অসহায় মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে হবে

ভূমধ্যসাগর ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাগরে মানুষের মৃত্যু ও দুর্দশার যে চিত্র আমরা দেখছি, তাতে মানবজাতির সবচেয়ে পুরোনো তৎপরতার প্রতি নতুন করে আমরা মনোযোগী হয়ে উঠেছি। সেটা হলো অভিবাসন। সময় এসেছে, আমাদের এ সত্য গ্রহণ করতে হবে যে সমুদ্রের ঢেউ যেমন থামানো যায় না, তেমনি সেই ঢেউ বেয়ে অভিবাসীদের দেশান্তরি হওয়াও বন্ধ করা সম্ভব নয়। সে কারণেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অভিবাসনের বিষয়টিকে মোকাবিলা করতে হবে বুদ্ধিবিবেচনা ও সহমর্মিতার সঙ্গে।
আজ ২৫ কোটি অভিবাসী মানুষ দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস ও কাজ করছে। আগামী দিনগুলোয় আরও অনেক মানুষ সেই কাতারে যোগ দেবে। মানুষের এই চলাচলের বিষয়টির সুব্যবস্থাপনার জন্য এমন নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে যে দেশ থেকে মানুষ আসছে, যে দেশের মধ্য দিয়ে তারা যাচ্ছে এবং যে দেশে যাচ্ছে—সেই তিনটি দেশই লাভবান হয়। আর অবশ্যই অভিবাসীদের ভালো থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সেটা করতে চারটি ক্ষেত্রে নানা কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এটা শুরু করতে হবে এভাবে: প্রধান গন্তব্য দেশগুলো, যেমন: ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া ও ওশেনিয়ার দেশগুলোর বিপন্ন ও হতভাগ্য এসব মানুষের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া চলবে না। নির্বাচিত ব্যক্তিদের কাছে অভিবাসন এক জটিল রাজনৈতিক উভয়সংকট নিয়ে হাজির হয়। সেটা হচ্ছে, তারা কীভাবে নিজ দেশের নাগরিকদের দাবির সঙ্গে অভিবাসীদের দাবির মেলবন্ধন ঘটাবেন। অভিবাসনের মানবীয় নীতি প্রণয়নের সাহস তাঁদের থাকতে হবে। কিন্তু প্রায় সময়ই দেখা যায়, অভিবাসীদের সঙ্গে ব্যবহার করা হয় বলির পাঁঠার মতো। আবার এটাও ঠিক, অভিবাসীদের গন্তব্য দেশগুলোর সংস্কৃতি ও প্রথার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে হবে। কিন্তু গন্তব্য দেশগুলোর জনগণের এটা স্বীকার করতে হবে যে নতুন আসা মানুষ তাদের দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। গন্তব্য দেশগুলোয় দক্ষতার ঘাটতি থাকলে সেই সংকট মেটায় অভিবাসীরা। যে কাজ অন্যরা করে না বা করতে চায় না, সেটা করে তারা। আর কোনো দেশের কর্মী বাহিনীর বয়স বেড়ে গেলে অভিবাসীরা তার প্রতিস্থাপন হিসেবেও কাজ করে। মিউনিখ-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, কর্মক্ষম ও কর্মক্ষমতাহীন জনগণের মধ্যকার ভারসাম্য বজায় রাখতে শুধু জার্মানিরই ২০৩৫ সালের মধ্যে ৩২ মিলিয়ন অভিবাসীর প্রয়োজন হবে।
দ্বিতীয়ত, অভিবাসীরা যাতে তাদের দেশে সহজে ও কম খরচায় অর্থ পাঠাতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। ২০১৪ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় পাঠানো অভিবাসীদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। সে তুলনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আনুষ্ঠানিকভাবে যে উন্নয়ন ব্যয় করে, তা অনেক কম। অবশ্য দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, আর্থিক মধ্যস্বত্বভোগীরা অভিবাসীদের পাঠানো আয়ের ৯ শতাংশই খেয়ে ফেলে। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের ভাগ কমানো সম্ভব হলে অভিবাসীদের পরিবারের আয় বাড়বে, সেসব দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের পরিধি বাড়বে। এর সঙ্গে সেখানে দারিদ্র্য দূর হবে, আর তার পরিপূরক হিসেবে সেটা বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে।

>সীমান্তে উঁচু বেড়া বানিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। যত দিন আমরা সবচেয়ে দরিদ্র ও অরক্ষিত মানুষের এই দুর্দশা থেকে বের করে আনতে না পারছি, তত দিন অভিবাসন চলবে। এ দুর্দশা এড়াতেই তারা এখন দেশান্তরি হচ্ছে

