আমরা পারি!

মুস্তাফিজের সেই স্মরণীয় ওভার
মুস্তাফিজের সেই স্মরণীয় ওভার

পলকা একটা শরীর, চেহারায় এখনো কৈশোর, দেখলে মনে হবে হঠাৎ এসে হারিয়ে গেছে ঢাকা শহরে। বুঝলাম পাকিস্তানের সঙ্গে একটা টি-টোয়েন্টিতে সে ভালো করেছিল। তাই বলে ভারতের সঙ্গে ওয়ান-ডে ম্যাচে নামিয়ে দিতে হবে? ভারত আর পাকিস্তানের ব্যাটিং কি এক রকম? টি-টোয়েন্টি আর ওয়ান-ডে এক হলো? মুস্তাফিজুর রহমান যখন তার চতুর্থ ওভারে পরপর ছয় আর চারের মার খেল, রাগে গজগজ করে এসব ভাবতে থাকি! আরাফাত সানি থাকতে মুস্তাফিজকে নামানো হলো কেন?
ভারতের রান ৭৬ বিনা উইকেটে। ভাবি, প্রথম রমজানের নামাজ পড়াই এখন সবচেয়ে উত্তম কাজ! মন উশখুশ করতে থাকে তবু সেখানে আমার। হলো না এবার জয় তিন শর ওপর রান করেও! কিন্তু আসলেই কি হলো না? মসজিদ থেকে বের হয়ে শুনি আশপাশের ছাত্রাবাসগুলো থেকে উল্লাসধ্বনি। একটা উইকেট পড়ল তাহলে? একটাই, নাকি আরও পড়েছে ইতিমধ্যে? আকুল হয়ে দারোয়ান আর আমার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি, এ রকম উল্লাসধ্বনি আর কয়বার শুনেছেন ভাই? তাঁরা বলতে পারেন না। তার মানে, উইকেট একটাই পড়েছে মাত্র।
বাসায় ঢুকে টিভি ছেড়ে চমকে উঠি। উইকেট পড়েছে চারটি, রান মাত্র ১২২। বল করছে সাকিব। তার প্রথম ওভার। তার মানে সাকিবকে ছাড়াই চার উইকেট ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ! সাকিবই বা তাহলে বসে থাকবে কেন? ধোনিকে বোকা বানিয়ে পঞ্চম উইকেট বাংলাদেশের! আমি কম্পিউটারে ইএসপিএন খুলে দেখি চার উইকেটের দুটো নিয়েছে সেই মুস্তাফিজ!
তারপর মুস্তাফিজের সেই স্মরণীয় ওভার। পরপর দুই বলে রায়না আর অশ্বিনের বিদায়! নিজের গগনবিদারী চিৎকারে নিজেই চমকে উঠি। আমার স্ত্রী শীলাকে ছুটে গিয়ে বোঝাতে থাকি কী অসাধারণ, কী অকল্পনীয়, কী অবিস্মরণীয় কাণ্ড করে চলেছে এই বাচ্চা ছেলেটা! সে হেসে মাথা ঝাঁকায়। বুঝেছে। আর একটা উইকেট হলে ডেবু ম্যাচে হ্যাটট্রিক! এই হ্যাটট্রিক মানে বোঝ তো? হ্যাঁ বোঝে! বাংলাদেশের বিজয়ে আমার এই ছেলেমানুষি আনন্দ বহু বছর ধরে চেনে সে!

২.
বাংলাদেশের বিজয়! এই পৃথিবীতে এর চেয়ে প্রিয় শব্দ আর নেই আমাদের। আমরা ১৯৭১ সালের বিজয়ী দেশ। চীন-আমেরিকা পক্ষে থাকার পরও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতে স্বাধীন হওয়া দেশ। সেই বিজয়ের গল্প শুনলে এখনো দুই চোখ ভিজে যায় আমাদের। কিন্তু আমাদের বিশ্ব কাঁপানো বিজয় যেন থেমে গেছে এখানেই। অথচ এই বিজয়ের পর আরও বহু বিজয় প্রাপ্য ছিল আমাদের। আরও বহু রকম আনন্দে অশ্রুসিক্ত হওয়ার কথা ছিল আমাদের।
আমরা খেলাপাগল মানুষ। জিডিপি, এমডিজি কিংবা গভর্নেন্স সূচকে জিততে না পারি, তাই বলে খেলাধুলায়ও নয়? খেলাধুলায় বিজয় তো একটুও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় আমার কাছে, অনেকের কাছে! অস্কার বিজয়ীর হাসির চেয়ে অলিম্পিক গোল্ড মেডেলিস্টের আবেগমথিত কান্না কম প্রিয় নয় আমার, আমাদের!
বাংলাদেশ অলিম্পিক জিতবে না হয়তো, কোনো দিনও জিতবে না বিশ্বকাপ ফুটবল। কিন্তু আমাদের তো ক্রিকেট আছে। আর কিছুতে না পারি, বহু অবিচার, বহু অন্যায়, বহু অবজ্ঞার জবাব ক্রিকেটের জয়ে দিতে পারি আমরা। তিন মোড়লের এক দেশ ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে ফেলি আমরা, একাত্তরের খুনি পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করে ফেলি। আমাদের খেলায় বিজয়-আনন্দে মিশে থাকে জাতিগত আত্মমর্যাদাবোধ আর অহং, জাতিসত্তার গৌরবানূভূতি!
আমরা তাই ভারতের বিরুদ্ধেও জিততে চেয়েছি প্রচণ্ডভাবে। বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট টিমকে কোনো দিনও আমন্ত্রণ জানায়নি ভারত, আজও! বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে ক্রিকেটের ব্রাত্যজন করার পরিকল্পনায় শামিল ছিল ভারতও! তার চেয়ে বড় ক্ষরণ ছিল আমাদের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল নিয়ে। সেদিন ভারতের সঙ্গে খেলায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অন্যায় সিদ্ধান্তগুলো না হলে আমরাই জিতে যেতাম! আমরা এটা বিশ্বাস করি। আমাদের এই বিশ্বাসের মূল্য থাকবে না? ‘ভারতবধের’ হুংকারে আমরা সয়লাব করে দিয়েছিলাম ফেসবুক আর ইএসপিএন। তারপরও দেশের মাটিতে একবারও হারাতে পারব না ভারতকে!
আমরা পেরেছি! ভারত দলের হাড্ডি-মাংস ধসিয়ে দেওয়া বিজয়ই অর্জন করতে পেরেছি। খেলার মাঝপথে আমাদের মুস্তাফিজকে বুনো ষাঁড়ের মতো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন ভারতের অধিনায়ক। ১২ ওভার পরে সুস্থ হয়ে খেলায় ফিরে এসে পাঁচ বলে পুরো ভারতকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন মুস্তাফিজ। ক্রিকেট অভিজাততন্ত্রের গালে এমন নান্দনিক চপেটাঘাত আমরাই পারি।

৩.
আমরা পারি আরও বহু কিছু। নোবেলে প্রাইজ জিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, আমরা পারি। বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও করে স্যার আবেদ দেখিয়েছেন, আমরা পারি। সারা বিশ্বে পাণ্ডিত্যের সম্মান অর্জন করে ড. কামাল হোসেন দেখিয়েছিলেন, আমরা পারি! আমাদের মেয়ে নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া দেখিয়েছেন কতটা উঁচুতে উঠতে পারি আমরা। আমাদের সাকিব আল হাসান দেখিয়েছেন আমাদের একজনও পারে প্রবল দাপটে বিশ্বের এক নম্বর হতে!
ব্যক্তির চেয়ে দেশের বিজয় আরও বেশি হৃদয়গ্রাহী। কিন্তু সেখানে আমরা যোজন যোজন পেছনে অনেক ক্ষেত্রে। দুর্নীতিমুক্ত হওয়া, মানবাধিকার বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কিংবা সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার পথে অনেক ব্যর্থতা রয়েছে বাংলাদেশের। উন্নয়নের যত বুলিই আওড়ানো হোক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সূচকে এখনো বহু পেছনে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ তাই গ্লানিময় শিরোনাম হয় বারবার, বাংলাদেশের মানুষও হয় অসম্মানিত। রানা প্লাজা ধসে কোথায়? বাংলাদেশে। লঞ্চ ডুবে শত শত মানুষ মরে কোথায়? একটু ভাত একটু আশ্রয়ের জন্য সাগর পাড়ি দিয়ে গণকবরে ঠাঁই হয় কোন দেশের মানুষের? কোন দেশের পাসপোর্ট দেখলে ভ্রু কুঁচকে যায় মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপের ইমিগ্রেশনের? কোন দেশের মানুষ পাখির মতো গুলি খেয়ে মরে অন্য দেশের সঙ্গে সীমান্তে। সবই বাংলাদেশ!
এই দেশটার একটু পরাক্রম, একটু বিজয়, একটু সম্মানে তাই বুকের ভেতর প্লাবন নামে, চোখে আসে জল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে—আমরা পারি, আমরাও পারি।
আমাদের আছে মুস্তাফিজ আর সৌম্যের মতো অপার প্রতিভা, তামিম আর সাকিবের মতো প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ, মুশফিকের মতো দৃঢ়সংকল্প আর মাশরাফির মতো সিংহ–হৃদয় নেতৃত্ব। আছে জিতে নেওয়া আর দেশকে জয়ী করার সংকল্পে এদের নিখাদ ইচ্ছার সুদৃঢ় ঐক্য।
এমন সম্মিলন দেশের রাজনীতি আর সমাজে এলে আমরা জিতে যাব আরও বহু লক্ষ্যে। আমরা পারব আরও বহু কিছু!
এমন দিন, এমন সময় খুব দ্রুত আসুক আমার এই প্রিয় জন্মভূমিতে!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।