পক্ষান্তরে, ওই রোজাদার যদি শেষ রাতে পরিমাণমতো সেহ্রি খেয়ে পুরো দিন না খেয়ে থাকার প্রস্তুতি নেন, তবে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে মজবুত থাকেন এবং অতিশয় ক্ষুধায় তেমন কষ্ট পাবেন না। এখানে সেহ্রি খাওয়ার গুরুত্ব ও উপকারিতা খুঁজে পাওয়া যায়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সেহ্রি বরকতময়, আল্লাহ তোমাদের যা দান করেছেন, তা তোমরা পরিত্যাগ কোরো না।’
সেহ্রির সময় আরামের ঘুম পরিহার করে জাগ্রত হওয়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ও ইবাদত। এতে শেষ রাতে নিয়মিত ওঠার অভ্যাস হয়। কেননা, শেষ রাতে আল্লাহর রহমত অবিরাম ধারায় বর্ষিত হতে থাকে। এ সময় আল্লাহপ্রেমিকেরা সৃষ্টিকর্তার কাছে কায়মনোবাক্যে মোনাজাত, নফল নামাজ, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও জিকিরে লিপ্ত থাকেন। এ সময়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে মাগফিরাত বা ক্ষমা লাভের সর্বোত্তম সময়। এ সময়ের ইবাদতকারী ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে সফলতার সনদ লাভ করেন। সেহ্রির সময় জাগ্রত হওয়ার দ্বারা রোজার প্রতি বান্দার আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ধনী-গরিব আপামর রোজাদার এভাবে রোজার মাসে ত্যাগ-তিতিক্ষার অনুশীলনের মাধ্যমে সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হন। সেহ্রির ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতারা সেহ্রি গ্রহণকারীদের জন্য দোয়া করে থাকেন।’ নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সেহ্রি খায়, তার ওপর আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা রহমত বর্ষণ করেন।’ (তাবারানি)
ইসলামে প্রতিটি ইবাদতকে যতটুকু সম্ভব সহজতর করে দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষ ইবাদতের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এ জন্য কোনো কাজের নির্দিষ্ট পরিসীমা থাকা দরকার। যদি নবী করিম (সা.) রোজার সীমা নির্ধারণ করে না দিতেন, তাহলে রোজাদারদের নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতো। তাই তিনি বিলম্বে সেহ্রি ও দ্রুত ইফতারের সময়সীমা নির্ধারণ করে উম্মতের জন্য রোজা পালন সহজ করে দিয়েছেন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]