তৃতীয়ত, অভিবাসন-প্রক্রিয়াকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে, যাতে আশ্রয়-প্রত্যাশীদের আবেদন ন্যায্যতার সঙ্গে ও উন্মুক্তভাবে দ্রুত প্রক্রিয়া করা যায়; অভিবাসীদের রক্ষা ও পুনর্বাসন করা যায়। যেমন ইউরোপীয় দেশগুলোকে অভিবাসীদের আগমন ভাগাভাগি করে নিতে কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে। উন্নত বিশ্বের প্রায়ই এমন ভুল ধারণা জন্মে যে তাদের বিপুলসংখ্যক উন্নত জীবন-প্রত্যাশী মানুষের দায় নিতে হয়, এটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বাস্তবে দেখা যায়, ৭০ শতাংশ অভিবাসী উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অভিবাসন প্রত্যাশা করে। যেমন, লেবাননের কথাই ধরুন। দেশটির জনসংখ্যা ৪৫ লাখ। এ বছরের শেষের দিকে দেশটিতে আশ্রয় গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা হবে প্রায় ২০ লাখ। যুদ্ধবিধ্বস্ত পার্শ্ববতী দেশ সিরিয়া ও অন্য দেশগুলো থেকে আসা মানুষ সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে।
একসময় ইউরোপীয়রা যে কারণে দেশ ত্যাগ করেছিল, আজ যারা অভিবাসী হচ্ছে, তারাও সেই একই কারণে দেশ ত্যাগ করছে। তারা দারিদ্র্য, যুদ্ধ ও নিপীড়ন এড়াতে এ পথে নেমেছে, অথবা নতুন দেশে উন্নত জীবনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। তারপরও লেবাননে আসা অভিবাসীসহ আজকের অভিবাসন-প্রত্যাশীদের ১৯৫১ সালের কনভেনশন রিলেটিং টু দ্য স্ট্যাটাস অব রিফিউজিস ও পরবর্তীকালের প্রটোকল রিলেটিং টু দ্য স্ট্যাটাস অব রিফিউজিস অনুসারে আশ্রয় প্রার্থনার আইনি অধিকার আছে। সম্ভাব্য অভিবাসন-প্রত্যাশীদের যদি সমুদ্র থেকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয় বা তাদের অসন্তোষজনক পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয় এবং নিয়ন্ত্রণমূলক আইনি ব্যাখ্যার কারণে তাদের ঢুকতে দেওয়া না হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের সুরক্ষা থাকে না। আর শেষমেশ, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হলে পাচারকারীদের ওপর আরোপ করতে হবে, যারা এর ভুক্তভোগী তাদের ওপরে নয়। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে আমাদের জন্য অভিবাসন-প্রক্রিয়া আইনি পথ থেকে বেআইনি পথে চলে না যায়, যার কারণে অপরাধীরা এই অভিবাসন-প্রত্যাশীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অশ্লীল কায়দায় মুনাফা করতে পারে।
না, এটা গয়রহ অভিবাসনের পক্ষে ওকালতি নয়। কিন্তু এটা মেনে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ যে অভিবাসন-প্রক্রিয়ায় বাধা দিলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য, যার বিপর্যয়কর পরিণতির শিকার হবে সেই মানুষেরা। তারা ভূমধ্যসাগর ও আন্দামান সাগরে নৌকা ডুবে মরতে পারে, আবার দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও অন্যান্য জায়গায় তাদের (বিদেশিদের) ওপর আক্রমণে মারা পড়তে পারে।
সীমান্তে উঁচু বেড়া বানিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। যত দিন আমরা সবচেয়ে দরিদ্র ও অরক্ষিত মানুষের এই দুর্দশা থেকে বের করে আনতে না পারছি, তত দিন অভিবাসন চলবে। এ দুর্দশা এড়াতেই তারা এখন দেশান্তরি হচ্ছে। ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে আমি জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থায় কাজ করতাম। সে সময় আমি দেখেছি, কীভাবে ইউরোপের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও বিদ্যায়তনের মানুষ ভিয়েতনাম থেকে নৌকায় করে পলায়নরত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। আজ দুনিয়া সেই নৈতিক কর্তব্যের মুখোমুখি হয়েছে, সেদিনের মতো আবারও তাদের এই অসহায় মানুষদের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
(গত শনিবার ছিল আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস। সে উপলক্ষে এই নিবন্ধ ছাপা হলো।)
কফি আনান: জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব।